Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৭ শনিবার, এপ্রিল ২০২৪ | ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

যে কারণে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় অনন্য

শাকিল নিয়াজ, খুবি প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ১৭ অক্টোবর ২০১৮, ১২:২৩ PM
আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০১৮, ১২:৩৮ PM

bdmorning Image Preview


"স্বপ্ন যখন আকাশ ছোয়ার" কিন্তু এই স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে কয়জন বা পারে সেটা ছুয়ে দেখতে? আমরা সবাই সফল হতে চাই, তবে সফল হতে পারি ক’জন? আর যারা এই স্বপ্নকে ছুয়ে দেখতে পারে তারাই আসল স্বপ্নবাজ;তারাই স্বপ্নেরসারথী। সদ্য কলেজ গন্ডী পার করে আসা তরুণ শিক্ষার্থীরা দিনকে রাত- রাতকে টেনে আরও দীর্ঘ দেয় - যার একমাত্র লক্ষ্য থাকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সারথী হওয়ার। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে বিশ্ব ঐতিহ্যের 'ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট' সুন্দরবন আধ্যুষিত বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম।

যেসব ৭ কারণে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় অনন্যঃ

১. রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাসঃ 

বাংলাদেশের একমাত্র সেশনজট,সন্ত্রাস ও ছাত্ররাজনীতি মুক্ত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। ২৭বছরে প্রতিষ্ঠানটি রাজনৈতিক কোনো সহিংসতায় একদিনের জন্য ও বন্ধ থাকেনি। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় এক ভালবাসার নাম, যেখানে ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে স্পর্শ করেনি রাজনীতির  কালো ধোয়া,যেখানে ছাত্র-ছাত্রীদের দুগ্রুপের মধ্যে সংঘাতের কারণে  হঠাৎ করে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে ক্যাম্পাস ছাড়তে হয় না, যেখানে ক্যাম্পাস অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ হওয়ার শংকা থাকে না, ক্যাম্পাসে রাত বিরাতে শিক্ষার্থীরা আপন মনে ঘুরতে পারে।

২। সেশনজটমুক্ত ক্যাম্পাসঃ

বলতে গেলে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে এই দিক থেকে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় অনন্য ও অসাধারণ। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ক্যালেন্ডার( ক্লাস রুটিন, সিলেবাস, পরীক্ষার সময়সূচি) অনুযায়ী সবকিছু পরিচালিত হয়। যতই সহিংসতা হরতাল-অবরোধ হোক না কেন প্রতিবছর পহেলা জানুযারী থেকে ক্লাস শুরু হয়ে একত্রিশ ডিসেম্বরের ভিতরে বছরের দুইটা সেমিস্টার সম্পন্ন হয়। নির্ধারিত ৪ বছরের ভিতর অনার্স ডিগ্রী শেষ হওয়ার মত সুযোগ কে বা হাত ছাড়া করতে চাইবে।

৩। একাডেমিক ও চাকরির সুবিধাঃ

বিশ্ববিদ্যালয়ের  ব্যবসায় প্রসাশন , আর্কিটেকচার , হিউমান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট , সি.এস.ই, ই.সি.ই, ফার্মেসি এর মত বহুল আকাঙ্ক্ষিত এবং পরিচিত বিষয় যেমন আছে তেমনি প্রিন্ট মেকিং, আইন, ফরেস্ট্রি এন্ড উড টেকনোলজি, এগ্রো টেকনোলজি, হিস্টোরি এন্ড সিভিলাইজেশন এর মত অন্য ধরণের বিষয় ও আছে পড়ার জন্য। প্রতিটি ডিসিপ্লিন এ শেষ বর্ষের ছাত্র-ছাত্রীদের দেয় থিসিস করার সুযোগ। শুধু তাই না, ল্যাব এবং ক্লাসরুমে হাতে কলমে শেখার অবাধ সুযোগের পাশাপাশি মনোরঞ্জনের জন্য দেশ-বিদেশে সেশনাল ট্যুরের ব্যবস্থা তো রয়েছেই। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা গুগল কিংবা মাইক্রোসফটে চাকরি পেলে দেশের প্রথম সারীর সবগুলা পত্রিকার হেডলাইনে চলে আসে।

অথচ অনেকেই জানেন না বাংলাদেশে গুগলের প্রচার ও প্রসার হয়েছে যার হাত ধরে সে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়েরই একজন গ্রেজুয়েট। গুগল, মাইক্রোসফট, ও ইনটেল এর মত বড় বড় কোম্পানিতে স্ব-গৌরবে কাজ করছে এখানকার সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়াররা। জানা যায়, খুবির অন্তত ২০-২৫ জনের মত গ্রাজুয়েট আছেন যারা বর্তমানে গুগল ও মাইক্রোসফটে সিনিয়ার সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করছে।

