গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ধারণা করছে রাজউকের পূর্বাচল উপশহ প্রকল্পে কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশকে প্লট দেওয়ার ক্ষেত্রে নিয়ম ভেঙেছে।
ইতিমধ্যে মন্ত্রণালয় উচ্চ আদালতের নির্দেশনা না মেনে শ্রেণি পরিবর্তন করে প্লটটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টিকে বরাদ্দ দেওয়ার কারণও জানতে চেয়ে রাজউকে চিঠি দিলে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা রাজউক নিয়ম ভাঙার অভিযোগ অস্বীকার করেছে এবং কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষের দাবি, তারা নিয়ম মেনে আবেদন করেই পূর্বাচলে জায়গাটি পেয়েছে।
২০১৬ সালে কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে বনানীর ১১ নম্বর সড়কের ৯৯ নম্বর বাড়িতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম চলছে। ওয়েবসাইটে স্থায়ী ঠিকানা দেওয়া আছে- পূর্বাচলের ৯ নম্বর সেক্টরের ৬০ নম্বর প্লট।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৮ সালের ২ ডিসেম্বর পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের ১৭১ কাঠার প্লটটি কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটিকে বরাদ্দ দেয় রাজউক।
নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের মূল অনুমোদিত নকশায় এ প্লটকে ‘সেকেন্ডারি স্কুল’ হিসেবে দেখানো হয়েছে। ওই প্লটের শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য গত বছরের ৪ ডিসেম্বর কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটির চেয়ারম্যান নাফিজ সরাফাত রাজউকে আবেদন করেন।
তার আবেদনের ২০ দিনের মধ্যে ২৪ ডিসেম্বর রাজউকের স্থাপত্য শাখা থেকে প্লটের শ্রেণি ‘সেকেন্ডারি স্কুল’ পরিবর্তন করে ‘কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়’ করার বিষয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্তের প্রস্তাব রাজউকের বোর্ড সভায় উপস্থাপন করা হয়।
তার দুই দিনের মধ্যে ওই বছরের ২৬ ডিসেম্বর রাজউকের বোর্ড সভায় ওই প্রস্তাবে অনুমোদন দেওয়া হয়।
পূর্বাচল নিয়ে হাই কোর্টের কয়েকটি নির্দেশনার মধ্যে বিষয়টি নজরে আসার পর গত ২৫ ফেব্রুয়ারি গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে রাজউকের চেয়ারম্যানকে এই প্লট বরাদ্দ নিয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়।
মন্ত্রণালয়ের উপসচিব শ্যামলী নবীর স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, “রাজউকের বোর্ড সভার ১৭.৩ নং সিদ্ধান্ত মন্ত্রণালয়ের গোচরীভূত হয়েছে।
“এতে দেখা যায়, পূর্বাচল মডেল টাউনের মাস্টার প্ল্যানে ৯ নম্বর সেক্টরে হাইস্কুলের জন্য নির্ধারিত প্রায় নয় বিঘার প্লটটি নিয়ম বহির্ভূতভাবে একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়কে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এবং প্লটটির শ্রেণির পরিবর্তন করা হয়েছে।”
পূর্বাচলের প্লটের শ্রেণি পরিবর্তন না করার বিষয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশনার কথাও উল্লেখ করা হয় ওই চিঠিতে।
এতে বলা হয়, “রাজউকের চতুর্থ সংশোধনী পর্যন্ত এবং ৫ম সংশোধনীর প্রস্তাবিত আইকনিক টাওয়ার অংশটুকু মহামান্য হাই কোর্ট বিভাগের আদেশে বহাল রাখা হয়েছে। পঞ্চম সংশোধনীর আইকনিক টাওয়ার ছাড়া অবশিষ্ট অংশ এবং পরবর্তী পরিবর্তনসমূহ উল্লিখিত আদেশের প্রেক্ষিতে মহামান্য উচ্চ আদালত কর্তৃক গৃহীত হয় নাই বিধায় বাতিলযোগ্য।”
মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সাতটি সংগঠনের দায়ের করা এক মামলায় ২০১৪ সালে হাই কোর্ট এক রায়ে পূর্বাচল প্রকল্পের জন্য রাজউকের চতুর্থ সংশোধনী লেআউট প্ল্যানের অনুমোদন দিয়েছিল।
ওই রায়ের নির্দেশনার ব্যত্যয় ঘটিয়ে নতুন প্লট সৃষ্টির জন্য গত নভেম্বরে পঞ্চম সংশোধনী প্ল্যান অনুমোদনের জন্য আদালতে আবেদন করেছিল রাজউক। কিন্তু গত ১৭ ডিসেম্বর হাই কোর্ট রাজউকের পঞ্চম সংশোধনী লেআইট প্ল্যানটি কার্যত বাতিল করে দেয়।
আগের রায়ের পর এ পর্যন্ত পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প নিয়ে রাজউক যতগুলো বোর্ড সভা করেছে তার সবগুলোর সিদ্ধান্তের অনুলিপি চায় হাই কোর্ট।
কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটিকে দেওয়া প্লটের শ্রেণি পরিবর্তন অনুমোদন করার ঘটনাটি হাই কোর্টের আদেশের পরই ঘটে।
অন্যদিকে হাই কোর্টের নির্দেশনার পরও কীভাবে প্লটের শ্রেণি পরিবর্তন করা হল- এ প্রশ্নের কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি রাজউকের কোনো কর্মকর্তার কাছ থেকে।
প্লটের শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য বোর্ড সভায় উপস্থাপনের জন্য দেওয়া কর্মপত্রে সই আছে রাজউক সদস্য আবুল কালাম আজাদের।
এ বিষয়ে জানতে গত ৪ মার্চ তার কার্যালয়ে গেলে তিনি এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
