Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৮ রবিবার, এপ্রিল ২০২৪ | ১৫ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

যেভাবে রক্ষা পেয়েছে পবিত্র নগরী ‘মক্কা’

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ০২ আগস্ট ২০১৯, ০৬:২৭ PM
আপডেট: ০২ আগস্ট ২০১৯, ০৬:২৭ PM

bdmorning Image Preview
সংগৃহীত


মুসলিমদের কাছে পবিত্রতম স্থান ‘কাবা শরিফ’-এর অবস্থান মক্কা নগরীতে। প্রতিবছর হজ পালনের জন্য সেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে যান ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্ম আর বেড়ে ওঠাও এই পবিত্র নগরীতে। কাবা শরিফ এবং মক্কা নগরীর ইতিহাস নিয়ে লিখেছেন আন্দালিব আয়ান

হাজরে আসওয়াদ ও মাকামে ইব্রাহিম

মক্কা নগরীর অবস্থান সৌদি আরবে। আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগে এই অঞ্চলের আশপাশ ছিল জনবিরল মরুভূমি। সেই যুগে এক দিন হজরত ইব্রাহিম (আ)-কে তার স্ত্রী সারাহ ঈর্ষান্বিত হয়ে শিশুপুত্র ইসমাইলসহ তার মা হাজেরাকে চোখের আড়াল করতে অনুরোধ করেছিলেন। আল্লাহর নির্দেশে ইব্রাহিম (আ.) তাদের মক্কার বিরান ভূমিতে রেখে যান। বুখারি শরিফে উল্লেখ আছে, সেখানে ছোট্ট শিশু ইসমাইল-এর পায়ের আঘাতে ‘জমজম’ কূপ সৃষ্টি হয়। মরুর বুকে এই জলাধারের সন্ধান পেয়ে ওই এলাকায় লোকজন আবাস গড়তে শুরু করে এবং লোকালয় গড়ে ওঠে। ইসমাইলের নামানুসারে এই জনগোষ্ঠীর নাম হয় ইসমাইলি। ছোট্ট ইসমাইল তাদের কাছেই আরবি শেখেন। ইসমাইল বড় হওয়ার পর হজরত ইব্রাহিম (আ.) মক্কায় আসেন এবং আল্লাহ্র আদেশে এখানে ‘কাবাঘর’ নির্মাণ শুরু করেন।

কাবার প্রাথমিক গঠন নির্মাণ শেষে এক ফেরেশতা তার কাছে একটি অপার্থিব ‘সাদা’ পাথর নিয়ে আসেন। মক্কার নিকটবর্তী আবু-কুবাইস পর্বতের ওপর আকাশ থেকে এই পাথরটি পতিত হয়েছিল। কাবার পূর্ব কোণে স্থাপন করা এই পাথরটি কালের বিবর্তনে সাদা থেকে কালো পাথরে পরিণত হয়। এটি এখন ইসলাম ধর্মের খুব গুরুত্বপূর্ণ পবিত্র বস্তু। সে আমলে কাবা শরিফের কোনো কিছুই আর অবশিষ্ট না থাকলেও দুটো পাথর আজও অক্ষত। একটি হলো সেই পাথর, যাকে ‘হাজরে আসওয়াদ’ বলে, যার অর্থ ‘কালো পাথর’। আরেকটি হলো ‘মাকামে ইব্রাহিম’, যেটিতে হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর পায়ের ছাপ আছে।

আব্রাহার হস্তিবাহিনী ও সবুজ পাখি

৫৭০ খ্রিস্টাব্দ। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্মের সাল। ততদিনে বহু শত বছর পাড়ি দিয়েছে মক্কার কাবা শরিফ। ততদিনে শুধু আল্লাহর উপাসনা নয়, কাবা শরিফে স্থাপন করা হয় অসংখ্য দেব-দেবীর মূর্তি। প্রতিবছর হজ মৌসুম ছিল মক্কার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তখন অনেক পর্যটক আসত। তারা দেব-দেবীর পূজা না করলেও কেবল আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করত। এ সময় মক্কার অধিবাসীদের অন্যতম নেতা ছিলেন শায়বা। যাকে ‘আব্দুল মুত্তালিব’ নামে সবাই চিনত।

