ভারতের উত্তরপ্রদেশের কানপুরে সহিংসতার চারদিন পর মহানবী হজরত মুহাম্মদকে (সা.) নিয়ে অবমাননাকর টুইট করার অভিযোগে হর্ষিত শ্রীবাস্তব নামে এক বিজেপি নেতাকে গ্রেফতারর করা হয়েছে।
মঙ্গলবার (০৭ জুন) পুলিশের বরাত দিয়ে এ খবর জানিয়েছে দেশটির সংবাদ মাধ্যম এনডিটিভি।
গ্রেফতার হওয়া হর্ষিত শ্রীবাস্তব বিজেপি যুব শাখার একজন কর্মকর্তা। তার টুইট মুছে ফেলা হয়েছে।
কানপুরের পুলিশ কমিশনার বিজয় মীনা বলেন, ‘আপত্তিকর পোস্টের মাধ্যমে হর্ষিত শ্রীবাস্তব পরিবেশ নষ্ট করার চেষ্টা করছিলেন। যে কেউ ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে খেলার চেষ্টা করলে আমরা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’
এদিকে, ক্ষমতাসীন দল বিজেপির বেশ কয়েকজন নেতা মহানবী হজরত মুহাম্মদকে (সা.) নিয়ে কটূক্তি করায় দেশ-বিদেশে ক্রমবর্ধমান ক্ষোভের মধ্যেই রোববার (৫ জুন) দলটির মুখপাত্র নুপুর শর্মা এবং তার সহকর্মী নবীন কুমার জিন্দালকে বহিষ্কার করা হয়।
সম্প্রতি ভারতীয় একটি টেলিভিশন চ্যানেলে বিতর্কের সময় মহানবীকে (সা.) নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্য করেন নুপুর শর্মা। একই বিষয় নিয়ে আবার টুইটারে পোস্ট দেন নবীন কুমার। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঘটেছে সংঘর্ষের ঘটনা। শুক্রবার (০৩ জুন) কানপুরের কিছু অংশে জুমার নামাজের পরে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এতে আহত হন কমপক্ষে ৪০ জন। এ ঘটনায় বিশ্বজুড়ে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে এবং ১৬টি দেশ বিতর্কিত মন্তব্যের নিন্দা জানিয়েছে।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে বিতর্কিত মন্তব্য ঘিরে ইরান, ইরাক, কুয়েত, কাতার, সৌদি আরব, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জর্ডান, আফগানিস্তান, বাহরাইন, মালদ্বীপ, লিবিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া সহ অন্তত ১৫টি দেশ ভারতের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানিয়েছে।
একইসঙ্গে এই দেশগুলো নিন্দা জানানোর পাশাপাশি মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অপমান প্রত্যাখ্যান করেছে এবং ভারত সরকারকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানিয়েছে।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের মতো দেশের ভেতরেও বিরোধী দলগুলোর তীব্র চাপের মুখে পড়েছে ভারতের বিজেপি সরকার। দেশটির বিরোধী দলগুলো বিজেপির অভিযুক্ত দুই নেতার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য চাপ আরও বাড়ানোর পাশাপাশি কট্টর হিন্দুত্ববাদী এই দলটিকে আন্তর্জাতিক স্তরে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে।
এদিকে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, আক্রমণাত্মক কোনো টুইট ও মন্তব্য ‘কোনোভাবেই বিজেপি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন নয়। এগুলো ব্যক্তিগত বা প্রান্তিক উপাদানের মতামত’।
আরও পড়ুন: মহানবীকে নিয়ে মন্তব্য : সেই নেত্রীকে খুনের হুমকি
অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন (ওআইসি) বিজেপির ওই দুই নেতার মন্তব্যের নিন্দা করেছে এবং ভারতে সংখ্যালঘু মুসলিমদের অধিকার সুরক্ষিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য ভারতকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে বলে জানিয়েছে কাতার। কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘‘এই ধরনের ‘ইসলামভীতিপূর্ণ’ মন্তব্যের বিরুদ্ধে যদি শাস্তিমূলক পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে তা মানবাধিকার রক্ষায় গুরুতর বিপদ তৈরি এবং অত্যধিক কুসংস্কার ও প্রান্তিকতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। যা সহিংসতা ও ঘৃণার চক্র তৈরি করবে।’’
সৌদি আরবও বিবৃতিতে কিছু কড়া শব্দ ব্যবহার করেছে। দেশটির বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘বিজেপি মুখপাত্রের বক্তব্যে নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করছে সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।’
এদিকে নয়াদিল্লির কাতার দূতাবাসের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছেন, নরেন্দ্র মোদির সরকারকে প্রকাশ্যে মন্তব্য করা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে হবে। বার্তাসংস্থা রয়টার্স ওই কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে, ‘আমাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে যেকোনো আঘাত সরাসরি অর্থনৈতিক সম্পর্ককে প্রভাবিত করতে পারে।’
সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) বিজেপির মুখপাত্রের বক্তব্যের নিন্দা করে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অবমাননা প্রত্যাখ্যান করেছে। একইসঙ্গে ধর্মীয় প্রতীকগুলোকে সম্মান করার এবং তাদের লঙ্ঘন না করার পাশাপাশি ঘৃণামূলক বক্তব্য ও সহিংসতার মোকাবিলা করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছে দেশটি।
বিজেপি অবশ্য অভিযুক্ত মুখপাত্র নুপুর শর্মাকে ইতোমধ্যেই বরখাস্ত করেছে এবং বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য নবীন জিন্দালকে বহিষ্কার করেছে। গত রোববার এক বিবৃতিতে দলটি জানিয়েছে, ‘বিজেপি যেকোনো ধর্মের, যেকোনো ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের অবমাননার তীব্র নিন্দা জানায়। কোনো সম্প্রদায় বা ধর্মকে অপমান বা হেয় করে, এমন যেকোনো মতাদর্শের বিরুদ্ধেও বিজেপির অবস্থান। বিজেপি এমন মানুষ বা মতাদর্শের প্রচার করে না।’
এদিকে দিল্লি পুলিশের কাছে একটি অভিযোগ দায়ের করেছেন অভিযুক্ত নুপুর শর্মা। সেখানে তিনি অভিযোগ করেছেন যে, তাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এর আগে নুপূর শর্মা ক্ষমা প্রার্থনা করে টুইটারে একটি পোস্ট করেন।
সেখানে আত্মপক্ষ সমর্থন করে তিনি দাবি করেন, কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা তার উদ্দেশ্য ছিল না।
সোমবার (০৬ জুন) সহিংসতার সঙ্গে জড়িত অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ৪০টি ছবিসহ পোস্টার প্রকাশ করেছে কানপুর পুলিশ। সিসিটিভি এবং মোবাইল ফোনে ধারণ করসহ ঘটনার বেশ কয়েকটি ভিডিওর মাধ্যমে অভিযুক্তদের ছবি সংগ্রহ করেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
সহিংসতার ঘটনায় দেড় হাজারেরও বেশি নাম ও অজ্ঞাত ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ পর্যন্ত মূল অভিযুক্ত জাফর হায়াতসহ ৫০ জনেরও বেশি লোককে গ্রেফতার করা হয়েছে।