Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ৩০ মঙ্গলবার, এপ্রিল ২০২৪ | ১৭ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

আজ ঐতিহাসিক তেলিয়াপাড়া দিবস

হবিগঞ্জ প্রতিনিধি 
প্রকাশিত: ০৪ এপ্রিল ২০১৯, ১২:৫৭ PM
আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০১৯, ১২:৫৮ PM

bdmorning Image Preview


আজ ৪ এপ্রিল, ঐতিহাসিক তেলিয়াপাড়া দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ম্যানেজার বাংলোয় স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উর্ধ্বতন ২৭ সেনা কর্মকর্তার উপস্থিতিতে এ বৈঠকেই দেশকে স্বাধীন করার শপথ এবং যুদ্ধের রণকৌশল গ্রহণ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনকে ভাগ করা হয় ১১টি সেক্টর ও ৩টি ব্রিগেডে। অস্ত্রের যোগান, আন্তর্জাতিক সমর্থনসহ গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এই সভায়।

প্রতি বছর ৪ এপ্রিল হবিগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের উদ্যোগে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এ বছরও এ দিনটিকে জাতীয়ভাবে তেলিয়াপাড়া দিবস হিসেবে ঘোষণার দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।

হবিগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার এডভোকেট মোহাম্মদ আলী পাঠান বলেন, এবার অনুষ্ঠানে আলোচনা সভায় বেসামরিক বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট মাহবুব আলী, জেলা প্রশাসক মাহমুদুল কবীর মুরাদ, হবিগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার মুহাম্মদ উল্লাহসহ পার্শ্ববর্তী জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মাধবপুর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার, ডেপুটি কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা পরিবার বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক জোটের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত থাকবেন।

১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেখানে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক আতাউল গণি ওসমানী, তৎকালীন মেজর সিআর দত্ত, মেজর জিয়াউর রহমান, কর্নেল এম এ রব, রব্বানী, ক্যাপ্টেন নাসিম, আব্দুল মতিন, মেজর খালেদ মোশাররফ, কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরী, ভারতের ব্রিগেডিয়ার শুভ্রমানিয়ম, এমপিএ মৌলানা আসাদ আলী, লে. সৈয়দ ইব্রাহীম, মেজর কেএম শফিউল্লাহ প্রমুখ।

জেনারেল এম এ জি ওসমানীর নেতৃত্বে নেয়া হয় মুক্তিযুদ্ধের সর্বাত্মক প্রস্তুতি। শপথ বাক্য পাঠ করানোর পর নিজের পিস্তল থেকে ফাঁকা গুলি ছুড়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার শপথের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেন এম এ জি ওসমানী। সভায় ১০ এপ্রিল দ্বিতীয় বৈঠক ও সরকার গঠনের প্রস্তাবও করা হয়েছিল। কিন্তু নিরাপত্তার কারণে তা আর হয়ে উঠেনি। সেক্টর বিভক্তি নিয়ে মতবিরোধ থাকলেও এই মিটিং ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম মিটিং এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই কারও।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও তখনকার সময় হবিগঞ্জের এসডিও আকবর আলী জানান, আমি জানতাম ৪ এপ্রিলের মিটিং এর বিষয়ে। কিন্তু আমি মিটিংয়ে যাইনি।

বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির সভাপতি মেজর জেনারেল (অব) সৈয়দ ইব্রাহিম জানান, স্বাধীনতা ঘোষণার পর ৪ এপ্রিল প্রথম কোন আনুষ্ঠানিক সভা অনুষ্ঠিত হয়। আমিও সেই মিটিংয়ে ছিলাম। মিটিংয়ে জেনারেল ওসমানীকে সেনাপ্রধান করা হয়। তিনি তখন বিভিন্ন অফিসারকে বিভিন্ন এলাকায় দায়িত্ব দেন। পরবর্তীতে সেগুলো সেক্টর হিসাবে অনুমোদন পায়। জেনারেল ওসমানী আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন অন্যান্য কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য এবং রাজনীতিবিদদেরকে নিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার জন্য।