দূর-দূরান্ত থেকে অনেক মানুষ মক্কার এক উপাসনালয় ভ্রমণ করতে যায়, এমন খবর শুনে ইয়েমেনের উগ্র খ্রিস্টান রাজা আব্রাহা রেগে যান। কারণ তিনি একটি ক্যাথেড্রাল বানিয়েছিলেন, যেখানে খুব বেশি মানুষের সমাগম হতো না। আব্রাহা তার এক লোককে দায়িত্ব দিয়েছিলেন, ওই ক্যাথেড্রালের কথা প্রচার করার জন্য। কিন্তু প্রচারকাজ চালানোর সময় সেই লোককে কেউ একজন তীরবিদ্ধ করে মেরে ফেলে। এ খবর পেয়ে আব্রাহা ক্রোধে অন্ধ হয়ে যান। তার সব রাগ গিয়ে পড়ে আরবের মক্কার সেই কাবার ওপর। তিনি কাবা ধ্বংস করে দেওয়ার মনস্থির করেন। আব্রাহা তখন ৪০ হাজার সৈন্য নিয়ে মক্কার দিকে রওনা দেন। তার বাহিনীর সম্মুখে ছিল একটি সাদা হাতি। মোট আটটি হাতি ছিল সেই বাহিনীতে। আব্রাহা ভেবেছিলেন হাতি দিয়ে কাবা শরিফ গুঁড়িয়ে দেবেন তিনি।

বর্ণিত আছে, মক্কার সীমানায় পৌঁছালে, আব্রাহার সাদা হাতি বসে পড়ে। সেটাকে জোর করেও আর আগানো যাচ্ছিল না। আব্রাহার নির্দেশে একটি দল মক্কাবাসীদের উট কেড়ে নিয়ে এলো। এর মধ্যে আব্দুল মুত্তালিবেরও ২০০ উট ছিল। আব্রাহা ঘোষণা দিলেন, ‘আমি কেবল কাবা ধ্বংস করতে এসেছি, মানুষকে নয়, তবে কেউ বাধা দিলে সে মরবে।’

আব্দুল মুত্তালিবের পরামর্শে মক্কার সবাই পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। পরে তিনি আব্রাহার আহ্বানে সাড়া দিয়ে একটি মিটিং করতে গেলেন। আলোচনার শুরুতেই মুত্তালিব বললেন, ‘আমার উট ফেরত দিন।’ আব্রাহা অবাক হয়ে বললেন, ‘আমি তো ভাবলাম আপনি অনুনয় বিনয় করবেন, আমি যেন আক্রমণ না করে ফিরে যাই ইয়েমেনে। আমি আপনাদের উপাসনালয় ধ্বংস করে দিতে এসেছি। আপনাদের বাপ-দাদাদের উপাসনালয়! আপনাদের মানসম্মান, প্রতিপত্তি সব মিশে যাবে! আর এসব বিষয়ে কথা না বলে আপনি বলছেন, আপনার উট ফেরত দিতে?’

আব্দুল মুত্তালিব তখন বললেন, ‘আমি আমার উটের মালিক। আমি তাই আমার উট চাইতে এসেছি। আর এই ঘরের মালিক আল্লাহ নিজেই এর রক্ষাকর্তা। আমি নিশ্চিত তিনি তার ঘর রক্ষা করবেন।’ আব্রাহা অবাক হয়ে যান এমন কথা শুনে। তিনি কুরাইশদের উটগুলো দিয়ে দেন। আব্দুল মুত্তালিবও ফিরে যান তার বাড়িতে। পরদিন সকালে আব্রাহা তার বাহিনী নিয়ে ঢুকতে যাবেন মক্কায়। তখনই হঠাৎ আকাশে দেখা গেল, বিশাল এক ঝাঁক সবুজ পাখি। আবাবিল নামের এই পাখিগুলো ঠোঁটে আর পায়ে করে পাথর নিয়ে আসে এবং সেনাবাহিনীর ওপর এগুলো বৃষ্টির মতো ফেলে দিতে শুরু করে। এই পাথর বর্ষণে ইথিওপিয়ান বাহিনীর বেশিরভাগ সৈন্য পালিয়ে যায়, বাকিরা নিহত হয়। আব্রাহাও গুরুতর আহত হন এবং ইয়েমেনে পালিয়ে যাওয়ার পথে মারা যান।

