Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ০২ বৃহস্পতিবার, মে ২০২৪ | ১৯ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

রক্তের দাগ শুকায়নি, ক্ষোভে ফুঁসছে অমৃতসর

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ২১ অক্টোবর ২০১৮, ০৫:৫১ PM
আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০১৮, ০৫:৫১ PM

bdmorning Image Preview
সংগৃহীত ছবি


রাবণ দহনের ভিড় চিরে ট্রেন ছুটে যাওয়ার ভয়াবহ স্মৃতি দগদগে হয়ে রয়েছে গোটা এলাকা জুড়ে। এখনও রক্তের দাগ শুকায়নি। রক্ত লেগে রয়েছে এক নম্বর লাইনের ইস্পাতে, ফিসপ্লেটে, পাথরের খাঁজে। কিন্তু এত বড় একটি ঘটনার দায় রেল কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় প্রশাসন কেউই নিতে চাচ্ছে না। আর এ কারণেই ভারতের অমৃতসরের আমজনতার মধ্যে ক্ষোভ জমছে; যেকোনো সময় এর বহি:প্রকাশ ঘটতে পারে।

অমৃতসরে জোড়া ফটকের কাছে ধোবিঘাট মাঠে রাবণ দহনের আয়োজন করেছিলেন স্থানীয় কংগ্রেস কাউন্সিলর সৌরভ মিঠ্ঠু। যা দেখতে মানুষ ভিড় জমান ছোট্ট মাঠটিতে। ভি়ড় ক্রমশ মাঠ ছাপিয়ে উঠে পড়ে পাশের রেললাইনে। রেলের জমি উঁচু। তাই ভিড় বাড়ছিল তিনটে লাইন জুড়ে। 

সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ নাগাদ দু’নম্বর লাইন দিয়ে ধীরে ধীরে চলে যায় হাওড়ামুখী অমৃতসর এক্সপ্রেস। কোনও অঘটন ছাড়াই। মিনিট দেড়েক পর আগুন লাগে রাবণে। বাজির প্রবল আওয়াজ। আলোয় ধাঁধিয়ে যাচ্ছিল নজর। 

৬টা ৪৮-এ এক নম্বর লাইন দিয়ে ধেয়ে আসে একটি ডেমু ট্রেন। গতি ঘণ্টায় ৯১ কিলোমিটারের কাছাকাছি। ভিড় চিরে ছুটে চলে যায় সেটি, ছিন্নভিন্ন হয়ে যান বহু মানুষ। 

রাবণ তখনও জ্বলছে, সশব্দে। কিন্তু মানুষের আর্তনাদ, হাহাকার ছাপিয়ে যায় সেই শব্দ। 

রামকিষেণ ছিলেন দুই লাইনের মাঝখানে। তার কথায়, দু’নম্বর দিয়ে অমৃতসর এক্সপ্রেস চলে যেতেই সকলে ভেবেছিলাম ওই লাইন চালু আছে। এতে অনেকে এক নম্বর লাইনের দিকে আরও এগিয়ে যান। এরই মধ্যে আগুন লাগে রাবণে। বাজির শব্দ আর আলোর ঝলকানির মধ্যে ছুটে আসে ডেমু। দুই লাইনের মাঝে থাকায় হাওয়ার ঝাপটায় পড়ে যাই। চোখ খুলে দেখি ১ নম্বরে যাঁরা বসে বা দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁরা কচুকাটা হয়ে পড়ে রয়েছেন। শরীর এক দিকে তো মাথা আরেকদিকে।

প্রত্যক্ষদর্শী বলজিৎ সিংহ বলেন, বড়দের মুখে শুনেছি, ৭১ বছর আগে লাহোর থেকে আসা ব্লাড ট্রেনে এভাবে ছিন্নভিন্ন শরীর পড়ে ছিল। কাল রাতে যেন সেই ছবিটা দেখলাম লাইন জুড়ে।

গুরু নানক হাসপাতালে স্বেচ্ছাশ্রম দিতে আসা সরকারি কর্মী জানালেন, এক বাবা ছেলের মাথা খুঁজে পেয়েছেন। বাকি শরীর কোথায় তা খুঁজে চলেছেন হন্যে হয়ে।

ঘটনার এক দিন পরেও সরকারি হিসেবে মৃতের সংখ্যা ৬১। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, মারা গেছেন ১০০ জনের বেশি। মুখ্যমন্ত্রী অমরেন্দ্র সিংহ আজ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ের তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। যদিও গতকালের এই ঘটনায় পুলিশ-প্রশাসনের বিরুদ্ধেই আঙুল তুলছেন অনেকে। সেই ক্ষোভ সামাল দিতে আজ গোটা এলাকায় প্রচুর পুলিশ নামালেও গতকালের অব্যবস্থার কোনও দায় নিচ্ছে না রাজ্য প্রশাসন। 

