কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত নারীর সংখ্যা বেড়েছে ৭৩ লাখ ৫০ হাজার
নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ বিশ্বের এক বিস্ময়ের নাম। রক্ষণশীল বাঙালি সমাজে তিন দশক আগে কল্পনা করা না গেলেও এখন বিচারক, সচিব, সেনা কর্মকর্তা, প্যারাট্রুপার, বিজিবির সৈনিক, পুলিশের এসপি, ট্রাফিক সার্জেন্টসহ সব ক্ষেত্রেই নারীর পদচারণা রয়েছে। লিঙ্গ বৈষম্য দূর করতে বাংলাদেশের অগ্রগতিতে প্রশংসায় পঞ্চমুখ এখন সারা বিশ্বই। জাতিসংঘও বাংলাদেশকে উদাহরণ হিসেবেই মানে।
গত ১১ বছরে নারীর ক্ষমতায়নে কর্মসংস্থানের দিক থেকে নারীর অংশগ্রহণ পুরুষদের তুলনায় বেড়েছে চার গুণেরও বেশি। আর কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত নারীর সংখ্যা বেড়েছে ৭৩ লাখ ৫০ হাজার জন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যার ব্যুরোর হিসাবে দেশে প্রতি বছর নারীদের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রায় ছয় শতাংশ হারে। আর পুরুষের কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার দেড় শতাংশ। যা পুরুষের তুলনায় পাঁচ গুণ বেশি।
৯০ দশকের পর থেকেই নারী অগ্রগতির শুরু বাংলাদেশে। পরের দশক থেকে গতিটা আরও বাড়ে। এরই মধ্যে মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষায় মেয়েরা ছাড়িয়ে গেছে আর উচ্চ মাধ্যমিকেও মেয়েরা ছেলেদের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।
তবে চাকরি ক্ষেত্রে মেয়েরা এখনও তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে রয়েছে যদিও পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, এই খাতেও পার্থক্যটা কমে এসেছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৫-০৬ অর্থবছরে নারী কর্মসংস্থান ছিল এক কোটি ১৩ লাখের মতো। আর ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জরিপে এই সংখ্যাটি পাওয়া গেছে এক কোটি ৮৬ লাখ ৫০ হাজার জন।
অবশ্য নারীর কর্মসংস্থান বৃদ্ধির এই হার প্রতিষ্ঠানিক খাতের তুলনায় অপ্রতিষ্ঠানিক খাতেই বেশি। কর্মসংস্থানের মধ্যে ৬০ শতাংশই আবার কৃষি ক্ষেত্রে। প্রাতিষ্ঠানিক খাতের মধ্যে দেশের পোশাক খাতে নারীর উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। তবে সব খাতেই তাদের পদচারণা বাড়ছে।
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা ও বিভাগীয় শহরগুলোতে বিপণিবিতান জুড়ে রয়েছে নারীরা। রাজধানীর কোনো কোনো বিপণিবিতানের কর্মচারীদের শতকরা ৭০ জনই নারী। নারীর কর্মসংস্থানের বেশি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে কল সেন্টারগুলোতে।
আবার বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সংস্থা ও ব্যক্তি উদ্যোগে ক্ষুদ্র শিল্পও গড়ে তুলেছেন অনেক নারী। গ্রামাঞ্চলের পাশাপাশি এমন অনেক নারী উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে রাজধানী জুড়ে। ই-কমার্স বা অনলাইন ভিত্তিক পণ্য বিক্রি কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করেছে অনেক নারীর।
পাঁচ বছর আগেও যেসকল খাতে নারীদের আনাগোনা লক্ষ্য করা যায়নি, সেসব খাতে এখন নারীদের উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। নারীদের কর্মসংস্থান হয়েছে গণপরিবহন খাতেও। বাস চালকের আসনে চলতি বছরই প্রথম নারীদের দেখা গেছে।
