Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ১৯ রবিবার, মে ২০২৪ | ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

চাকরি বাঁচাতে জরায়ু কাটছেন ভারতীয় নারীরা

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৬ জুলাই ২০১৯, ১০:১৩ AM
আপডেট: ০৬ জুলাই ২০১৯, ১০:১৩ AM

bdmorning Image Preview


বয়স আনুমানিক ২০ থেকে ২২, অনেকে আবার একাধিক সন্তানের মা। সবাই নিম্ন আয়ের শ্রমিক। পিরিয়ড হলে মালিকের নানা গঞ্জনা শুনতে হয়, বেতন কাটা যায়। জরিমানা হয়। তাই পেটের তাগিদে, অভাবের তাড়নায় অপারেশন করে জরায়ু ফেলে দেন এই দরিদ্র নারী শ্রমিকরা।

বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জরায়ু কেটে ফেলা মানে একজন নারীর শরীরটাকে তচনচ করে দেয়া। জরায়ু কেটে ফেললে সেই নারী শারীরিক যন্ত্রণা যত না ভোগ করেন, তার চেয়ে মানসিক যন্ত্রণা কোন অংশেই কম না। কিন্তু এই অসভ্যতা, পাশবিকতা কেন ঘটছে?

ভারতের কর্মজীবী নারীদের একটা বড় সমস্যা, পিরিয়ড। এই কর্মজীবীদের মধ্যে তারাই পিরিয়ড নিয়ে বিব্রত, যারা মূলত শ্রমিক। কোন চিনিকলের অফিসার পদে থাকা নারীর মাসিক ঋতুচক্র কর্মস্থলে তাকে সামান্য হলেও বিব্রত করে। কারণ ভারতের মানুষ সেই সভ্যতার শুরু থেকেই পিরিয়ডের সময়টাতে নারীকে অস্পৃশ্য অশুচি বলে গণ্য করে। তাকে হয় ঘরের কোণে আবদ্ধ থাকতে হয়, অথবা একা থাকতে হয় সবাইকে এড়িয়ে। সামাজিক বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সেই নারীদের যাওয়া একদম নিষেধ। হাজার বছর ধরে এটা চলে আসছে।

সম্প্রতি ধর্মীয় গোঁড়ামি ও অসভ্যতার প্রাচীর ভাঙতে শুরু করেছেন শহরের শিক্ষিত কর্মজীবী নারীরা। এর ফলে চিত্রটা একটু একটু করে পালটাচ্ছে। কিন্তু শহরের শিক্ষিত মানুষের মাঝে সামান্য পরিবর্তন আনা সম্ভব হলেও লাখ লাখ গ্রামের চিত্র ভয়াবহ। কোটি কোটি গরিব মানুষ ভারতে। যেসব পরিবারে নারী পুরুষ উভয়েই কাজ করে। দিনমজুর হিসেবে শিল্প বা কৃষি খাতে। সাম্প্রতিক সময়ে যে ঘটনাগুলো আলোড়ন তুলেছে, তার একটি মহারাষ্ট্রে। হাজার হাজার তরুণী স্বেচ্ছায় জরায়ু কেটে ফেলছেন হাসপাতালে গিয়ে।

এত কম বয়সে এই মেয়েগুলো মা হওয়ার যোগ্যতা হারায়, ভাবতে অবাক লাগে। শুধু কি অবাক? যন্ত্রণা, লজ্জা, গ্লানি এসে ভোর করে বিবেকবান ও সুস্থ মানুষের মনে। জরায়ু ফেলে দেয়ার এই জঘন্য কাজ চলছে প্রায় তিন বছর ধরে। যারা এই অপারেশন করিয়ে নিচ্ছেন, তারা কৃষি শ্রমিক। ক্ষেত থেকে আখ কাটেন। মহারাষ্ট্র ভারতে আখের উর্বর ক্ষেত্র। বছরে ৬ মাস এসব আখখেতে কাজ করতে আসেন হাজার হাজার শ্রমিক। এই নারীপুরুষরা একটানা ছয় মাস আখ কাটার কাজ করেন। আখ কাটার ঠিকাদাররা এক কোথায় মানুষরূপী জানোয়ার, এরা নানা ছুতায় বিভিন্ন কায়দায় এই শ্রমিকদের ওপর শোষণ নির্যাতন চালায়। এখানে চিত্রটা কী?

