Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ১৯ রবিবার, মে ২০২৪ | ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

নারীরা কি তাহলে মানুষ হয়ে উঠতে পারেনি!

নারী ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৮ মার্চ ২০১৯, ০১:৫১ PM
আপডেট: ০৮ মার্চ ২০১৯, ০১:৫১ PM

bdmorning Image Preview


‘আমরা ভাবছি, এগোচ্ছি পথ-
তোমরাও হাত ধরো, হাঁটো যথাযথ।’

আন্তর্জাতিক নারী দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য: ‘‘সবাই মিলে ভাবো, নতুন কিছু করো নারী-পুরুষ সমতার নতুন বিশ্ব গড়ো’’। 

ইতিহাসে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ উদযাপনের পেছনে রয়েছে নারী শ্রমিকের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ইতিহাস। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মজুরি বৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিলেন সুতা কারখানার নারী শ্রমিকেরা। সেই মিছিলে চলে সরকারি লেঠেল বাহিনীর দমনপীড়ন।

১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে নিউইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োাজিত নারী সমাবেশে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে সর্ব প্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন হল। ক্লারা ছিলেন জার্মান রাজনীতিবিদ, জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির স্থপতিদের এক জন। এর পর ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে ডেনমার্কের কোপেনহাগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। ১৭টি দেশ থেকে ১০০ জন নারী প্রতিনিধি এতে যোগ দিয়েছিলেন। এ সম্মেলনে ক্লারা প্রতি বৎসর ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেন। সিদ্ধান্ত হয়, ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ থেকে নারীদের সম অধিকার দিবস হিসেবে দিনটি পালিত হবে। দিবসটি পালনে এগিয়ে আসে বিভিন্ন দেশের সমাজতন্ত্রীরা। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে বেশ কয়েকটি দেশে ৮ মার্চ পালিত হতে লাগল। অতঃপর ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। দিবসটি পালনের জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রকে আহ্বান জানায় রাষ্ট্রসংঘ। এর পর থেকে সারা পৃথিবী জুড়েই পালিত হচ্ছে দিনটি নারীর সমঅধিকার আদায়ের প্রত্যয়ে। বিশ্বের অনেক দেশে আন্তর্জাতিক নারী দিবস আনুষ্ঠানিক ভাবে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়। তার মধ্যে রয়েছে- আফগানিস্তান, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, বেলারুশ, বুরকিনা ফাসো, কম্বোডিয়া, কিউবা, জর্জিয়া, গিনি বিসাউ, ইরিত্রিয়া, কাজাখস্তান, কিরগিজিস্তান, লাওস, মলদোভা, মঙ্গোলিয়া, মন্টেনিগ্রো, রাশিয়াা, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, উগান্ডা, ইউক্রেন, উজবেকিস্তান, ভিয়েতনাম এবং জাম্বিয়া। এ ছাড়াও, চিন, ম্যাসিডোনিয়া, মাদাগাস্কার, নেপালে শুধুমাত্র নারীরাই সরকারি ছুটি পেয়ে থাকেন। 

ফার্মার কিন্তু প্রথম নারীই। নারীই আবিস্কার করলো বীজ থেকে বৃক্ষের জন্ম রহস্য। অসুস্থ থেকে সুস্থতার এবং ওষধি থেকে ঔষধ। বাসগৃহের ভিত্তিতেও ছিলো প্রথম নারী এবং নারীর গর্ভেই জন্ম নেয় প্রথম কৃষক। অর্থাৎ কৃষি শ্রমিক। এভাবেই বিশ্বের যা কিছু প্রথম তার আবিস্কারক নারী। এ প্রসঙ্গে ERECLUS বলেছেন, মানুষ যে মানুষ হতে পেরেছে, সেই মানবগোষ্ঠীর পুরোটাই নারীর কাছে ঋণী। সেই গৃহের প্রতিষ্ঠাকারী, শিল্পের আবিস্কারক-সভ্যতার আদি রূপকার। 

নারীর জীবনচক্রের সকল পর্যায়ে সর্বোচ্চ মানের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য লাভের অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্টের দায়িত্ব। এইডসসহ সকল ঘাতকব্যাধি প্রতিরোধ করা, বিশেষত গর্ভকালীন স্বাস্থ্যসহ নারীর স্বাস্থ্য সর্ম্পকিত গবেষণা করা এবং স্বাস্থ্য তথ্যের প্রচার ও সচেতনতা বৃদ্ধি করা। নারীর স্বাস্থ্য, শিশুর শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি, কর্মস্থলে মায়ের কর্মক্ষমতা বাড়ানো ও মাতৃবান্ধব কর্ম পরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মায়ের বুকের দুধের উপকারিতার পক্ষে যথোপযুক্ত আইন প্রণয়ন করার যৌক্তিকতা যুক্তিযুক্ত। 

প্রতিদিনই নারী ঘরের বাইরে বের হচ্ছে, এর মাধ্যমেই তারা স্ব স্ব পেশাগত দক্ষতার উন্নতি ঘটাচ্ছে। আমাদের নারীদের নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে অফিস-আদালতে কাজ করতে হয়। এটা যে শুধু টাকার জন্য, ক্ষেত্রবিশেষে তাও নয়; বরং আত্মমর্যাদাবোধকে সমুন্নত রাখতেই নারীদের এই প্রচেষ্টা।