পবিত্র মসজিদ

৬০৫ সালে হজরত মুহাম্মদ (সা.) কাবা শরিফের কালো পাথর নিয়ে একটি কোন্দল সমাধান করে দেন। সে সময় আগুনে পুড়ে কাবার অনেক ক্ষতি হয়েছিল। বিশ্বনবী নিজ হাতে পাথরটি পুনঃস্থাপন করেন। এখন সেই কালো পাথর রুপালি ফ্রেমে আবদ্ধ করে কাবার কোনায় লাগানো আছে। এখান থেকে একটি দীর্ঘ লাইন মেঝেতে দাগ কাটা আছে অনেক দূর পর্যন্ত। এ লাইন থেকে শুরু করে একবার ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে ঘুরে আবার ওই লাইনে আসা হলো একবার তাওয়াফ। এভাবে সাতবার তাওয়াফ করতে হয়। এটি হজের একটি অংশ এবং হজ মৌসুম বাদে ওমরাতেও এভাবে তাওয়াফ করতে হয়। ইসলামি বিশ্বাস অনুযায়ী, ওই কালো পাথরে চুমু খেলে পাপমোচন হয়।

কাবা শরিফে যুদ্ধ আর রক্তপাত নিষিদ্ধ বলে একে মসজিদুল হারাম বলা হয়। মক্কা বিজয়ের সময় কয়েকজন অপরাধী এ কারণে মসজিদুল হারামে লুকিয়ে পড়েছিল, যেন কেউ তাদের ক্ষতি করতে না পারে।

এই কাবা শরিফের দিকে ফিরেই মুসলিমরা নামাজ আদায় করেন। এর আগে জেরুজালেমের পবিত্র ঘরের দিকে ফিরে নামাজ আদায় করা হতো। বহুকাল ধরেই দূর-দূরান্ত থেকে সব ধর্মের মানুষ কাবা প্রদক্ষিণ করতে আসতেন।

দশম হিজরিতে নবী করিম (সা.) হজের নেতৃত্ব দেন। হজ কীভাবে পালন করা উচিত তা তিনি ওই হজে নির্দিষ্ট করে দেন। সেবার জিলহজ মাসে হজ সম্পন্ন হয়। ইতিহাসে এটি ‘বিদায় হজ’ নামে অভিহিত। এ বছর থেকেই ‘নাসি’ প্রথার বিলোপ সাধন করে খাঁটি চান্দ্র বছরের প্রচলন হয় এবং জিলহজ মাসের কয়েকটি দিন হজের সময় হিসেবে নির্ধারিত হয়। হজের মৌসুমে আগতদের সঙ্গে ব্যবসা করে আজ সমৃদ্ধ মক্কার ব্যবসায়ীরা।

মক্কা অবরোধ (৬৮৩ ও ৬৯২ সাল)

খলিফার পদ নিয়ে যুদ্ধের ফলাফল হিসেবে ৬৮৩ সালে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল কাবা। সেবার উমাইয়া শাসক ইয়াজিদ সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধ দমন করতে আরবে সৈন্য পাঠান। তার বাহিনী মদিনার নিয়ন্ত্রণ নিলেও মক্কাবাসী আত্মসমর্পণ করেনি। তাই টানা এক মাস অবরোধ করে রাখা হয় মক্কা। এ সময়টিতেই আগুনে কাবা শরিফ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু অবরোধ চলাকালীন ঘোড়া দুর্ঘটনায় ইয়াজিদের মৃত্যু হলে অবরোধ শেষ হয়ে যায়।