আবুল কালাম আজাদ পাল্টা প্রশ্ন বলেন, “কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটির বিষয়ে আপনার এত আগ্রহের কারণ কী? এটা কি কোনো জাতীয় ইস্যু? আরও তো অনেক বিষয় আছে নিউজ করার মতো।”
এ বিষয়ে জানতে রাজউকের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান আবদুর রহমানের সঙ্গে কয়েকবার যোগাযোগ করলে তিনিও কথা বলতে অপারগতা জানান।
এ প্লটের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে গত ৪ এপ্রিল তথ্য অধিকার আইনে তথ্য চেয়ে আবেদনও করা হয়। তবে রাজউক থেকে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
রাজউকের বর্তমান চেয়ারম্যান ড. সুলতান আহমেদের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এ বিষয়ে (প্লটটি বরাদ্দ) আমি কিছুই জানি না। এজন্য এখন বলতে পারব না।”
রাজউকের ২৬ ডিসেম্বরের ওই বোর্ড সভায় তৎকালীন চেয়ারম্যান আবদুর রহমান সভাপতিত্ব করেন। উপস্থিত ছিলেন সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) আমজাদ হোসেন খান, সদস্য (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ) মো. সাঈদ নূর আলম, সদস্য (পরিকল্পনা) আবুল কালাম আজাদ, সদস্য (প্রশাসন ও অর্থ) মো. রোকন উদ দৌলা এবং সদস্য (উন্নয়ন) ইঞ্জিনিয়ার শামসুদ্দিন চৌধুরী।
এদিকে গত ১২ মার্চ রাজউক গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের চিঠির জবাব দেয়, যাতে সন্তুষ্ট হতে পারেনি মন্ত্রণালয়।
রাজউকের সচিব সুশান্ত চাকমা স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, প্লটটির ক্ষেত্রে শ্রেণির কোনো পরিবর্তন ‘করা হয়নি’।
“পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের চতুর্থ মোডিফিকেশন অনুযায়ী ৯ নম্বর সেক্টরের ১০৭ নম্বর রাস্তার কমবেশি ১৭১.১৬ কাঠা আয়তনের ৬০ নম্বর প্লটটি ‘সেকেন্ডারি স্কুল’ ক্যাটাগরিতে চিহ্নিত আছে। কর্তৃপক্ষের ১৯/২০১৮ তম সাধারণ সভার ১৭.৩ নং অনুচ্ছেদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী উক্ত প্লটটি একই ক্যাটাগরিতে (শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ক্যাটাগরির অন্তর্ভুক্ত) কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশকে বরাদ্দ প্রদান করা হয়।”
রাজউকের চিঠিতে যুক্তি দেখানো হয়, যেহেতু সেকেন্ডারি স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় দুটিই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্যাটাগরির অন্তর্ভুক্ত সে কারণে প্লটের শ্রেণির কোনো পরিবর্তন হয়নি।
রাজউকের জবাব নিয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. শহীদ উল্লা খন্দকার বলেন, তারা এতে সন্তুষ্ট নন।
“আমরা তাদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, কীভাবে প্লটটি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তারা জবাব দিয়েছে, এতে আমরা সন্তুষ্ট নই। আমরা এটি ফারদার দেখার জন্য আলাদা একটি ফাইল উপস্থাপন করেছি। এটা মন্ত্রী মহোদয় পর্যন্ত যাবে। তিনি অনুমোদন করলে আমরা এ বিষয়টি আরও খতিয়ে দেখব।”
‘ট্রান্সপারেন্ট জিনিস’
বিষয়টি নিয়ে রাজউক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলার এক পর্যায়ে একদিন নিজেই ফোন করে কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটির চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাত দাবি করেন, ওই প্লট বরাদ্দ নিয়ে কোনো ‘অনিয়ম হয়নি’।
তিনি বলেন, “আপনার কাছে কী এমন জিনিস আছে যে এমন একটা ট্রান্সপারেন্ট জিনিস নিয়ে জানতে চাচ্ছেন?”
প্লট পাওয়ার প্রক্রিয়া তুলে ধরে নাফিজ সরাফাত বলেন, ২০১৫ সালে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেওয়ার পর তারা পূর্বাচলে প্লটের জন্য আবেদন করেন।
“লটারি করার পর আমরা ওই প্লটটা পাই। ২০১৭ সালে টাকা দেওয়ার পরে আমাদের দলিল করে বুঝিয়ে দেয়।”
ওই প্লটের শ্রেণি পরিবর্তন হয়নি বলেও দাবি করেন নাফিজ সরাফত, যদিও নথিপত্রে তারই ওই প্লটের শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন করার তথ্য পাওয়া যায়।
তিনি বলেন, “ওই প্লটটা যখন বুঝে নিতে যাব, ইউজিসির একটা নিয়ম আছে যে মিনিমাম তিন একরের একটা রিকোয়ারমেন্ট আছে। ওইটা করতে যেয়ে ওরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেটা … শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোনো ক্যাটাগরি চেঞ্জ হয় না … সেইম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থাকে … এটা রাজউকের আইন।
“ওই স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যেটা ইউজিসির সঙ্গে ম্যাচ করে এমন প্লট রাজউক আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে। দ্যাটস ইট। এজন্য যেহেতু ওদের প্লটটা মিলে যায় ইউনিভার্সিটির সঙ্গে, এখানে কোনো আইন পরিবর্তন হয় না। তারা তাদের বোর্ডের মাধ্যমে আবার অনুমোদন করে দিয়েছে।”