৩নং সেক্টর কমান্ডার মেজর কে. এম শফিউল্লাহ্ তাঁর হেড কোয়ার্টার স্থাপন করেন তেলিয়াপাড়া চা বাগানে। সড়ক ও রেলপথে বৃহত্তর সিলেটে প্রবেশের ক্ষেত্রে মাধবপুর উপজেলার তেলিয়াপাড়ার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এখান থেকে মুক্তিবাহিনী বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করা ছাড়াও তেলিয়াপাড়া চা বাগানে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গড়ে উঠে।

মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানীসহ কয়েকটি সেক্টরের কমান্ডারগণ বিভিন্ন সময়ে তেলিয়াপাড়া সফর করেন। ম্যানেজার বাংলোসহ পার্শ্ববর্তী এলাকা ছিল মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও সেনানায়কদের পদচারণায় মুখরিত। ১৯৭১ সালের ২১ জুনের পরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের কারণে তেলিয়াপাড়া চা বাগানে স্থাপিত সেক্টর হেডকোয়ার্টার তুলে নেয়া হয়।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ২, ৩ ও ৪নং সেক্টরে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে তেলিয়াপাড়া চা বাগান ম্যানেজার বাংলোর পাশে নির্মিত হয় বুলেট আকৃতির মুক্তিযুদ্ধের প্রথম স্মৃতিসৌধ। ১৯৭৫ সালের জুন মাসে এ স্মৃতিসৌধের উদ্বোধন করেন সেনাপ্রধান (অব.) মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ বীর উত্তম পিএসসি।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান হলেও সেটি সংরক্ষণের কোন উদ্যোগ ছিল না দীর্ঘদিন যাবত। ২০১১ সালের ৭ মে মুক্তিযোদ্ধাদের এক সমাবেশে সেখানে ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স করার কথা ঘোষণা করা হয়।

সভায় উপস্থিত ছিলেন, সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত এনামুল হক মোস্তফা শহীদ, সাবেক চিফ হুইপ ও তখনকার বাংলাদেশ টি বোর্ডের চেয়ারম্যান উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ। সভায় উপস্থিত এলজিইডির তখনকার প্রধান প্রকৌশলী ওয়াহিদুর রহমানকে দায়িত্ব দেয়া হয় প্রকল্প গ্রহণ করার জন্য। পরবর্তীতে এলজিইডি ৩ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে সেই প্রকল্পের কোন কাজই হয়নি।

উপরন্তু ন্যাশনাল টি কোম্পানি স্মৃতিসৌধকে পৃথক করে ঐতিহাসিক বাংলোটিকে বাউন্ডারি দিয়ে আলাদা করে ফেলে। এক সময় সেখানে তার কাটার বেড়া থাকলেও ছিল একটি পকেট গেইট। কিন্তু বর্তমানে বাউন্ডারি থাকায় কেউ দেখতে পারেন না বাংলোটিকে। এ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা এবং সাধারণ মানুষের মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করছে।

হবিগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ইউনিট কমান্ডার অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আলী পাঠান বলেন, বর্তমান সরকার দেশের সকল মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত স্থানকে সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তেলিয়াপাড়ায় কোন কাজই হয়নি। ১০০ একর জমিতে সেখানে কমপ্লেক্স করে বিভিন্ন ভাস্কর্য করার কথা ছিল। ন্যাশনাল টি কোম্পানির বাধার জন্য সেখানে প্রকল্পের কাজ বন্ধ রয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য ক্যাপ্টেন (অব.) কবির হোসেন বলেন, তেলিয়াপাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান স্মৃতি বিজড়িত স্থান। অবশ্য্ এটিকে সংরক্ষণ করতে হবে। তিনি অবিলম্বে সেখানে রেস্ট হাউজ, টয়লেট নির্মাণসহ উন্নয়নমূলক কার্যক্রম গ্রহণের দাবি জানান। পাশাপাশি ঐতিহাসিক বাংলোটিকে জাদুঘর করার দাবি জানান।

Bootstrap Image Preview