আখ কাটা অনেক পরিশ্রমসাধ্য, তাই নারীরা পিরিয়ডের তিন বা পাঁচ দিন কাজে আসতে পারেন না, যেটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু অনুপস্থিত থাকলেই মজুরি কাটা যাবে। একটা দিনের মজুরি কম পেলে হতদরিদ্র মানুষগুলো সহ্য করতে পারে না। আবার এসব জায়গায় ত্থাকার পরিবেশ একেবারেই জঘন্য, অস্বাস্থ্যকর। ক্ষেতের পাশেই কুঁড়ে ঘর বা তাবুতে থাকে শ্রমিকরা। মাঝে মাঝে রাতেও কাজ করতে হয়, কাজের সীমা পরিসীমা নেই, অনেক কাজ। এই অবস্থায় পিরিয়ড হলে একজন নারী শ্রমিক কঠিন সমস্যায় পড়ে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে পিরিয়ডের সময়টা পার করতে করতে তারা ইনফেকশনের শিকার হন। নানা রকম গাইনি সমস্যাও দেখা দেয়। তখন চিকিৎসার নামে অনভিজ্ঞ হাতুড়ে ডাক্তার একের পর এক নারীর সার্জারি করে জরায়ু ফেলে দেন। এমনকি সামান্য সমস্যা, যা ওষুধ খেলেই সেরে যাবে, সেসব ক্ষেত্রেও নির্বিচারে জরায়ু অপসারণের অপারেশন করে দেয়া হয়। এর ফলে কিছু গ্রাম এখন জরায়ুহীন নারীদের গ্রাম হিসেবে পরিচিত হয়ে গেছে।

গেলো মাসে মহারাষ্ট্রের রাজ্যসভায় নারীদের এই অবমাননাসূচক শারীরিক ক্ষতির প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন বিধায়ক নীলম ঘোরে। তার কথার সাথে একমত হয়ে রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী একনাথ সিন্ধে। মন্ত্রী জানান, ৩ বছরে বীদ জেলায় ৪ হাজার ৬শ ৫ টি হাইসটেরেকটমি সার্জারি হয়েছে। এই সার্জারিতে অনেক সময় নারীর প্রজননতন্ত্রের প্রায় সব কিছুই কেটে ফেলা হয়। যদিও মন্ত্রী বলেন, সব অপারেশন আখশ্রমিক নারীদের করা হয়েছে, তা নয়। তবে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য একটি তদন্ত কমিটি করার ঘোষণা দেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

বিবিসির মারাঠি প্রতিবেদক বীদ জেলার একটি গ্রামের নাম উল্লেখ করে জানান, এই গ্রামবাসীদের ৮০ ভাগই অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত আখ চাষের এলাকায় চলে যান। তাদের মধ্যে যারা মহিলা, তাদের অর্ধেকেরই জরায়ু ও প্রজননতন্ত্রের বিভিন্ন অংশ কেটে ফেলা হয়। বলা বাহুল্য এই অপারেশন নারীর শরীরে মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। কথা বলে জানা গেছে সার্জারি করা নারীরা শরীরে ব্যথাবেদনা, শক্তিহীনতাসহ অনেক সমস্যায় ভোগেন। খুব দ্রুত বুড়িয়ে যান, কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন।

পাশবিক্ এই আচরণের আরেক উদহারন দেখা গেছে তামিল নাড়ু রাজ্যে।সেখানের কাহিনী আরও ভয়াবহ। কোটি ডলারের গার্মেন্টস বানিজ্য, বিশাল বিশাল কারখানা। অনেক মেয়ে কাজ করে। পিরিয়ডের সময় কাহিল লাগে অনেকের, অনেকের পেইন হয়, সেক্ষেত্রে তাদের যেখানে এক বা দুদিন ছুটি দেয়া উচিত, তা দূরে থাক, উল্টো করে কী, ব্যথা কমানোর জন্য নাম না জানা ওষুধ খেতে দেয়। থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশন এ বিষয়টি নিয়ে কাজ করেছে। তারা কথা বলেছে ভুক্তভোগী ১০০ জনের সঙ্গে।

তারা জানিয়েছেন, নাম না জানা ওষুধ সেবনের পর সবারই কমবেশি শারীরিক সমস্যা হয়েছে। এই বিষয় নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশের পর নড়েচড়ে বসেছে ভারতের রাষ্ট্র যন্ত্র।

ভারতের জাতীয় মহিলা কমিশন বলেছে, মহারাষ্ট্রের অবস্থা বেদনাদায়ক। এই সব নৃশংসতা বন্ধ করতে বলেছে কমিশন। এই প্রেক্ষিতে তামিল নাড়ু সরকার বলেছে, পোশাক শ্রমিকদের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি মনিটর করবে। ভারতের নারী শ্রমিকদের এইসব কষ্ট অপমানের কথা প্রকাশ হল এমন সময়, যখন সারাবিশ্বে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানোর জোর প্রস্তুতি চলছে। এখানে যেটা লক্ষণীয়, ভারতে কর্মজীবী নারীদের সংখ্যা কমে আসছে। ২০০৫-২০০৬ অর্থ বছরে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ৩৬ শতাংশ, সেটি ২০১৫-১৬ বছরে কমে হয়েছে ২৫ দশমিক ৮ শতাংশ। দেশটিতে নারী কর্মজীবীদের হার কমে আসার কারণ সহজেই অনুমেয়।

Bootstrap Image Preview