পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দেশ হলেও রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিক দিয়ে বড় থাকতে পারেনি রাশিয়া। ঐতিহাসিক কারণে রাজনীতির সঙ্গে সেখানকার জনগণের সম্পর্ক খুবই দুর্বল। দেশটিতে ধর্মের প্রতি বিশ্বাস বাড়ছে তরুণ প্রজন্মের।
দেশটির দু’টি শহরের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজনীতির প্রতি বিশেষ কোনো আকর্ষণ বোধ করেন না তারা। নিজের কাজের প্রতিই তারা বেশি মনোযোগী। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সেখানকার মানুষের মধ্যে এই প্রবণতা তৈরি হয়েছে।
সোভিয়েত পরবর্তী সমাজ ব্যবস্থায় বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম রাজনীতি থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। নিজের কাজ ছেড়ে রাজনীতি নিয়ে ভাবনা-চিন্তাকে তারা সময়ের অপচয় বলেই মনে করে।
গ্রামের মানুষ তথা তরুণ প্রজন্মের একটি অংশের মধ্যে ধর্মের প্রতি একটা ঝোঁক রয়েছে। যদিও রাশিয়ায় রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মকে উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হয় না।
১৯৯১ সালে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর রুশ ফেডারেশনের (রাশান ফেডারেশন) মাধ্যমে আলাদা আলাদা রাষ্ট্র গঠিত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্য প্রজাতন্ত্রগুলোও আলাদা আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করে।
১৯১৭ সালে রুশ অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর ১৫টি প্রজাতন্ত্র নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠিত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলেও আয়তনের দিক থেকে রাশিয়া এখনও বিশ্বের সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র।
সোভিয়েত পরবর্তী রাশিয়ার রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পাশাপাশি মানুষের জীবন যাত্রার ওপরেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রভাব এবং পরিবর্তন এসেছে। এর মধ্যে রাজনীতির প্রতি ধীরে ধীরে আগ্রহ কমে যাওয়ার বিষয়টি অন্যতম। আর এই প্রভাব সোভিয়েত পরবর্তী নতুন প্রজন্মের ওপরই বেশি পড়েছে।
রাশিয়ার রাজধানী মস্কো এবং নবভরোনেস শহরের মানুষের সঙ্গে আলাপচারিতায় এ ধরনের তথ্যই উঠে আসে। একটি পরমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পকে কেন্দ্র করে এই নবভরোনেস শহর গড়ে ওঠে। মস্কোর মতই এই শহরের মানুষও সার্বক্ষণিক কর্মব্যস্ত। কর্মক্ষেত্রে রাশিয়ার মানুষের জীবনের গতি অনেকটাই যান্ত্রিক। কর্মক্ষেত্রে তাদের তৎপরতা যন্ত্রের মতই।
এদের প্রাত্যহিক জীবন যাত্রার গতিবিধি দেখে সহজেই এটি উপলব্ধি করা যায়। বাংলাদেশ বা ভারতের মানুষের রাজনৈতিক মাতামাতির সঙ্গে রাশিয়ার মানুষের অবস্থান অনেকটাই বিপরীত। বিশেষ করে সময়ে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতেই এরা অভ্যস্ত। সময় সচেতনতার ব্যাপারে রাশিয়ার মানুষের কোনো জুড়ি নেই।
গত ১২ ডিসেম্বর মস্কোর ঐতিহাসিক রেড স্কোয়ারে ঘোরাঘুরির পর রুশ বিপ্লবের মহানায়ক ভি আই লেনিনের রেপলিকা (মুর্তি) কেনার জন্য কয়েকটি সুভেনির বিক্রয় কেন্দ্রে যাই।
একটি কেন্দ্রের জনৈক বিক্রেতা কিছুটা বিস্মৃত হয়ে আমাদের সঙ্গে থাকা রোসাটমের কর্মকর্তা মাক্সিমের কাছে জানতে চান, আমরা লেনিনের সুভেনিরই খুঁজছি কেন। ম্যাক্সিম তাকে জানালেন, ছাত্র জীবনে সে (আমাকে দেখিয়ে) কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলো।
তখন মধ্যবয়সী ওই ব্যক্তি হেসে এবং মাথা নেড়ে স্বাগত জানান। এর পর লেনিনের সুভেনিরের সঙ্গে স্ট্যালিন, বেজনেভ, গর্ভাচেভ ও রাশিয়ার বর্তমান রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের ছবি দেখান। এ সময় আমি গর্ভাচেভের ছবির বিষয়ে না সূচক মত দিলে তিনি হো হো করে হেসে ওঠেন। আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘ও আই সি’। হাসতে হাসতে আরও বলেন, ‘ইট ইজ পার্ট অব হিস্টোরি।’
রুশ বিপ্লবের মাধ্যমে কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় আসার পর টানা ৭০ বছর টিকে থাকে। ১৯৯১ সালে যখন সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় ঘটে তখন এর নেপথ্যে ছিলেন দেশটির তৎকালীন প্রধান এই মিখাইল গর্ভাচেভ।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আরও একটি বিষয় রাশিয়ার মানুষের ওপর প্রভাব ফেলেছে। সেটা ধর্মের প্রতি এক শ্রেণির মানুষের আগ্রহ বেড়ে যাওয়া। তবে শহরের চেয়ে গ্রামে এই প্রবণতা তুলনামূলক বেশি। সোভিয়েত আমলে সেখানকার মানুষ বস্তুবাদী দর্শন দ্বারা প্রভাবিত ছিলো। বর্তমানে ধর্ম বিশ্বাস কিছুটা বেড়েছে। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের মধ্যে।
পরিবার এবং পারিপার্শ্বিক প্রভাব থেকে নতুন প্রজন্মের একটি অংশ ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। তবে গ্রামের চেয়ে শহরের মানুষের মধ্যে ধর্ম বিশ্বাস কম।
নবভরোনেস শহরে একটি হোটেলের লবিতে স্মোকিং জোনে একজনের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে জানতে চেয়েছিলাম, ধর্ম নিয়ে রাশিয়ার মানুষের ভাবনার বিষয়। তিনি জানান, বর্তমানে ধর্মের প্রতি কিছু মানুষ আকৃষ্ট হচ্ছে। এই লোকদের মধ্যে তরুণদের সংখ্যা বেশি। তবে এদের সংখ্যা শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি। সেটা সোভিয়েত পরবর্তী সময়ে দেখা দেয়।
রাশিয়ায় খ্রিস্টানরাই সংখ্যাগুরু। ইসলাম ও ইহুদি ধর্মের মানুষও এখানে আছে। এখানে বড় দিনের উৎসব অত্যন্ত জাঁকজাকপূর্ণ উপায়ে উদযাপন করা হয়। সপ্তাহব্যাপী এই উৎসব চলে। তবে সেটা সারা বিশ্বের মতো ২৫ ডিসেম্বর নয়, ২ জানুয়ারি থেকে ৮ জানুয়ারি।
১ জানুয়ারি কর্মদিবস থাকে, ২ জানুয়ারি থেকে সাত দিন ছুটি থাকে বড় দিন উদযাপনের জন্য। নতুন বছর ভালো কিছু নিয়ে আসবে এই প্রত্যাশায় বড় দিনের অনুষ্ঠান উদযাপন করা হয়। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই বড় দিন উদযাপনের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। বিভিন্ন স্থানে এই দৃশ্যটি চোখে পড়ে। অফিস, মার্কেট, শপিং মল, হোটেল সবখানেই ক্রিসমাস ট্রি সাজানো হয়