৪। দেশের প্রথমঃ

 - বাংলাদেশে প্রথম ব্যবসায় প্রশাসন ডিসিপ্লিন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু করা হয়। দেশের প্রথম বিবিএ ডিগ্রীও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রদান করা হয়। ১৯৯৫ সাল থেকে বাংলাদেশ নৌ-কর্মকর্তাদের জন্য নিয়মিত ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণ কর্মসূচী থেকে এই প্রতিশ্রুতি আরো মূর্তমান হয়ে উঠে।

- বুয়েটের পর প্রথম কম্পিউটার বিজ্ঞান ও কৌশল ডিসিপ্লিন (বাংলাদেশে ২য়) এবং আর্কিটেকচার ডিসিপ্লিন (বাংলাদেশে ২য়) খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়েই চালু করা হয় (১৯৯১ সালে)।

 - বাংলাদেশে প্রথম ফরেষ্ট্রি এন্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু করা হয়।

- উপমহাদেশের প্রথম বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং ডিসিপ্লিন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু করা হয়।

- বাংলাদেশে প্রথম এনভারেনমেন্টাল সাইন্স ডিসিপ্লিন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু করা হয়।

- বাংলাদেশে প্রথম ইলেক্ট্রনিক্স এন্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং ডিসিপ্লিন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু করা হয়।

- বাংলাদেশে স্নাতক পর্যায়ে হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট (এইচআরএম) ডিসিপ্লিন চালু করা খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

- বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে বুয়েটের পরই ১৯৯৭-৯৮ শিক্ষাবর্ষ থেকে এখানে কোর্স ক্রেডিট পদ্ধতি চালু করা হয় এবং প্রথম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় সিজিপিএ সিস্টেম চালু করে।

- আন্তঃডিসিপ্লিন ক্রিকেটে বাংলাদেশে প্রথম ভিডিও রেকর্ড করে থার্ড আম্পায়ারের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত দেয়া হয় খুবিতে।


৫। প্রাণের সংঘঠনঃ

নেতৃত্ব ও মনন চিন্তা বিকাশের জন্য প্রায় ২৫ টির মত সংগঠন ক্যাম্পাসে চঞ্চলতা বাড়িয়ে দেয়। যেখানে 'ওঙ্কার-শৃনুতা' আবেগ্ময়ী বাক্যের দ্বারা পরিবেশ রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, সেখান থেকেই   'ণৃ-নাট্য' দল নিপুন অভিনয়ের মাধ্যমে তুলে ধরছে সমাজের বাস্তবতা। এ যেন এক সৃষ্টির নতুন কারিগর।

লালন আর লোকগানের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক মনের শিক্ষার্থীরা  মিলে হয়েছে ‘সাধু সংঘ’। মেটালফ্রিক ছেলেমেয়েরা আড্ডায় মাতিয়ে তুলেছে প্রতিদিনের ‘নয়েজ ফ্যাক্টোরি’।  ‘ছায়াবৃত্ত’ কাজ করছে  বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতর ও বাইরের ছোট ছোট ছেলেমেয়ে যাদের কেউ হয়ত ভ্যান চালায়, কেউ দোকানে কাজ করে, কেউ বা ফেরী করে তাদের মাঝে ছায়ার মতো হয়ে। ‘নৈয়ায়িক’ প্রতিষ্ঠিত হয়  কথা ও যুক্তি তর্কের মাধ্যমে, যার  অর্জন আন্তঃ বিশ্ববিদ্যালয়ের 'শ্রেষ্ঠত্ব'। নাচ দিয়ে সুর তুলে মাতিয়ে রাখে প্রত্যেক প্রোগ্রামে সংগঠন ‘স্পার্ক’ আর ‘রিদম’। ক্যামেরায় বন্দি করে ভালবাসার ক্যাম্পাসকে ও মনের মানুষকে যারা তাদের নিয়ে ‘খুলনা ইউনিভার্সিটি ফটোগ্রাফিক সোসাইটি’। রাত-দিন একাকার পুরো খুলনাবাসীকে রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ রেখে হৃদত্বা বাড়িয়ে চলেছে "বাধন"।