পরে সম্ভাব্য পরবর্তী খলিফা আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর (রা.) ক্ষতিগ্রস্ত কাবা পুরোটা ভেঙে নতুন করে গড়তে চাইলে কেউ এগিয়ে আসছিল না। কারণ তারা ভেবেছিল, যে কাবা ভাঙতে এগিয়ে আসবে তার ওপর আসমানি গজব পড়বে। তবে একজন সাহস করে একটা পাথর ছুড়ে মেরে দেখল, তার ওপর কোনো গজব আসেনি। এটা দেখে বাকিরা কাবা ভেঙে পুনর্নির্মাণের কাজ শুরু করল। সেবার একটি হাদিসের ভিত্তিতে কাবার পরিধি বাড়িয়ে হাতিম জায়গাটিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে, সেখানে কোনো ঘনক আকৃতি ছিল না। অবরোধ আর আক্রমণে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া ‘হাজরে আসওয়াদ’ বা কালো পাথরটিকে আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর (রা.) একটা রুপার ‘লিগামেন্ট’ ব্যবহার করে জোড়া লাগিয়েছিলেন।

দ্বিতীয়বার মক্কা অবরোধ করা হয় ৬৯২ সালে। সেবার উমাইয়া খলিফা আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ান হাজ্জাজ বিন ইউসুফকে মক্কায় পাঠান আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর (রা)-কে পরাজিত করে খিলাফতের প্রতিদ্বন্দ্বী নিশ্চিহ্ন করতে। এভাবে নতুন করে দ্বিতীয়বারের মতো অবরোধ করা হয় মক্কা। ওই অবরোধ স্থায়ী হয় ছয় মাস। অবরোধকারীরা আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর

(রা)-কে মক্কায় হত্যা করে। তার দুই পুত্রও কাবার পাশে লড়াইরত অবস্থায় মারা যান। এই আক্রমণের সময় পাথর নিক্ষেপ করে কাবা ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়। পরে আব্দুল মালিক আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইরের বানানো অতিরিক্ত অংশ ধ্বংস করে কাবার কুরাইশি ঘনক আকৃতি ফিরিয়ে আনেন।

কার্মাতিয় আক্রমণ (৯৩০)

৯৩০ সালের হজের সময় মিশ্র ধর্মের কার্মাতিয়রা তাদের নেতা আবু তাহিরের নেতৃত্বে মক্কায় সন্ত্রাসী আক্রমণ করে এবং অসংখ্য হাজিকে খুন করে লাশ জমজম কূপে ফেলে দেয়। এমনকি কালো পাথরটিও চুরি করে নিয়ে যায় এবং তাদের বানানো উপাসনালয়ে এটি স্থাপন করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল মক্কা থেকে হজ বাতিল করা। কিন্তু দেখা গেল, পাথর ছাড়াই হজ চলতে থাকে মক্কায়।

২৩ বছর পর, ৯৫২ সালে আব্বাসীয় খলিফা বিশাল অংকের অর্থ দিয়ে সেই পাথর ফিরিয়ে আনেন। জানা যায়, কুফার এক মসজিদে এক শুক্রবারে বস্তাবন্দি পাথরটি ছুড়ে দিয়ে যায় এক কার্মাতিয়। এই ছুড়ে মারার ফলে পাথরটি সাত টুকরা হয়ে যায়।

