Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ১৯ রবিবার, মে ২০২৪ | ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

নুসরাতের সেক্যুলারিজম, মমতার হিজাব ও জায়রার ধর্মীয় মূল্যবোধ

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ১০ জুলাই ২০১৯, ০৮:২৫ PM
আপডেট: ১০ জুলাই ২০১৯, ০৮:২৫ PM

bdmorning Image Preview
সংগৃহীত


ভারতীয় রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ধর্ম নিয়ে আলোচনা নতুন নয়। বরং হালে আরও বেশি প্রশ্ন তুলেছে এই প্রসঙ্গটি। বিশেষ করে সেক্যুলারিজম, সংখ্যাগুরু, সংখ্যালঘু প্রশ্নে ক্ষমতাসীনদের বয়ান নিয়ে নানান ধরনের চর্চা বিদ্যমান। এর সঙ্গে বরাবরই জড়িয়েছিল দেশটির চলচ্চিত্রশিল্পও।

সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায় এই বিষয়ে কথা আরও বেড়েছে। যেমন; কলকাতার নায়িকা-সাংসদ নুসরাত জাহানের শাখা-সিঁদুর পরাকে কেউ কেউ বলছেন সেক্যুলারিজম, বিপরীতেও কথা হচ্ছে। আবার মুসলমানদের হিজাব পরলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু তোষণের অভিযোগ ওঠে। একই সময়ে জায়রা ওয়াসিমের বলিউড ছাড়ার ঘোষণা নিয়েও পরস্পরবিরোধী মন্তব্য পাওয়া যাচ্ছে।

এই নিয়ে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতায় লিখেছেন অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়। লেখাটি পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-

নুসরাত রথ টানলে সেক্যুলারিজম, আর মমতা মাথায় হিজাব দিলেই তোষণ?

তৃণমূল সাংসদ এবং টলিউডের জনপ্রিয় অভিনেত্রী নুসরাাত জাহান সম্প্রতি পাবলিক বিতর্কের কেন্দ্রে। এক রথযাত্রার অনুষ্ঠানে তার উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ ইসলামের অবমাননা হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে অনেকের কাছে। আবার অনেকেই নুসরাতের এই কাজকে ‘সেক্যুলারিজম’-এর প্রকৃত উদাহরণ বলে মনে করছেন। এখন সমস্যা এখানেই যে, এই দুই পরস্পর-বিরোধী বক্তব্যকে একীভূত করে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, সংখ্যাগুরুর লক্ষণগুলিকে যদি সংখ্যালঘু অনুসরণ করে থাকেন, তবেই কি তা এ দেশে ‘সেক্যুলার’ হিসেবে প্রতিভাত হয়। আর সংখ্যাগুরু যদি সংখ্যালঘুর লক্ষণে নিজেকে তুলে ধরেন, তা হলে তা হয়ে দাঁড়ায় ‘তোষণ’ ও ‘ধান্দাবাজি’? একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, খেলাটা খুব সরল নয়।

খেলাটা যেমন খুব সরল নয়, তেমনই বিষয়টাও খুব নতুন কিছু নয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা অন্য কোনো হিন্দু ধর্মাবলম্বী নেতার ইফতার পালন নিয়ে কম হইচই হয় না। মাথায় আচ্ছাদন দিয়ে মমতার ছবি অথবা ফেজ টুপি পরে মোনাজাতরত অবস্থায় সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে ট্রোল অতি কমন ব্যাপার। এই সব ছবি দিয়েই সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘সংখ্যালঘু তোষণ’-এর উদাহরণ প্রদান করা হয়ে থাকে। কিন্তু রথযাত্রায় নুসরাতের অংশ নেওয়ার ব্যাপারটা ঠিক এর বিপরীত তকমা প্রাপ্ত হয়েছে। সিঁদুর পরিহিতা নুসরাতের রথযাত্রায় অংশগ্রহণকে ‘প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতা’র লক্ষণ বলে চিহ্নিত করছেন নেটিজেনরা। আর এখানেই বাঁধছে গোল। যে কারণে মমতা বা অন্যরা নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে সমালোচিত হয়ে থাকেন, সেই একই কারণে নুসরাত কী করে প্রশংসিত হতে পারেন— এই নিয়ে বিস্তর ধন্ধে পড়েছেন অনেকেই। কিছুদিন আগে সাংসদ হিসেবে শপথ গ্রহণের সময়ে শাঁখা-সিঁদুর পরিহিতা ‘হিন্দু নারী’র বেশে নুসরাতের উপস্থিতি ও ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনি উচ্চারণের ব্যাপারটা নিয়েও সরব হয়েছিলেন নেটিজেনরা, সরব হয়েছিল বেশ কিছু মিডিয়াও। ‘প্রকৃত সেক্যুলারের এমনটাই হওয়া উচিত’—এই মর্মে ঢাক পেটানো শুরু হয়েছিল। রথযাত্রা সেই ঢাকে কাঁসির সংগত যুক্ত করল— এ কথা বলা যেতেই পারে।