আমাদের অনেক সম্ভাবনা আছে। প্রতিটি নারীর মধ্যে আত্মমর্যাদা ও উদ্ভাবনী মন থাকা প্রয়োজন। সংগ্রামের মাধ্যমে আত্মত্যাগের অতীত ইতিহাস আমাদের আছে। প্রয়োজনে সেই অতীত অভিজ্ঞতায় প্রজ্বলিত হতে হবে। নিজের ভেতর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণধর্মী মন থাকতে হবে। আত্মসমর্পণ নয় বরং আত্মউন্নতিই লক্ষ্য হতে হবে। 

আমি একজন নারী এবং সমাজকর্মী। নতুন প্রজন্মকে পাহাড় কেটে গড়ে ওঠা পথে আরো নতুন পথ তৈরি করতে হবে। জীবনের বাঁকে বাঁকে শিক্ষা, অভিজ্ঞতা নিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নারীর বিকাশের জন্য আজ অনেক অপ্শন সৃষ্টি হয়েছে। এসবের মধ্য থেকে মোর ব্রাইট অপ্শনকে বেছে নিতে হবে। প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেকট্রিক মিডিয়াসহ তথ্যপ্রযুক্তি, উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে নিজেদের অবস্থানকে আরো দৃঢ় করতে হবে। আমরা জানি, নারীরা আজ দেশের অনেক উচ্চাসনে অধিষ্টিত হয়ে তাদের যোগ্যতা আর মেধা দিয়ে দেশকে গড়ে যাচ্ছেন নিরন্তর। তবে এছাড়াও বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোতে রাষ্ট্রদূতসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন, পরিকল্পনা কমিশন ও বিচার বিভাগের উচ্চপদে নারী নিয়োগের উদ্যোগ গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি। জাতীয় পর্যায়ে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের রাজস্ব ও উন্নয়ন বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করা জরুরী। নারী উন্নয়নের সাথে সম্পৃক্ত সকল মন্ত্রণালয় /বিভাগ /সংস্থায় নারী উন্নয়নের জন্য লক্ষ্যমাত্রা ও কর্মসূচি চিহ্নিত করে পর্যায়ক্রমে অতিরিক্ত বাজেট বরাদ্ধ করার মাধ্যমে নারীকে আরো শক্তিশালী নেটওয়ার্কের আওতায় এনে ‘ভিশন ২০২১’ কে সার্থকতা দিতে আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

একথা সত্য যে, আমরা এখনো অনেক প্রতিকুলতার মধ্যে আছি। প্রতিদিনই আমাদের চারপাশে শারীরিক এবং মানসিক নানাভাবে নারী নির্যাতন সংঘটিত হচ্ছে। সম্প্রতি নারীদের পাশাপাশি বিশেষ করে শিশু, কিশোরীরাও এতে নতুন ভাবে যুক্ত হচ্ছে। তাদেরকে নির্যাতন শেষে হত্যা পর্যন্ত করতে পিছপা হচ্ছেনা এই নৃশংসকারীরা। এই যশোর শহরেই আট বছরের শিশু তৃষাকে কি নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। তাছাড়া সারা দেশেই ইলোরা, পিংকি, সিনথিয়া, সীমা, রুমিসহ অসংখ্য নাম যুক্ত হচ্ছে প্রতিদিন। তাদের কিছু কিছু বিচারও হচ্ছে। তৃষা খুনের আসামীকে ক্রসফায়ার দেয়া হয়েছে। অভিনন্দন জানাই প্রশাসনকে। এভাবেই যদি এই অপরাধগুলোর তাৎক্ষনিক বিচার করা হয়, তাহলে বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় এই মরণ ব্যাধির কিছুটা হলেও উন্নতি হবে বলে আশা করছি। এছাড়াও নতুন পথ তৈরি করে হলেও প্রগতির পথে, আধুনিকতা ও উন্নতির পথে আমাদেরকে অগ্রসর হতেই হবে। আমরা জানি, খ্যাতি, জনপ্রিয়তা বা কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠা পাবার শর্টকাট কোন রাস্তা নাই। পরিশ্রম ও ডেডিকেশনের মাধ্যমেই এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। এই দুটো গুণ থাকলে তাকে কেউ আটকাতে পারবে না। পরিশ্রমই প্রথম এবং পরিশ্রমই শেষ। 

আমাদের সমাজে আজ যেটা বেশি প্রয়োজন, তা হলো সচেতনতা। এজন্য প্রয়োজন শিক্ষিত জনগোষ্ঠী। নারী অধিকার সম্পর্কে বহুমাত্রিক সেমিনার ও সভা করে সর্বসাধারণকে সচেতন করতে হবে। আমাদের দেশের নারীরা যথেষ্ট মেধাবী। কিন্তু তারা সে অনুযায়ী বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্য দেখাতে পারছেন না। কারণ পারিবারিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ইত্যাদি সমস্যা তাদের অগ্রগতির পথে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে। ব্যক্তিজীবনে স্বামী-স্ত্রী পরষ্পরকে সাপোর্ট দেবার মাধ্যমে উভয়ের মেধার বিকাশ সম্ভব। নারী ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতা এবং অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তি বিনিময়ের মাধ্যমে আঞ্চলিক, উপ-আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতাকে উৎসাহিত করা এখন সময়ের দাবী।

দিনশেষে একটা প্রশ্নই মাথায় ঘোরপাক খায় যে নারীরা কি তাহলে মানুষ হয়ে উঠতে পারেনি! 
 

লেখক: ড. শাহনাজ পারভীন

কবি,গদ্যকার ও গবেষক

Bootstrap Image Preview