Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৭ শনিবার, এপ্রিল ২০২৪ | ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যা বলেছে ভারতের গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৫ জানুয়ারী ২০১৯, ১০:৩৪ AM
আপডেট: ১৫ জানুয়ারী ২০১৯, ১০:৩৪ AM

bdmorning Image Preview
সংগৃহীত ছবি


বাংলাদেশে একাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর প্রথম যে বিদেশি সরকারপ্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন, তিনি নরেন্দ্র মোদি। ভোটের ঠিক পরদিন, সোমবার (৩১ ডিসেম্বর) সকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ওই টেলিফোনেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, ভারত ওই নির্বাচনকে সম্পূর্ণ স্বীকৃতি দিচ্ছে এবং নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে যা-ই অভিযোগ উঠুক,সেটাকে কোনও আমল দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করছে না।

নির্বাচনে অভূতপূর্ব বিজয়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী হাসিনাকে অভিনন্দন জানান চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-ও, তবে সেটা নরেন্দ্র মোদি ও শেখ হাসিনার ফোনালাপের কয়েক ঘণ্টা পর। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ঘেঁষা ভারতের দু’টি সীমান্ত রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীরাও শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানাতে ভোলেননি।

এদিকে, ভারতের বিভিন্ন শীর্ষ স্থানীয় স্ট্র্যাটেজিক থিংকট্যাংক বা গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের সাম্প্রতিক নির্বাচন নিয়ে তাদের বিশ্লেষণ ধীরে ধীরে প্রকাশ করতে শুরু করেছে এবং তাদের অভিমত যে ভারতের সরকারি মূল্যায়নের সঙ্গে শতকরা একশো ভাগ মিলছে, তা কিন্তু মোটেও বলা যাবে না।

গত দুসপ্তাহের ভেতরে দিল্লির অন্তত তিনটি প্রথম সারির থিংকট্যাংক বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে তাদের মন্তব্য প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেই নিবন্ধগুলোর সারমর্ম নিচে সংকলন করা হলো—   

ভারতে প্রধানত রিলায়েন্স শিল্পগোষ্ঠীর অর্থায়নে পরিচালিত হয় এই থিংকট্যাংকটি। সরকারের সঙ্গে নানা বিষয়ে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে চলেন তারা— এমনকি  যৌথভাবে আয়োজন করে বহু কর্মসূচিও। এই প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র ফেলো নিরঞ্জন সাহু ওআরএফ  সাইটে যে নিবন্ধটি লিখেছেন, তার শিরোনাম হলো— ‘বাংলাদেশে নির্বাচন:শেখ হাসিনা বিপুল গরিষ্ঠতায় জিতলেন ঠিকই,কিন্তু খোয়ালেন কিছুটা গণতন্ত্রও!’

তিনি ওই নিবন্ধে সরাসরি মন্তব্য করেছেন,‘গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, বৈচিত্র্য আর স্বাধীনতার নিরিখে একাদশ সাধারণ নির্বাচন বাংলাদেশকে নিঃসন্দেহে দরিদ্রতর করেছে।’

নির্বাচনে যেভাবে আওয়ামী লীগ ও তার জোট শরিকরা প্রায় নব্বই শতাংশ আসন জিতেছে, তা বাংলাদেশে মেরুকরণ বা বিভাজনকে (পোলারাইজেশন) আরও  তীব্র করবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।

এমনকি, নজিরবিহীনভাবে একটানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসা ও বিরোধীদের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার ফলে শেখ হাসিনার সরকার আরও বেশি করে স্বেচ্ছাচার ও এক-দলীয় গণতন্ত্রের দিকে ঝুঁকবে বলেও যে অনেক পর্যবেক্ষকই মনে করছেন, সে কথাও উল্লেখ করা হয়েছে ওই নিবন্ধে।

দিল্লির এই থিংকট্যাংকটি ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতায়। কাজেই সরকারি অর্থায়নেই পরিচালিত হয় তাদের কার্যক্রম, যদিও তারা গবেষণা করে স্বাধীনভাবেই। তাদের হোমপেজে ‘বাংলাদেশ সাধারণ নির্বাচন ২০১৮: বিরোধীদের জন্য এরপর কী?’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন লিখেছেন প্রতিষ্ঠানের রিসার্চ ফেলো ও বিশিষ্ট বাংলাদেশ গবেষক  স্ম্রুতি এস পট্টনায়ক।

মিস পট্টনায়ক সেখানে তার দীর্ঘ বিশ্লেষণে লিখেছেন, বাংলাদেশ আজ  পর্যন্ত এমন একটি নির্বাচন কমিশন গড়ে তুলতে পারেনি, যাকে নিরপেক্ষ ও কোনও রাজনৈতিক দলের প্রতি পক্ষপাতশূন্য বলে মনে করা যায়। সেই কমিশনের অধীনে কোনও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে পারে— এটা আসলে কোনও বিরোধী দলই বিশ্বাস করে না।

পাশাপাশি তিনি এই মন্তব্যও করেছেন, ‘শোচনীয় পরাজয়ের পর বিরোধী জোট নতুন নির্বাচনের দাবি জানালেও তার জন্য রাজপথে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলার শক্তি তাদের নেই। তা ছাড়া প্রশ্ন হলো— সরকারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্বই বা দেবেন কে? যদি কামাল হোসেন মনে করেন— নেতৃত্ব দেবেন, সেখানে মাঠের লড়াইয়ে জামায়াতে ইসলামীর সাহায্য নেওয়ার প্রশ্নে তার অবস্থানই-বা কী হবে?’