তা হলে সেই চিরকেলে প্রশ্নটাই কি আবার উঠছে— ভারতে ‘সেক্যুলারিজম’ বস্তুটা আসলে সংখ্যাগুরুর দিকেই পাল্লা ভারী রাখে। নিজেকে সেক্যুলার হিসেবে প্রমাণ করতে গেলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুকে হিন্দু বা হিন্দুত্ববাদী লক্ষণগুলোর খাপে নিজেকে ফেলতে হবে। আর সংখ্যাগুরুকেও সচেতন থাকতে হবে, সংখ্যালঘুর লক্ষণে নিজেকে হাজির করা মানে ভোট ব্যাংক বাড়ানোর কৌশল— এই সমালোচনা উড়ে আসতে পারে যখন-তখন? ব্যাপারটা ক্লিশে। কিন্তু একে এড়ানো যায় না কিছুতেই।

সেক্যুলারিজম বিষয়টা সবসময়েই ‘আশ্রয়ের রাজনীতি’র সঙ্গে পৃক্ত। এখানে মনে হতেই পারে, সংখ্যালঘুর প্রতিনিধি নুসরাত সিঁদুর ইত্যাদি সংখ্যাগুরু-চিহ্ন ধারণ করে এবং রথযাত্রার মতো সংখ্যাগুরুর উৎসবে অংশ নিয়ে আশ্রয় প্রার্থনা করছেন সংখ্যাগুরুর সমাজে। মজার ব্যাপার, নুসরাতের এই কাজগুলিকে বাহবা দিয়েছেন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের চেনামুখ সাধ্বী প্রাচী। তার মতে, নুসরাতের হিন্দু বিবাহ ও এই সব লক্ষণ ধারণ তার হিন্দু সমাজের অঙ্গীভূত হওয়াকেই বোঝায়। অথচ এই সব কিছুকেই নুসরাতের ব্যক্তিগত অভিরুচি বলেও মেনে নেওয়া যেত। কিন্তু গেল না। কারণ, নুসরাত সাংসদ হয়ে নিজেকে রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত করে ফেলেছেন, সেখানে তার প্রতিটা কাজই ‘রাজনৈতিক’। তার প্রতিটি পদক্ষেপেরই রাজনৈতিক ব্যাখ্যা হতে থাকবে। বলা যেতেই পারে, এখানে খেলা করছে ‘আশ্রয়ের রাজনীতি’। নুসরাত এখানে এক ক্ষমতাবান ও বৃহতের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছেন এবং সেই বৃহৎ ও ক্ষমতাবান তাকে গ্রহণ করছেন। ক্ষমতাবান এখানে ‘হোস্ট’, নুসরাত নেহাতই অতিথি মাত্র। তলিয়ে দেখলে মনে হতেই পারে, সাধ্বী প্রাচী এখানে ‘হোস্ট’-এর ভূমকায় অবতীর্ণ। তিনি যেন তার গৃহে আশ্রয় দিচ্ছেন নুসরাতকে। শর্ত একটাই— তার গৃহে তার মতো করে বাস করতে হবে।

এই প্রসঙ্গে মনে পড়তেই পারে কমল হাসান পরিচালিত ও অভিনীত ছবি ‘চাচি ৪২০’ (১৯৯৭)-এর কথা। এই ছবিতে এক রক্ষণশীল হিন্দু পরিবারে ব্রাহ্মণ পাচকের ছদ্মবেশে অবস্থান করছিলেন এক মুসলমান বাবুর্চি। ধরা পড়ে যাওয়ার পরে কর্তা তাকে নিদান দিলেন, তার বাড়িতে থাকতে হলে তার মতো করেই থাকতে হবে। অর্থাৎ হিন্দু বিধি পালন করতে হবে। বাবুর্চি তাতেই সম্মত হন। কারণ, চাকরি হারালে তার চলবে না। ইহাকেও খেয়ে-পরে বাঁচতে হবে। বৃহৎ ও ক্ষমতাবানের কাছে তার আত্মসমর্পণ অনিবার্য। এ ভাবেই ক্রমে সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘুকে, বড় রাষ্ট্র ছোট রাষ্ট্রকে, তার হাতায় নিয়ে আসে। আর ক্ষমতাহীন ক্রমে হয়ে পড়ে ক্ষমতাবানের ছায়ায় লালিত এক সত্তা। সে নিজেকে হারায়। তার আত্মা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।