১৬২৯ সালের বন্যা

১৬২৯ সালে প্রচন্ড বৃষ্টির ফলে বন্যার সূত্রপাত হয় পবিত্র নগরী মক্কায়। এই বন্যার পানিতে কাবা শরিফের দেওয়াল ধসে গিয়েছিল। তবে, বন্যা শেষ হয়ে যাওয়ার পর নতুন করে গ্রানাইট পাথর দিয়ে আবারও কাবাঘর বানানো হয়। ওসমানী সম্রাট চতুর্থ মুরাদের আমলে মসজিদ পুরোটা সুন্দর করে আবার বানানো হয়। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত সেই কাঠামোটিই টিকে আছে।

১৯৭৯ সালে কাবা দখল

ইসলামে বর্ণিত ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, ক্রান্তিলগ্নে মুসলিম জাতিকে নেতৃত্ব দিতে আবির্ভাব হবেন মুহাম্মাদ নামের এক ব্যক্তি, যাকে বলা হবে ইমাম মাহদি। কোনো এক হজের মৌসুমে তাওয়াফের সময় মানুষ তাকে চিনে ফেলবে এবং তাকে জোর করেই জাতির নেতা বানিয়ে দেবে। আর এ ঘটনার পরই হজরত ঈসা (আ.) বা যিশু খ্রিস্ট পুনরায় পৃথিবীতে আগমন করবেন।

এই ভবিষ্যদ্বাণীর ওপর ভর করে ১৯৭৯ সালে নভেম্বরে কাবা দখলের চেষ্টা চালায় একদল দুষ্কৃতকারী। এই ঘটনার মূল হোতা ছিলেন সৌদি আরবের নাজদ অঞ্চলের প্রভাবশালী পরিবারের সদস্য জুহাইমান আল-ওতাইবি। তিনি হঠাৎ করেই তার শ্যালক মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ আল-কাহতানিকে ‘ইমাম মাহদি’ হিসেবে ঘোষণা করে বসেন। জুহাইমানের সঙ্গে কাহতানির দেখা হয় এক জেলে বন্দি থাকা অবস্থায়। জুহাইমান তাকে সেখানে বলল, ‘আল্লাহ তো আমাকে স্বপ্নে দেখিয়েছেন তুমি হলে মাহদি।’ এরপর শুরু হয় ব্রেইনওয়াশ করা। এক পর্যায়ে কাহতানি নিজেই বিশ্বাস করা শুরু করে যে, সে নিজেই মাহদি।

জুহাইমান এবং তার কিছু অনুসারীর পরিকল্পনা ছিল সৌদি আরবের সৌদ পরিবারকে হটিয়ে নতুন শাসনতন্ত্র কায়েম করা। পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রচারণা চালাতে গিয়ে একবার তারা ধরা পড়েছিল ঠিকই, কিন্তু ১৯৭৮ সালে ছাড়া পেয়ে যায় তারা। এরপর তারা অনেক অনুসারীও জোগাড় করতে সক্ষম হয় এবং বেশ কয়েকজন ধনী ব্যক্তির সহযোগিতায় এই গ্রুপটি সশস্ত্র এবং শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

২০ নভেম্বর ফজরের সময় মসজিদুল হারামের ইমাম মুহাম্মাদ আল সুবাইল যখন ৫০ হাজার মানুষের ইমামতি করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, ঠিক তখন আলখাল্লার নিচ থেকে অস্ত্র বের করে সন্ত্রাসীরা বেশ কয়েকটি গুলি ছোড়ে।

ইমামের মাইক্রোফোন নিয়ে জুহাইমান সৌদি সরকারের দুর্নীতি নিয়ে বক্তব্য শুরু করে এবং কিছু হাদিস আর ভবিষ্যদ্বাণী শুনিয়ে ‘ইমাম মাহদি’কে পরিচয় করিয়ে দেয়। এখানেই গলদ ছিল তার। ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, ইমাম মাহদি নিজে রাজি হওয়ার কথা নয় নেতৃত্ব নিতে, কিন্তু এক্ষেত্রে তিনি নিজেই রাজি! কয়েকজন নারীসহ সন্ত্রাসী দলটিতে ছিল প্রায় ৪০০-৫০০ জন। সন্ত্রাসীরা অনেক বন্দিকে ছেড়ে দেয় বটে, কিন্তু অনেককে আটকে রাখে। মসজিদের মিনারে মিনারে অবস্থান নেয় প্রশিক্ষিত ‘স্নাইপার’।