এই প্রসঙ্গেই মিস পট্টনায়ক পূর্বাভাস করেছেন, ‘আওয়ামী লীগ শাসনামলে যারা উপকৃত হয়েছেন, তাদের নিয়ে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে একটি স্বার্থাণ্বেষী গোষ্ঠী (ভেস্টেড ইন্টারেস্ট গ্রুপ) ইতোমধ্যেই তৈরি হয়ে গেছে। আর সেটাকে ভাঙা বিরোধীদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব হবে।’

‘আর তা ছাড়া উন্নয়ন ও রাজনৈতিক ধারাবাহিকতার (‘উন্নতির ধারা’) একটা নিজস্ব সুবিধা আছেই। এই মুহূর্তে সরকার যে উন্নয়নমুখী ন্যারেটিভ সফলভাবে তুলে ধরেছে, তার বিপরীতে আন্দোলনমুখী রাজনীতি সফল না-ও হতে পারে। ২০১৫ সালে বিরোধীদের আন্দোলনে প্রায় দেড়শো মানুষের মৃত্যুর পর এটাও স্পষ্ট যে, মানুষের আর সহিংসতা হজম করার শক্তি নেই!’

দিল্লির কূটনৈতিক এলাকা চাণক্যপুরীতে অবস্থিত এই থিংকট্যাংকটি তাদের ভাবনাচিন্তায় ‘সেন্টার-রাইট’ (মধ্য-দক্ষিণপন্থী) বলেই পরিচিত। বর্তমান বিজেপি সরকারের আমলে সরকারঘনিষ্ঠ এই গবেষণা কেন্দ্রটির প্রভাব-প্রতিপত্তি অনেক বেড়েছে। বাংলাদেশে ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র ফেলো ড. শ্রীরাধা দত্ত তাদের সাইটে যে নিবন্ধটি লিখেছেন তার শিরোনাম ‘বাংলাদেশ: যেভাবে ফায়দা নিচ্ছে তার অবস্থানগত সুবিধার।’

ওই দীর্ঘ নিবন্ধে ড. দত্ত দেখিয়েছেন, ভারত ও চীন এই দুই এশীয় পরাশক্তির মধ্যে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান থেকে কীভাবে তারা স্ট্র্যাটেজিক সুবিধা আহরণ করতে পারে এবং করছেও। বাংলাদেশ-চীন-মিয়ানমার করিডর রূপায়ণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে এবং বাংলাদেশকে ছাড়া দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে চীনের বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভও যে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, সে কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি।

নিবন্ধে আরও  বলা হয়েছে, ভারত ও চীন যে পরপর তাই শেখ হাসিনার নির্বাচনি সাফল্যের পেছনে জোরালো সমর্থন জানিয়েছে, তা একেবারেই অপ্রত্যাশিত নয়। ২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচনে না এসে আওয়ামী লীগকে কার্যত ‘ওয়াক-ওভার’ দিলেও এবারে তাদের শোচনীয় পরাজয়ের জন্য দায়ী যে একমাত্র তারাই, সে কথাও বলেছেন শ্রীরাধা দত্ত।

‘শেখ হাসিনার অসহিষ্ণুতায় ও প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে দমন করার পন্থায় বিরোধী দল নিজেদের একেবারে কোণঠাসা করে ফেলেছিল। কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বা নতুন বিরোধী জোট গড়ার চেষ্টাও এসেছে অনেক দেরিতে, আর তা যথেষ্ঠও ছিল না। আওয়ামী লীগের পোড়খাওয়া প্রার্থীদের বিরুদ্ধে তাদের সম্ভাবনা ছিল না বললেই চলে, আর  তারা কোনও গ্রহণযোগ্য বিকল্প নেতৃত্বও তুলে ধরতে পারেনি।

শ্রীরাধা দত্ত অবশ্য এর পরও উপসংহারে লিখেছেন ‘নির্বাচনি রায় নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে’। তবে বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সংকটের পটভূমিতে শেখ হাসিনাই যে একমাত্র স্থিতিশীলতার প্রতীক ও ভারতের জন্য সেরা বাজি’ সে কথাও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।

ফলে এক কথায় বলা যেতে পারে, বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে ভারতের বিভিন্ন থিংকট্যাংকের মূল্যায়নে কিছুটা সংশয় ও আশঙ্কার বীজ নিহিত থাকলেও শেখ হাসিনাই যে সে দেশের ভবিষ্যৎ এবং বিরোধীদের মধ্যে তারা আশু কোনও সম্ভাবনা দেখছেন না, সেটা মোটামুটি পরিষ্কার।

Bootstrap Image Preview