মিরপুরের এলভি গ্রুপের একজন নিয়োগকর্তা সিরাজ হায়দার বলেন, ‘পুরুষের চাইতে নারীদের ধৈর্য ক্ষমতা বেশি। এছাড়া পুরুষের চেয়ে নারীদের চাহিদা কম। তুলনামূলক কম বেতনে নারী শ্রমিক পাওয়া যায়।‘
বাংলাদেশ লেবার ফোর্স সার্ভে (এলএফএস) ২০১৬-১৭ অর্থবছরের এক তথ্যে বলা হয়েছে, দেশে মোট এক কোটি ৮৬ লাখ ৫০ হাজার নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে যা ছিল এক কোটি ৭৮ লাখ। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে তা ছিল কোটি ৬৮ লাখ। ২০১০-১১ অর্থবছরে ছিল আরও ছয় লাখ কম। পাঁচ বছর আগে ২০০৫-০৬ অর্থবছরে নারী কর্মসংস্থান ছিল এক কোটি ১৩ লাখ। সে হিসাবে দেশে গত ১১ বছরে নারীর কর্মসংস্থানের সংখ্যা বেড়েছে ৭৩ লাখ ৫০ হাজার।
পরিসংখ্যার ব্যুরো যে হিসাব দিয়েছে তাতে দেখা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে কৃষি খাতে নারী শ্রমিক ছিল এক কোটি ১১ লাখ ৩০ হাজার। এছাড়া ৩১ লাখ ৪৫ হাজার নারী শিল্প খাতে ও ৪৩ লাখ ৭২ হাজার সেবা খাতে নিয়োজিত।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর পরিচালক কবির উদ্দিন আহমেদ বলেন, "যে খাতগুলোতে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে তার মধ্যে কৃষিকাজ বা বেতনহীন পারিবারিক শ্রম দান থেকে নারীরা বেরিয়ে এসেছে। তার বদলে চাকরী, বিক্রয়-কাজ, ব্যবসা ইত্যাদিতে যুক্ত হয়েছে তারা। অন্যদিকে নতুন কাজে গত ২০ বছর ধরেই ট্রেন্ড দেখা যাচ্ছে যে পুরুষরা পিছিয়ে পড়েছে। কিন্তু এগিয়ে গেছেন নারীরা"।
২০১৬-১৭ অর্থবছরে কৃষিতে নারী শ্রমিক কমেছে প্রায় ৮২ হাজার। এসময়ে নারী উপস্থিতি বেড়েছে শিল্প ও সেবা খাতে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে শিল্প খাতে নারী কর্মসংস্থান বেড়েছে দুই লাখ ৮৪ হাজার। সেবা খাতে বেড়েছে ছয় লাখ ৭৪ হাজার।
২০১৭ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের উচ্চপদেও নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে চোখে পড়ার মতো। ৩৬তম বিসিএস পরীক্ষায় সারাদেশ থেকে অংশ নিয়েছিল দুই লাখ ১১ হাজার ২৮২ জন। যার এক তৃতীয়াংশ নারী।
সুপারিশকৃত প্রার্থী তালিকায় এক ৭১৪ জন পুরুষের বিপরীতে নারী ছিল ৬০৯ জন যা শতকরা হিসাবে ছিল ৩৩.১৩ শতাংশ।
এর আগে ৩২ তম বিশেষ বিসিএস পরীক্ষায় পুরুষের তুলনায় এগিয়ে ছিল নারীরা। ৭৫২ জন পুরুষের বিপরীতে চূড়ান্ত সুপারিশ তালিকায় নারীর সংখ্যা ছিল ৯২৩ জন। যা শতকরা হিসেবে ৫৫.১০ শতাংশ। ৩৩ তম বিসিএসে চূড়ান্ত সুপারিশ তালিকায় নারীর সংখ্যা ছিল ৩৮.২৬ শতাংশ। ৩৪ তম বিসিএস এ ৩৫.৬২ এবং ৩৫ তম বিসিএস এ ২৭.৯২।
বিআইডিএস এর সাবেক গবেষক ড রুশিদান ইসলাম রহমান বলেন, ‘এভাবে নারীদের এগিয়ে যাওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম। সেটা অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। কিন্তু আসল কথা হল এসব ক্ষেত্রে নারীরা মূলত নিয়োগপ্রাপ্ত হচ্ছে আধা দক্ষ কিংবা অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে। ফলে তাদের বেতনও দক্ষ শ্রমিকদের থেকে অনেক কম। অন্যদিকে দক্ষ শ্রমকি বা অতি দক্ষ বা পেশাদার ম্যানেজারিয়াল এসব ক্ষেত্রে কিন্তু পুরুষদের অনুপাতটা বেশি-ই থেকে যাচ্ছে। এর ফলে এক্ষেত্রে বৈষম্য থাকছেই’।