সৌদি প্রিন্স ফাহাদ তখন তিউনিসিয়াতে মিটিংয়ে ছিলেন, আর ন্যাশনাল গার্ডের প্রধান প্রিন্স আব্দুল্লাহ ছিলেন মরক্কোতে। তাই কিং খালিদ এই মিশনের দায়িত্ব দিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রিন্স সুলতানের ওপর। প্রাথমিক অবস্থায় একশ পুলিশ মসজিদ পুনরুদ্ধার করতে গিয়ে বেশ কয়েকজন প্রাণ হারায়। পরে সৌদি আর্মি আর ন্যাশনাল গার্ড যোগ দেয় তাদের সঙ্গে। এক পর্যায়ে সৌদি সরকারের আহ্বানে পাকিস্তান আর্মির একটি স্পেশাল ফোর্সও অভিযানে অংশ নেয়। অভিযানের অংশ হিসেবে রাতের মধ্যে পুরো মক্কা খালি করে ফেলা হয়। কাবা প্রাঙ্গণে রক্তপাত নিষিদ্ধ হওয়ায় কীভাবে অভিযান পরিচালনা করা হবে তা নিয়েও বিতর্ক সৃষ্টি হয়।

শেষ পর্যন্ত আর্মিকে গোলাগুলির নির্দেশ দেওয়া হয়। এদিকে, তিন ফ্রেঞ্চ কমান্ডোকেও মক্কায় আনা হয়েছিল। কিন্তু অমুসলিম হওয়ায় তারা মক্কায় প্রবেশ করতে পারছিলেন না। তাই সাময়িকভাবে তারা ধর্মান্তরিত হন। সেনাদের মিলিত অভিযানে বিভিন্ন উপায়ে সন্ত্রাসীরা নিজের অবস্থান ছেড়ে খোলা স্থানে আসতে বাধ্য হয়। এরপর সব পানির পাইপ খুলে দেওয়া হয় যেন কাবার ভেতরে বন্যার মতো হয়ে যায়। সন্ত্রাসীরা পানিতে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় পানির মধ্যে বৈদ্যুতিক সংযোগ ঘটানো হয়। আর বাকিদের টিয়ার গ্যাস ছুড়ে কাবু করা হয়।

দুই সপ্তাহ পর, বেঁচে থাকা অবশিষ্ট সন্ত্রাসীরা আত্মসমর্পণ করে। এ ঘটনায় মারা যায় ২৫৫ জন আর ৫৬০ জন আহত হয়। তথাকথিত ইমাম মাহদিও সেই ঘটনায় নিহত হয়। ৬৭ অনুসারীসহ গ্রেপ্তার করা হয় জুহাইমানকে। তাদের সবাইকে পরে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

১৯৮৭ সালে মক্কায় সংঘর্ষ

১৯৮৭ সালের ৩১ জুলাই ইরানি হাজিরা ইসরায়েল ও আমেরিকাবিরোধী একটি বার্ষিক বিক্ষোভ করছিল মক্কায়। কিন্তু সৌদি পুলিশ আর ন্যাশনাল গার্ড তাদের বাধা দেয় এবং রূপ নেয় সংঘর্ষে। এই সংঘর্ষের ফলে জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে হুড়োহুড়ি শুরু হয়। এই ঘটনায় ২৭৫ জন ইরানি হাজি ছাড়াও প্রাণ হারায় ৮৫ জন সৌদি পুলিশ এবং অন্য দেশের ৪২ হাজি। ইতিহাসে এই সংঘর্ষ শিয়া হাজি বনাম সৌদি পুলিশের সংঘর্ষ নামে পরিচিত। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে একে অপরকে দোষারোপ করে সৌদি আরব ও ইরান।

Bootstrap Image Preview