Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ১৩ সোমবার, মে ২০২৪ | ৩০ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

চীনে উইঘুর মুসলিমদের বন্দী করে মগজ ধোলাইয়ের তথ্য ফাঁস

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৬ নভেম্বর ২০১৯, ১০:৫৭ AM
আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৯, ১০:৫৭ AM

bdmorning Image Preview


চীনে কয়েক লাখ উইঘুর মুসলিমকে গোপন বন্দীশালায় আটকে রেখে কীভাবে তাদের মগজ ধোলাই করা হচ্ছে তার কিছু দলিলপত্র সম্প্রতি ফাঁস হয়েছে। তবে পশ্চিমাঞ্চলীয় শিনজিয়াং প্রদেশে এ ধরনের গোপন বন্দীশালার কথা চীন বরাবরই অস্বীকার করে এসেছে। এমনকি চীন বলে থাকে, মুসলিমরা নিজেরাই স্বেচ্ছায় এখানে প্রশিক্ষণ নিতে এসেছে।

তাদের দাবি, এগুলো আসলে প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষা শিবির। কিন্তু অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা আইসিআইজে যেসব ফাঁস হওয়া গোপন দলিলপত্র হাতে পেয়েছে, তাতে দেখা যায় কীভাবে এই উইঘুর মুসলিমদের বন্দী করে মগজ ধোলাই করা হচ্ছে এবং শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।

যুক্তরাজ্যে চীনের রাষ্ট্রদূত অবশ্য বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এসব অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, এটা ভুয়া খবর।

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব শিবিরে ১০ লাখেরও বেশি মুসলিমকে বিনা বিচারে আটক করে রাখা হয়েছে, যাদের বেশির ভাগই উইঘুর সম্প্রদায়ের সদস্য। গোপন বন্দীশালার ছবি বিশ্ব এর আগেও দেখেছে। স্যাটেলাইট থেকে তোলা উঁচু প্রাচীর ঘেরা এসব বন্দী শিবিরের ছবি। শিবিরের ভেতর থেকে তোলা ছবি, যেগুলো গোপনে বাইরে পাচার করা হয়েছে।

বেইজিং দাবি করে, সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় গত তিন বছর ধরে এসব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে, যেখানে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এখন ফাঁস হওয়া দলিলপত্র থেকে পরিষ্কার এসব শিবিরের ভেতরে আসলে কী ঘটছে।

বিবিসির কাছে যেসব দলিল এসেছে, সেগুলো মূলত কীভাবে এই বন্দী শিবির চালাতে হবে তার নির্দেশনা। শিবিরের কর্মকর্তাদের জন্য লেখা এসব নির্দেশাবলী।

শিনজিয়াং কমিউনিস্ট পার্টির ডেপুটি সেক্রেটারি ঝু হাইলুন ২০১৭ সালে ৯ পৃষ্ঠার এই সরকারি দলিল পাঠিয়েছিলেন-যারা এসব শিবির পরিচালনা করেন তাদের কাছে।
এসব নির্দেশনায় স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, এই শিবিরগুলো অত্যন্ত সুরক্ষিত জেলখানার মতো চালাতে হবে, বজায় রাখতে হবে কঠোর শৃঙ্খলা এবং কেউ যাতে সেখান থেকে পালিয়ে যেতে না পারে সেটাও নিশ্চিত করতে হবে।

সরকারের এসব নির্দেশনার মধ্যে ছিল- কখনোই পালানোর সুযোগ দিও না, শৃঙ্খলা এবং শাস্তি বাড়াতে থাকো, কেউ আচরণবিধি ভঙ্গ করলে তাকে কঠোর শাস্তি দাও, স্বীকারোক্তি ও অনুতপ্ত হতে উৎসাহিত করো, ম্যান্ডারিন ভাষা শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দাও, পুরোপুরি বদলে যাওয়ার ব্যাপারে তাদের অনুপ্রাণিত করো, পুরো ভিডিও নজরদারি চালাও, কোনো জায়গা যেন বাদ না থাকে।

এসব দলিলে দেখা গেছে শিবিরে বন্দী উইগারদের জীবনের ওপর কীভাবে নজর রাখা হচ্ছে ও কতটা নিয়ন্ত্রণের ভেতরে তাদেরকে রাখা হয়েছে। যেমন : ‘শিক্ষার্থীদের বিছানা কোথায় কীভাবে থাকবে, কে লাইনের কোথায় দাঁড়াবে, শ্রেণিকক্ষের কোথায় বসবে, কে কী শিখবে-সেগুলো সব নির্ধারিত থাকবে। এগুলো পরিবর্তন করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।’

