Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ০৫ রবিবার, মে ২০২৪ | ২২ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

নারীর ক্ষমতায়ন শুধু নারীর বিষয় নয়

নারী ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৩ এপ্রিল ২০১৯, ০৭:৪৪ PM
আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০১৯, ০৮:১৭ PM

bdmorning Image Preview


এনালা নগুলুর যখন ১৩ বছর বয়স, তখন তাঁর ৪৭ বছর বয়সী এক ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ে হয়। ওই ব্যক্তির তখন আরও দুটি স্ত্রী ছিল। যখন তাঁর স্কুলে গিয়ে পড়ালেখা করার কথা ছিল, কথা ছিল গোটা বিশ্ব সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের, তখন তাঁর কাঁধে বিয়ে এবং সন্তানধারণের মতো গুরুদায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয়। ১৫ বছর বয়সে এনালা প্রথম সন্তানের জন্ম দেন এবং তারপর তাঁর আরও পাঁচটি কন্যাসন্তান হয়। এটা আসলে বর্তমান বিশ্বের সাড়ে ৩৭ কোটি নারীর গল্প, যাদের বয়স ১৮ বছর হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যায় এবং সন্তানের মা হয়।

যে বিষয়টি এনালাকে অন্যদের চেয়ে অনন্য করে তোলে, তা হচ্ছে তিনি তাঁর আকাঙ্ক্ষা দমিয়ে রাখেননি। তিনি ২৯ বছর বয়সে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। মালাবির এই নারী পড়ালেখা চালিয়ে যান এবং ২০১২ সালে স্কুলশিক্ষা সমাপনীর সনদ হাতে পান। এনালা এখন কারোঙ্গায় ফাউন্ডেশন ফর কমিউনিটি সাপোর্ট সার্ভিসেসে একজন মাঠকর্মী হিসেবে কাজ করছেন। কিন্তু শুধু পড়ালেখা ও চাকরি করাই তাঁর একমাত্র স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা ছিল না, তিনি তাঁর ছয় কন্যাসন্তানকে বাল্যবিবাহ না দিয়ে পড়ালেখা করানোর ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন।

এনালা তাঁর এই স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছেন। তিনি মালাবিতে বাল্যবিবাহ ও জোরপূর্বক বিয়ে প্রতিরোধে কমনওয়েলথের কার্যক্রমে নিজেকে যুক্ত করেছেন। এখন মালাবিতে মেয়েদের বাল্যবিবাহ ও জোরপূর্বক বিয়ে নিষিদ্ধ।

এনালার মতো নারীদের ঘুরে দাঁড়ানোর কাহিনি আমাকে অনুপ্রাণিত করে তঁাদের জন্য সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে কিছু করতে, যাতে তাঁদের কথা কেউ ভুলে না যায় এবং তাঁদের দুর্দশা লাঘবে সিদ্ধান্ত নেয়। খুব অল্প বয়সেই আমি এটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম যে নারী-পুরুষের সমতা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রধান উৎস। কিন্তু সমাজের ধ্যানধারণা ও বৈষম্যমূলক আইনকানুন সব ক্ষেত্রে নারীদের পূর্ণাঙ্গ অংশগ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করছে। এই বিপজ্জনক বাস্তবতা আমাকে আইন পেশা বেছে নিতে উদ্বুদ্ধ করে এবং সম্ভাব্য সব উপায়ে নারী ও মেয়েদের ক্ষমতায়নে সাহায্য করতে আমাকে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে তোলে।

১৯৯৭ সালে আমি স্কটল্যান্ডের অ্যাস্টালের ব্যারোনেস হিসেবে হাউস অব লর্ডসে প্রবেশ করি। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তর ও স্বরাষ্ট্র দপ্তরে আমার গোটা মন্ত্রিত্বের জীবনে এবং ইংল্যান্ড, ওয়েলস ও উত্তর আয়ারল্যান্ডের প্রথম নারী অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে আমি নারীর ক্ষমতায়ন ও নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে চেষ্টা চালিয়ে গেছি। ১৯৯৯ থেকে ২০০১ সালের মধ্যে পররাষ্ট্র দপ্তরে ফোর্সড ম্যারেজ ইউনিট, ইন্টারন্যাশনাল চাইল্ড অ্যাবডাকশন ইউনিট ও হিউম্যান রাইটস প্যানেল সৃষ্টি করেছি বিশ্বজুড়ে তরুণ-তরুণীদের সহায়তা ও সমর্থন জোগানোর জন্য।

এরপর ২০০৩ সালে আমি পারিবারিক সহিংসতার ওপর আন্তমন্ত্রণালয় একটি গ্রুপের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করি। এখানে আমরা এই অপরাধের ক্ষতিকর প্রকৃতি মোকাবিলা করার জন্য একটি বহু সংস্থাভিত্তিক পদ্ধতি চালু করি। আমরা অন্যান্য সরকারি বিভাগ, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে মিলিতভাবে কাজ করে শেষ পর্যন্ত পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা বছরে ৬৪ শতাংশ কমিয়ে আনি এবং পারিবারিক সহিংসতার কারণে ক্ষতির পরিমাণ ৭১০ কোটি পাউন্ড কমিয়ে আনি।