সম্প্রতি আর এক ঘটনা ঘটেছে। বলিউডের নজরকাড়া কিশোরী অভিনেত্রী জায়রা ওয়াসিম জানিয়েছেন, তিনি সিনেমা জগৎ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করছেন। আমির খান প্রযোজিত নীতেশ তিওয়ারি পরিচালিত ‘দঙ্গল’ (২০১৬) ছবিতে অভিনয়ের জন্য বিপুল প্রশংসা পেয়েছিলেন জায়রা। পরে ‘সিক্রেট সুপারস্টার’ (২০১৭)-এ অভিনয়-সূত্রে এক নামজাদা বেসরকারি পুরস্কারও পান। কিন্তু তার পরে কী এমন ঘটল যে, তিনি তার ফিল্মি ক্যারিয়ারে ছেদ টানতে চাইলেন? জায়রা এক দীর্ঘ ফেসবুক-বার্তায় জানিয়েছেন, বলিউডের পরিমণ্ডল, ফিলম জগতের পরিবেশ তার ধর্ম ও বিশ্বাসের পক্ষে অনুকূল নয়। সেই কারণেই তিনি তার ফিল্ম ক্যারিয়ারে ছেদ টানছেন। জায়রা জানিয়েছেন, গত পাঁচ বছর ধরে তাঁকে অন্য কেউ হয়ে উঠতে হয়েছে, যা তিনি নন। কথাটা ভাবার মতো। এই ‘অন্য কেউ’টা কে? জায়রা একা নন, বলিউড এমনই এক ক্ষেত্র যা প্রতিটি মানুষকেই বেরিয়ে আসতে বাধ্য করে তার নিজস্ব অবস্থান থেকে। জায়রার মতে, এখানে তার ধর্ম ও বিশ্বাস ব্যাহত হচ্ছে। হতেই পারে। তার আদিকাল থেকেই বলিউড নিজের বুকে লালন করেছে হিন্দুত্ব। সুধীর কাকর, আশিস রাজ্যাধ্যক্ষ প্রমুখের গবেষণা অন্তত সেই কথাই বলে। সেখানে এক ইসলাম ধর্মাবলম্বী কিশোরী যদি নিজের অস্তিত্বকে বিপন্ন বলে মনে করেন, সে ক্ষেত্রে কিছু বলার থাকে না। তার আশ্রয়দাতা বলিউডের হাঁকা নিদানগুলোকে কি নিতে পারলেন না এই কিশোরী? বেরিয়ে আসতে হল ‘আশ্রয়’ থেকে? নুসরাত যেখানে আপস করে নিলেন, সেখান থেকেই কি ফেরত আসতে হল জায়রা কে? নিজেকে ‘অন্য’ করে তোলার কঠিন খেলায় হার মানলেন জায়রা।

তবে কি ধরে নেবো জায়রা যেখান থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেন, ঠিক সেখানেই নিজেকে প্লেস করলেন নুসরাত? যে ইডিয়ম থেকে বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করলেন জায়রা, সেই ইডিয়মকেই আঁকড়ে ধরলেন নুসরাত? এ এক গভীর আর অন্তর্গহীনের খেলা। লস ও রিকভারি অফ সেলফ-এর গল্প। কখন মন হারায় আর কখন তাকে ‘অন্য’বস্থায় খুঁজে পাওয়া যায়, তা বলা সত্যিই দুরূহ। এই হারানো আর খোঁজের খেলায় সবাই পেরে ওঠে না। জায়রা পারলেন না। নুসরাত কি পারবেন? সময়ই উত্তর দেবে এই প্রশ্নের। ‘সেক্যুলারিজম’সেখানে একটা অছিলা মাত্র। একটা খাপ। একটা ফাঁদ। আপস করেই সেখানে পা দিতে হয়। পা দেওয়ার জন্য আপস করতে হয়।

রাষ্ট্রযন্ত্র জানায়, সংখ্যাগুরু বা ক্ষমতাবানের দেওয়া ছাঁচে নিজেকে ঢালাই করতে পারলে ঠিক আছে। আর না পারলে তুমি দুয়ো, তুমি খেলা থেকে বাদ। আপসটা সংখ্যালঘুকেই করতে হয় বারবার। সংখ্যাগুরু যদি সংখ্যালঘুর ভেক ধরেন, সেটা ভেকই। ছেলে ভুলোনোর রাজনীতি। কিন্তু সংখ্যালঘুকে বারবার গড়েপিটে নিতে হয় সংখ্যাগুরুর ধাঁচায়। না হলে সে অনিকেত। মাথার ওপর থেকে ছাদ উড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। ‘সেক্যুলারিজম’ এখানে একটা অলীক কল্পনা মাত্র। বড়জোর একটা দোহাই। নুসরাতও এই দোহাইয়ের ফাঁদে। জায়রাও। বগা কেন্দ্রে ফেরে ‘সেক্যুলারিজম’-এর ব্যাখ্যা চেয়ে।

Bootstrap Image Preview