Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ৩০ মঙ্গলবার, এপ্রিল ২০২৪ | ১৬ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ত্রাসীদের গোপন আস্থানা

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯ মার্চ ২০১৯, ১০:৪৬ PM
আপডেট: ০৯ মার্চ ২০১৯, ১০:৪৬ PM

bdmorning Image Preview
ফাইল ছবি


রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে যে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তা আসলেই প্রশংসার দাবিদার। বাংলাদেশের মত এমন একটা দেশের পক্ষে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় প্রদান করে তাদের সকল দায়ভার গ্রহণ করা এই সরকারের মহানুভবতার এক অপরূপ দৃষ্টান্ত। কিন্তু বর্তমানে এ বিশাল সংখ্যক রোহিঙ্গাদের মর্যাদাপূর্ণ ও স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করা দেশের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এজন্য সরকারকে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়েও ব্যাপক বেগ পেতে হচ্ছে। এখন পর্যন্ত এই সমস্যা সমাধানে উল্লেখ করার মতো কোন অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি। ফলে এখন সরকারকে তাদের আশ্রয়, খাবার, চিকিৎসা ও নিরাপত্তার জন্য ব্যয় করতে হচ্ছে বিপুল অর্থ। সেই সঙ্গে মোকাবেলা করতে হচ্ছে নিত্য নতুন চ্যালেঞ্জ। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের একটি বড় অংশ নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে। বাড়ছে অপরাধ, ছিনতাই, অপহরণ এমনকি খুনের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গাদের একটি চক্র। এরই মধ্যে এ চক্রটি 'রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী' হিসেবে চিহ্নিত। তাদের উৎপাতে ধৈর্য হারাচ্ছে স্থানীয়রা। উচ্ছৃঙ্খল রোহিঙ্গাদের বেপরোয়া আচরণে স্থানীয়রা পড়ে যাচ্ছে হুমকির মুখে।

জীবন বাঁচাতে পালিয়ে আসা এসব নিরীহ রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা দিতে বাংলাদেশ বহুমুখী সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও। তবে আশ্রয় নেওয়া এই বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে গোপনে সক্রিয় হয়ে উঠছে 'সন্ত্রাসী চক্র' যা এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিভিন্ন সূত্রে মতে জানা যাচ্ছে, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে বাঞ্চাল করতেই ক্যাম্পে এই 'সন্ত্রাসী চক্র' তৈরি করেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী।

উল্লেখ্য, মো. খালেদ নামে এক রোহিঙ্গা গত (৭ ফেব্রুয়ারি) ফেসবুকে এক ভিডিওতে হুমকি দিয়ে বলেছে, 'রোহিঙ্গাদের কোনো ক্ষতি করলে, জোর করে দেশে ফেরত পাঠালে বাংলাদেশ সরকারের সব দপ্তর এক রাতেই ধ্বংস করে দেওয়া হবে।' এমনকি সে প্রধানমন্ত্রীকেও হুমকি দিয়ে বলেছে, 'রোহিঙ্গাদের ওপর অন্যায্য কোনো আচরণ হলে ছাড় দেওয়া হবে না।'

ইতোমধ্যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড স্বরূপ ' গত ২২ ফেব্রুয়ারি টেকনাফে র‍্যাবের সঙ্গে 'বন্দুকযুদ্ধে' নিহত হয় দুর্ধর্ষ রোহিঙ্গা ডাকাত নুরুল আলম (৩০)। টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা শিবিরের আনসার ক্যাম্পে হামলা, অস্ত্র লুট ও কমান্ডার হত্যার মূল হোতাও ছিল এই নুরুল। সে না থাকলেও তার বাহিনীর দাপট মোটেও কমেনি। তারা পরের দিনই এই হত্যার বদলা হিসেবে রোহিঙ্গা পল্লী চিকিৎসক মো. হামিদকে খুন করে।

আবার এই হত্যাকাণ্ডের মাত্র তিন দিন পর নয়াপাড়া ক্যাম্পে মোহাম্মদ জয়নাল (২২) নামে আরও একজনকে হত্যা করেছে একদল রোহিঙ্গা। এই ক্যাম্পের নিরাপত্তা কর্মী হিসাবে কর্মরত ছিলেন জয়নাল। পুলিশের সোর্স সন্দেহে তাকেও হত্যা করা হয়েছে বলে একাধিক সূত্র তথ্য প্রকাশ করেছে।

শরণার্থী ক্যাম্পের পুলিশ পরিদর্শক আবদুস সালাম জানান, ক্যাম্পের এইচ ব্লকে আবদুল হাকিমের দোকানের সামনে দুর্বৃত্তরা জয়নালকে ছুরিকাঘাতের মাধ্যমে হত্যা করে পালিয়ে যায়। হামলাকারীরা চিহ্নিত ডাকাত নুরুলের লোকজন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