রেল নিজেদের মতো তদন্ত শুরু করেছে। তবে তা রেল নিরাপত্তা কমিশনের তদন্ত নয়। ডেমু চালকের কোনও দোষ দেখছে না তারা। রেল প্রতিমন্ত্রী মনোজ সিনহার বক্তব্য, রেললাইনের ধারে এমন অনুষ্ঠানের আয়োজন করাই উচিত নয়। রেলের পক্ষে এফআইআরও করা হয়েছে। অভিযোগ, রেলের জমিতে অনধিকার প্রবেশ করেছিলেন স্থানীয়রা। 

আর এই দশানন দহনের আয়োজক কংগ্রেস নেতা মিঠ্ঠু কাল থেকেই নিখোঁজ। এসব দেখে স্থানীয়দের অভিযোগ, দায় এড়ানোর প্রতিযোগিতা চলছে।

মূলত পাঁচটি প্রশ্ন তুলছেন তারা। 

প্রশ্ন এক, রেললাইন ঘেঁষা ওই জমিতে রাবণ পোড়ানোর অনুমতি কে দিয়েছিল? পুলিশই অনুমতি দিয়েছিল। কিন্তু ছাড়পত্র ছিল না পৌরসভা বা দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের। আর জেলা প্রশাসন পরোক্ষে মেনে নিয়েছে মিঠ্ঠু কোনও অনুমতির তোয়াক্কা করেননি।  

প্রশ্ন দুই, উদ্যোক্তাদের দায় কতটা? ভিড় যে মাঠ ছাপিয়ে লাইনে পৌঁছবে তা খুব ভাল করেই জানতেন উদ্যোক্তারা। লাইনে বসে যাতে দেখতে অসুবিধা না হয়, তার জন্য রাবণ পোড়ানোর লাইভ কভারেজ হচ্ছিল দু’টি এলইডি স্ক্রিনে। যার অর্থ লাইনে বসে দেখার জন্য মানুষকে কার্যত প্ররোচনা দেওয়া হয়েছিল। কয়েক হাজার লোক উপস্থিত ছিলেন দশানন দহনে। 

প্রশ্ন তিন, রেল কি জানত না ভিড়ের বিষয়ে? স্থানীয় রেল প্রশাসনকে কোনোভাবেই সতর্ক করা হয়নি বলে দাবি করেছে রেল। রেল বোর্ডের চেয়ারম্যান অশ্বিনী লোহানির কথায়, অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। উপরন্তু ওই এলাকায় বাঁক থাকায় সম্ভবত শেষ মুহূর্তে লাইনে থাকা ভিড়কে দেখতে পান চালক। হর্নও দেন শেষ মুহূর্তে। ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে।ফিরোজপুরের ডিআরএম বিবেক কুমারেরও বক্তব্য, বাঁক পেরিয়ে শেষ মুহর্তে ভিড় দেখে চালক ৯১ কিলোমিটার থেকে গতি ৬৮-তে নামিয়ে আনেন। কিন্তু ট্রেন থামাতে সময় লাগে।

প্রশ্ন চার, জোড়া ফটক লেভেল ক্রসিং-র দায়িত্বে থাকা গেটম্যান কী করছিলেন? ঘটনাস্থল থেকে ১৫০ মিটার দূরে দাঁড়িয়ে তিনি যখন দেখছেন লাইনে এত ভিড় জমেছে, তখন কেন তিনি তড়িঘড়ি কোনও উপযুক্ত ব্যবস্থা নেননি। রেল কর্মকর্তাদের একাংশ স্বীকার করে নিচ্ছেন, গেটম্যান একটু সক্রিয় হলেই ওই দুর্ঘটনা এড়ানো যেত। অন্তত এক্সপ্রেস ট্রেনের মতো ডেমু ট্রেনের গতি কম থাকলে এই মাপের দুর্ঘটনা এড়ানো যেত।

প্রশ্ন পাঁচ, কতটা দায়ী ভিআইপি অতিথি? সব জায়গায় ৬টা ১৫ মিনিটে রাবণ দহন শুরু হলেও এখানে তা শুরু হয়েছিল পৌনে সাতটার পরে। কারও কারও ক্ষোভ, স্থানীয় বিধায়ক নভজ্যোৎ সিধুর স্ত্রী নভজ্যোৎ কৌর পৌঁছতে দেরি করাতেই দশানন দহনে দেরি হয়েছে। তিনি সময়ে এলে এই দুর্ঘটনা হয়তো ঘটতই না। অনেকে অবশ্য এমন অভিযোগের মধ্যে রাজনীতির গন্ধ পাচ্ছেন। 

ইতিমধ্যে ক্ষোভের আঁচ বাড়িয়েছে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিও। তাতে দেখা যাচ্ছে, অনুষ্ঠানের অতিথি নভজ্যোৎ কৌরের গলায় প্রচুর মালা। আয়োজকদের কেউ তাঁকে বলছেন, দেখুন ম্যাডাম আপনার জন্য ৫ হাজারের বেশি লোক লাইনের উপরে দাঁড়িয়ে আছে। ৫০০ ট্রেন চলে গেলেও ওরা সরবে না।কিন্তু একটু পরেই দুরন্ত গতিতে ছুটে আসা ট্রেন যে তাদের সরার সময় দেবে না, সেটা কেন কেউ ভাবলেন না? স্বজনহারাদের ক্ষোভ সেটাই।

Bootstrap Image Preview