তিন বছর আগে ২০১৬ সালে যখন আমি কমনওয়েলথের প্রথম নারী মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পাই, তখন আমি নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করি এবং কমনওয়েলথের সনদে তা অন্তর্ভুক্ত করি। ২০১৬ সালে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কমনওয়েলথের ৪১টি দেশে কমপক্ষে একটি করে আইন আছে, যা নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগে বাধা সৃষ্টি করে।

এ ধরনের বাধা দূর করতে কমনওয়েলথ ইউএন উইমেনের সহযোগিতা নিয়ে একটি কৌশল গ্রহণ করে, যাতে বিশ্বব্যাপী এসব বৈষম্যমূলক আইন নির্মূল করা যায়। একে বলা হয় ‘লেভেলিং দ্য ল’। এই কাঠামোর মধ্যে আমরা সদস্যদেশগুলোকে নারী অধিকার সংরক্ষণে আইন পাস, সংশোধন ও সংস্কারে সাহায্য করি।

আমরা কোনো নারী ও মেয়ের দক্ষতা, শক্তি ও উৎসাহ হারানোর ঝুঁকি নিতে পারি না। আমরা অবশ্যই সেই সামাজিক মূলধন গড়ে তুলব, যা দীর্ঘ মেয়াদে নারীদের সম্পদ বৃদ্ধি ও উন্নত স্বাস্থ্য নিশ্চিত করবে। প্রত্যেক নারী ও মেয়ে নিজের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য পুরুষের মতো সমান অধিকার রাখে, হতে পারে সে নাউরুর মতো ১০ হাজার জনসংখ্যার ছোট কোনো কাউন্টিতে বসবাস করছে বা ভারতের মতো ১৩০ কোটি জনসংখ্যার দেশে বসবাস করছে।

নারীর ক্ষমতায়নের জন্য আমরা সদস্যদেশগুলোর নানা কর্মসূচি ও উদ্যোগে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছি। এর মধ্যে রয়েছে:

১. জমি ও সম্পত্তির উত্তরাধিকারে নারীর অধিকারের প্রতিবন্ধকতা দূর করতে আইনি নথিপত্র সরবরাহ করা।

২. নারী ও মেয়েদের ওপর সহিংসতার আর্থিক ক্ষতির পরিমাপ করা, যেমন রোজগার হারিয়ে ফেলা।

৩. অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীদের সমান অংশীদার হিসেবে দেখা হচ্ছে, এটা নিশ্চিত করতে কমনওয়েলথ মহিলাবিষয়ক মন্ত্রীদের ত্রৈমাসিক বৈঠকে বসা।

৪. নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় নারীদের বৃহত্তর অন্তর্ভুক্তি ও অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করতে নারী-পুরুষের অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য একটি কমনওয়েলথ চেকলিস্ট তৈরি করা।

৫. ‘জেন্ডার ইক্যুয়ালিটি ইন দ্য কমনওয়েলথ’ নামে একটি বার্ষিক প্রকাশনায় সহায়তা দেওয়া, যেখানে বিভিন্ন দেশের নারীর অগ্রগতি-সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হবে।

৬. কমনওয়েলথ উইমেনস ফোরামের বৈঠকে দুই বছর অন্তর বসা, যেখানে নারী-পুরুষের বৈষম্য নিরসনে সদস্যদেশগুলোর নেতাদের কাছে সুপারিশ তুলে ধরা হবে।

নারীর ক্ষমতায়ন শুধু নারীর বিষয় নয়, এটা প্রত্যেকের বিষয়। নারীর জন্য বিনিয়োগ মানে এমন একটি ভবিষ্যৎ, যা আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক, আরও ন্যায্য, আরও সমৃদ্ধ এবং আরও নিরাপদ। এর অর্থ হচ্ছে বাল্যবিবাহ নির্মূল করতে, মেয়েদের স্কুল থেকে ঝরে পড়া রোধ করতে, নারীদের উদ্যোক্তা হওয়ার পথের সব বাধা দূর করতে এবং নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে আমরা প্রত্যেকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

আমি এ জন্য চিন্তিত যে আমরা যদি সময়মতো নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় সহায়তাকারী নীতিগুলো বাস্তবায়ন না করি, তবে ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতি মন্থর হবে। কাজেই আমাদের এখন এমন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে, যাতে ২০৩০ সালের মধ্যে নারী-পুরুষের পূর্ণাঙ্গ সমতা অর্জিত হয়।


প্যাট্রিসিয়া স্কটল্যান্ড কমনওয়েলথের মহাসচিব

Bootstrap Image Preview