গোপন সূত্রে কিছু রোহিঙ্গা জানান, নয়াপাড়া ক্যাম্পের পেছন দিকের পাহাড়ে রোহিঙ্গাদের দুটি সন্ত্রাসী গ্রুপ ঘাঁটি গেড়েছে। আবদুল হাকিম ও মো. হাসান এই দুই সন্ত্রাসী  গ্রুপের নেতা। খুন, ধর্ষণ, ইয়াবা কারবার, মানব পাচার, অপহরণের মতো সকল  জঘন্য  অপরাধী  তারা করছে। এই অপরাধী  কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতায় তারা গত মাসে ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার মোহাম্মদ ইলিয়াছ সহ মোহাম্মদ ইয়াসের নামে এক রোহিঙ্গা তরুণকে গুলি করে হত্যা করে।

তথ্যের ভিত্তিতে জানা গেছে, উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে ২৮ ফেব্রুয়ারি হামলায়  দুই জার্মান সাংবাদিক আহত হওয়ার ঘটনায় একদল রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী জড়িত ছিল। প্রাথমিকভাবে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে উঠে এসেছে, অর্থ ও মূল্যবান মালপত্র ছিনিয়ে নেওয়াই ছিল তাদের হামলার মূল উদ্দেশ্য।

সূত্রে জানা যায়, সন্ত্রাসী চক্রটি প্রত্যাবাসনের বিরুদ্ধে। প্রত্যাবাসনের পক্ষে কথা বলায় বালুখালী ক্যাম্পের হেড মাঝি আরিফ উল্লাহকে গত বছর ১৮ জুন গলা কেটে হত্যা করে তারা। পরে এই রোহিঙ্গা নেতার পরিবারের সদস্যরা ভয়ে টেকনাফের লেদায় পালিয়ে যান।

উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল খায়ের জানান, রোহিঙ্গাদের জনপ্রিয় নেতা আরিফ উল্লাহ প্রত্যাবাসনের পক্ষে থাকায় তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে তদন্তে উঠে এসেছে। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে অপরাধ দিন দিন বাড়ছে।

একাধিক সূত্রের বরাতে জানা গেছে,  মিয়ানমার সেনাবাহিনী গোপনে বাংলাদেশে আশ্রয় প্রাপ্ত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে মদদ দিচ্ছে। এমনকি প্রাথমিকভাবে ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের মধ্যে একটি দালাল গ্রুপও তৈরি করে দিয়েছে তারা।

আরও জানা গেছে, এই সকল অপরাধী কর্মকাণ্ডের জন্য দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা গোপনে বিপুল অর্থের যোগান দিচ্ছে।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের এক পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে, গত ১০ মাসে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী চক্রের হাতে ২৩টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এ সময়ে ক্যাম্প থেকে উদ্ধার হয়েছে ২৩টি অস্ত্র ও বিপুল পরিমাণ মাদক।

এ ব্যাপারে উখিয়ায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আন্দোলনের নেতা মাহমুদুল হক চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গারা এখন দেশের জন্য বিষফোড়া। তাদের কারণে এখন চরম বিপদের মধ্যে রয়েছে প্রায় ২ লাখ স্থানীয় মানুষ। দিন দিন রোহিঙ্গারা সহিংস হয়ে উঠছে। কথায় কথায় তারা স্থানীয় লোকজনের ওপর চড়াও হচ্ছে।

কক্সবাজারে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার আবুল কালাম বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আসলে কত সময় লাগবে, তা নিয়ে সবাই উদ্বেগে রয়েছে। তবে রোহিঙ্গাদের জন্য সর্বোচ্চ মানবিকতা দেখানো হচ্ছে। এরপরও আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটাতে থাকলে সরকার কঠোর হতে বাধ্য হবে।

কক্সবাজার পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ ইকবাল হোসেন বলেন, যতই দিন যাচ্ছে, রোহিঙ্গাদের আচার-আচরণে ততই পরিবর্তন আসছে। তারা বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে। তবে এসব ঝুঁকি মাথায় রেখেই দায়িত্ব পালন করা হচ্ছে।

কক্সবাজার পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের নেতা অ্যাডভোকেট আয়াছুর রহমান বলেন, আশ্রয় শিবিরে রোহিঙ্গাদের একটি সন্ত্রাসী চক্র অবৈধ অস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায়। এই অস্ত্র স্থানীয়দের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তিনি।

Bootstrap Image Preview