আজ ১৭ এপ্রিল দিনাজপুরের ফুলবাড়ী আঁখিরা গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের আজকের এই দিনে ফুলবাড়ী উপজেলার আলাদীপুর ইউনিয়নের বারাইহাট থেকে ১০০ গজ দূরে আঁখিরা নামক পুকুরপাড়ে পাকিস্থান সেনাদের হাতে প্রাণ হারায় ভারতে আশ্রয় নিতে যাওয়া ফুলবাড়ী, নবাবগঞ্জ, পার্বতীপুর ও বদরগঞ্জ উপজেলার প্রায় ৫ শতাধিক নারী-পরুষ ও শিশু।
আজও অনেকে এই ঘটনার বেদনাবিধুর স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরেও আজও সংরক্ষণ করা হয়নি এই ঐতিহাসিক বদ্ধ ভূমিটি। ফলে নতুন প্রজন্মের কাছে অজানাই থেকে যাচ্ছে এই্ ঐতিহাসিক স্থানটির সেদিনের সেই মর্মান্তিক স্মৃতি।
মুক্তিযোদ্ধা ও প্রত্যক্ষদর্শীদের নিকট জানা গেছে, ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পেতে ফুলবাড়ী উপজেলার রামভদ্রপুর, নবাবগঞ্জ উপজেলার খোশলামপুর ও পার্বতীপুর উপজেলার হামিদপুর ইউনিয়নের বাধদিঘী ও বদরগঞ্জ উপজেলার কয়েকটি গ্রামের প্রায় ৫ শতাধিক হিন্দু সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষ ও শিশুদের নিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়ার জন্য চেষ্টা করলে রামভদ্রপুর গ্রামের কুখ্যাত রাজাকার কেনান সরকার তাদেরকে ভারতে পৌঁছে দেয়ার কথা বলে সোনা-দানা ও নগদ অর্থ হাতিয়ে নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। ৫ শতাধিক মানুষের এই দলটি শিবনগর ইউনিয়নের শিবনগর গ্রামের মধ্য দিয়ে সমশেরনগর থেকে বারাইহাট পার হয়ে আঁখিরা পুকুরপাড়ে পৌঁছা মাত্র রাজাকার কেনান সরকার ও তার সঙ্গীরা এই নিরীহ মানুষদেরকে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। পাক হানাদার বাহিনী সদস্যরা এই ৫ শতাধিক মানুষকে এক লাইনে দাঁড় করে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে।
ভাগ্যের জোরে বেঁচে যাওয়া ওই দলের সহযাত্রী উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রামের বাসিন্দা রাখাল চন্দ্র জানায়, কুখ্যাত রাজাকার কেনান সরকারের কথায় বিশ্বাস করে যাত্রা শুরু করেছিল ৩ উপজেলার প্রায় ৫ শতাধিক মানুষ। কিন্তু তাদের বিশ্বাস এভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে তারা বিন্দুমাত্র বুঝতে পারেনি।
এ দিকে আখিঁরা গণহত্যার বর্ণনা করতে গিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী বারাইহাট বাজারের পল্লী চিকিৎসক অনিল কুমার বলেন, এই গণহত্যার সময় তিনি পার্শ্ববর্তী বড়গাছা গ্রামের একটি ঝোপে লুকিয়ে পড়েন। এর পর খান সেনারা চলে গেলে তিনি এসে দেখতে পান শত শত নারী-পুরুষ ও শিশুদের গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ। এ সময় একটি এক থেকে দেড় বছর বয়সের শিশু তার মৃত মায়ের স্তন পান করছেন। এর পর অনেক লোক সেখানে এসেছে তাদের মধ্যে কেউ হয়তো জীবিত বাচ্ছাটিকে নিয়ে গেছেন।
একই কথা বলেন আরও এক প্রত্যক্ষদর্শী বড়গাছা গ্রামের আব্দুল খালেক। তিনি বলেন, বহুদিন পর্যন্তু এই পুকুরটিতে মানুষের হাড় ও মাথার খুলি পড়ে ছিল। সে দিনের সেই স্মৃতি তার চোখের সামনে আজও ভেসে ওঠে।
ফুলবাড়ী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার লিয়াকত আলী বলেন, ফুলবাড়ীর যে কয়জন ঘৃন্য-কুকর্মের অধিকারী রাজাকার ছিল তাদের মধ্যে কেনান সরকার অন্যতম। সে শুধু ওই ৫ শতাধিক ব্যক্তির প্রাণই নেয়নি তার হাতে নিহত হয়েছে ফুলবাড়ীসহ কয়েকটি উপজেলার কয়েক হাজার নিরীহ মানুষ। এ জন্য যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তার মৃত্যু হয়েছে। তার অনেক সঙ্গী এখন ফুলবাড়ী থেকে বিতাড়িত। তিনি আজও এই ঐতিহাসিক বদ্ধ ভূমিটি সরকারি উদ্যোগে সংরক্ষণ না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
তিনি আরও বলেন, কয়েক দফায় এই আঁখিরা নামক জায়গাটি পরিদর্শন করা হয়েছে কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এখন এই ঐতিহাসিক আঁখিরা নামক জায়গাটি সংরক্ষণ না হওয়ায় ঐ এলাকার কৃষকেরা চাষাবাদ করছে।