এসব নির্দেশনায় ঘুম থেকে ওঠা, রোল কল করা, কাপড় ধোওয়া, টয়লেটে যাওয়া, ঘর গুছিয়ে রাখা, খাওয়া দাওয়া, লেখাপড়া, ঘুমানো এমনকি দরজা বন্ধ করার বিষয়েও উল্লেখ করা হয়েছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের একজন মুখপাত্র সোফি রিচার্ডসন বলছেন, এসব দলিল আসলে এমন একটি প্রমাণ যার ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। তিনি বলেন, ‘এটি গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রামাণিক দলিল। এই প্রমাণ এখন থাকা উচিত কোনো বিচারিক তদন্ত কর্মকর্তার ফাইলে।’

যেসব নিষ্ঠুরতার কথা আছে এই দলিলে, তা সাবেক বন্দীরা নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে ভালো করেই জানেন। এরকম একজন ইয়ো জান। তাকে রাতের বেলায় ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এরপর তাকে এক বছর আটকে রাখা হয় বন্দী শিবিরে। তিনি বলেন, ‘ওরা আমাকে উলঙ্গ করে পায়ে শেকল পড়িয়ে দিল। খুবই ভীতিকর অভিজ্ঞতা। ওরা আমাদের মানুষ বলে গণ্য করতো না। সেখান থেকে জীবিত বেরিয়ে আসতে পারব বলে ভাবিনি কখনো।’

ইয়ো জান তার যে অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছেন, সেটা বন্দী শিবিরে আটক আরও লাখো উইঘুর মুসলিমেরই কাহিনি। চীনা সরকার বিদেশি সাংবাদিকদের অবশ্য এসব শিবির ঘুরিয়ে দেখিয়ে দাবি করেছে, সন্ত্রাসবাদ দমনে সাহায্য করছে এসব শিবির। এখানে বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা নতুন দক্ষতা অর্জন করছে।
কিন্তু আইসিআইজের অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা বলছেন, এখন ফাঁস হওয়া দলিলপত্রে বোঝা যায়, এসব শিবিরের আসল উদ্দেশ্য আসলে কী।

বিশ্ব উইঘুর কংগ্রেসের আইনি উপদেষ্টা বেন এমারসন বলেন, চীন এখন বিশ্বের এক বড় পরাশক্তি, কিন্তু তারা নিজের জনগণকে আটকে রাখছে, যতক্ষণ না তারা তাদের বিশ্বাস, ভাষা এবং নিজস্ব জীবনযাত্রা পুরোপুরি বদলে ফেলছে। এটাকে গণহারে মগজ ধোলাই ছাড়া অন্য কিছু ভাবা আসলেই কঠিন। একটি পুরো জাতিগোষ্ঠীকে টার্গেট করে এই কাজ চালানো হচ্ছে।

লন্ডনে চীনের রাষ্ট্রদূত লিও যাও মিং এসব বন্দী শিবিরের ব্যাপারে বিবিসির সরাসরি প্রশ্নের কোনো জবাব দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। কিন্তু এর আগে গত সপ্তাহে তিনি হংকং-এর ব্যাপারে এক সংবাদ সম্মেলন ডেকেছিলেন।

সেখানে বিবিসির সাংবাদিক রিচার্ড বিল্টন তাকে এসব বন্দী শিবির নিয়ে প্রশ্ন করেন। জবাবে রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘প্রথমত বলতে চাই, আপনি যেরকম বর্ণনা দিচ্ছেন, সেরকম কোনো বন্দী শিবির সেখানে নেই। এগুলো আসলে বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। সেখানে তাদের রাখা হয়েছে সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধের জন্য।’

রিচার্ড বিল্টন এরপর পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন, তার মানে তিনি যা দেখে এসেছেন, তা সত্য নয়?

জবাবে চীনা রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আপনি যে তথাকথিত দলিলের কথা বলছেন, সেটা পুরোটাই বানোয়াট। ভুয়া খবরে বিশ্বাস করবেন না। বানানো গল্প শুনবেন না।’

কিন্তু আইসিআইজের সাংবাদিকরা বলছেন, ‘এসব দলিল আসলে মোটেই ভুয়া নয়, এগুলো মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রমাণ। চীন হাজারো মানুষকে খাঁচায় বন্দী করে তাদের মগজ ধোলাই করছে এবং এখন আমরা জানি কীভাবে সেটা করা হচ্ছে।’

Bootstrap Image Preview