৬। সৌন্দর্য্য ও চঞ্চলতার ক্যাম্পাসঃ

বহমান নদীরধারা সচল রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দিয়ে তিনটি আবাসিক হলের চঞ্চলতা একধারায় বহন করে প্রকৃতির রূপ ধরে রেখে "ময়ূর লেক" । মুক্তিযুদ্ধের ও স্বাধীনতার আবেগকে বাড়িয়ে দিয়েছে "অদম্য বাংলা" ও " বধ্যভূমি"র  সৌন্দর্য্য । হিম হিম শীতের সকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃতি যেন জীবনান্দদাসের সেই কল্পনার সমস্ত বাংলার রূপ ধারন করে যার প্রফুল্লতা  মদ্য পানে মাতালকেও ছাড়িয়ে যায়। খুবি’র প্রধান রাস্তাটি ধরে সামনে এগিয়ে গেলে ডান দিকে চোখে পরবে খুবিয়ান’দের আড্ডা দেবার প্রথম স্থান ‘ক্যাফেটেরিয়া’।

এর ঠিক উল্টো পাশেই রয়েছে ‘মুক্তমঞ্চ’ এবং ‘শহীদ মিনার’ ।  ক্লাসের ফাঁকে "ভাবীর দোকানে"র চায়ের আড্ডা, "তপন দাদা"র সেই এক এক পুরী যেন এক একটি ইতিহাস। বিকেল পাঁচটায় যখন ক্লাস শেষ, শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস ছুটে চলে অন্তিমপথে। এমন সময় ক্যাম্পাস সূর্য্যিমামার লাল আভায় ডুবতে শুরু করে, ঠিক তখনই দাঁড়িয়ে থাকা সোডিয়াম লাইটগুলো মিটি আলো দিতে শুরু করে- এ যেন এক প্রাণের সঞ্চার।

গোধূলি লগ্নে বেড়িয়ে প্রেমিক-প্রেমিকা,বসে যায় "অনিকেত প্রান্তরে"  শত শত স্বপ্ন বেড়িয়ে আসে;দক্ষিনের বাতাসে প্রেমিকের কাঁধে যখন মাথা রাখে প্রেয়সীরা মনে হয় এমন ভাবে যুগ যুগ কাটিয়ে দিতে পারবে তার; প্রেম আসে স্বর্গ থেকে সেটা তাদের দেখলে বোঝা যায়;নির্বান চোখে স্বপ্ন দেখে ঘর বাঁধবার। রাত যত বেড়ে যায় আবাসিক হলগুলোর চঞ্চলতা তত বেড়ে যায়। টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া থেকে আগত শিক্ষার্থীরা এক হয়ে থাকে - বন্ধন আবদ্ধ হয় এক সুতোয়। যা কবি সুনির্মল বসুর "বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র; নানান ভাবে নতুন জিনিস শিখছি দিবারাত্র"- পঙক্তিটির গ্রহনযোগ্যতা বাড়িয়ে দেয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে চঞ্চলতার কেন্দ্র মাঠ যেখানে শিক্ষক -সিনিয়র -জুনিয়ার খেলা করে এক পরিবারের হয়ে। পাশেই রয়েছে খান বাহাদুর আহসানউল্লাহ হলের পুকুর। পুকুরের মিহি পরিবেশে বসে মোস্ট জুনিয়র - ইমিডিয়েট সিনিয়রের মিলন মেলা, যেখানে দিন-রাত একাকার করে সিনিয়র জুনিয়র সম্পর্ক ঝালাই করে নিতে পারে নিদ্বিধায়।

৭। উৎসবের প্রাণঃ

"বার মাসে তের পার্বণ"- কথাটির যৌক্তিকতা হয়তো খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটু বেশী প্রযোজ্য। বাঙালীর ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরে রাখতে বাঙ্গালীপনায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ও কম যায় না। দক্ষিণাঞ্চলের সর্ববৃহৎ পহেলা বৈশাখ উৎসবের সাথে পালন করা হয় এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। সাথে থাকে চৈত্র সংক্রান্তির উৎযাপন( ঘুড়ি উৎসব, লাঠি খেলা, সাপ খেলা, মোরগ লড়াই)। তাছাড়া র‍্যাগ ডে,কালার ফেস্ট, পিঠা উৎসব, বিভিন্ন ডিসিপ্লিনের নবীনদের ববণ উৎসব, দিবস উপলক্ষ্যে ও সংগঠনগুলোর প্রোগাম তো লেগেই থাকে সারা বছর।


সর্বোপরি, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় একটি হৃদস্পন্দনের কেন্দ্র, যেখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর, সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্ক একটি ভালবাসার নাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের  প্রতিটি স্থান হাজারোও গল্পের কারণ, প্রতিটি ঘাসের শীর্ষবিন্দু বহন করে কত স্মৃতি!!

Bootstrap Image Preview