আচ্ছা, ঢাকায় থাকেন আপনি? সকাল ৯ টা। শ্যামলী ওভারব্রীজের নিচে। প্রায় ১০০ জন পুরুষ আর ১০ জন মেয়ে দাঁড়িয়ে বাসের জন্য। যে কোনও বাস আসতেই হুড়মুড় করে দৌড়ে ছেলেরা উঠে যাচ্ছে, মেয়েরা একটু এগুতেই হেল্পার না করে দিচ্ছে, লেডিস সিট নেই ! এখন সেই মেয়েটি কি লেগুনার পিছে ঝুলে ঝুলে যাবে? তাও না। আবার মধ্যবিত্ত পরিবারের ঐ মেয়ে প্রতিদিন সিএনজিতেও ওঠে না, ঘোর বিপদে সিএনজি টাকা দিয়েও পাওয়া যায় না, পেলেও মেয়েটা নিরাপদ তো তাতে একা একা? এই প্রশ্নের উত্তর আপনি বা আমি খুঁজব না, কিন্তু এটা ঠিকই দেখব, সে সময় মতন ক্লাসে, অফিসে হাজির, এই জন্য যা করার সেই মেয়েটাকেই করতে হয়! সে সিটিং বাসের দরজা চাপড়ে ঠেলে উঠেনা, সে অপরিচিত লোকের সাথে শেয়ার করে সিএনজিতেও ওঠে না, তবুও তার সব কাজ করে যেতে হয়, "ম্যানেজ" করে !
কিন্তু দিনশেষে কি সে তার কাজের সঠিক মূল্যায়ন পায়?
ডেনিম গ্রুপের মার্কেটিং এসিস্টেন্ট মারুফা তাবাসসুম। এ বছরের জানুয়ারিতে তার বড় রকমের প্রমোশন হয়। কিন্তু এখনো অব্দি নতুন এক চাকরির সন্ধানে রয়েছেন তিনি। ভেঙ্গে পড়েছেন মানসিকভাবেও। কারণ হিসেবে তিনি জানান, প্রমোশনের আগে অফিসের স্টাফদের সাথে তার বেশ ভালো সম্পর্কই ছিল। কিন্তু যখন প্রমোশন হলো তারপর থেকেই তাকে নিয়ে কটুক্তি আর কানাঘোষা শুরু হয়ে যায় পুরো অফিস জুড়ে। কেউ বলে বসের সাথে কফি খায়, কেউ বলে আরেহ না শুধু কফিশপে না বাসাতেও যায়। থেমে নেই নারী সহকর্মীরাও। হাসাহাসি নানানরকম টিপ্পনি মিলে ক্রমই অসহ্য হয়ে পড়েছে সবকিছু।
সোনিয়া আক্তার। পাঁচ বছর ধরে এক্যটি বেসরকারী ফার্মে কর্মরত। তিনিও অন্বেষণে রয়েছেন নতুন চাকরির। তার অভিযোগ বৈষম্যতা নিয়ে। তিনি বলেন, সকাল ৯ টা থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত অফিস করি। একই পদে থাকা স্বত্তেও আমার পুরুষ সহকর্মীর বেতন আমার থেকেও বাড়ছে। প্রতিবছরই সেটা বাড়ছে কিন্তু আমার তেমন কোনো গতি নেই। কর্তৃপক্ষের কাছে জিজ্ঞেস করতে গিয়ে যখন বলে দিলাম চাকরি ছেড়ে দিব তখন উলটো হেসে জবাব দিলেন, হে আজকেই চলে যেতে পারো সোনিয়া। এই পদে তোমাকে যে বেতন দেয়া হয় সেটা দিয়ে দুইজন মেয়ে কর্মী রাখা যাবে।
এটা শুধু মারুফা কিংবা সোনিয়ার বাস্তবিক অবস্থা না। এটা গোটা সমাজ, গোটা দেশ এমনকি গোটা বিশ্বের আবছায়া চিত্র। সেই সূত্র ধরে ভারতের একটি চিত্র তুলে ধরেছেন মনস্টার স্যালারি ইনডেক্স।
নারী দিবস মহাসমারোহে পালন করে মুখে যতই নারীর সমানাধিকারের কথা বলা হোক না কেন, ভারতে এখনও কর্মক্ষেত্রে পুরুষকর্মীরা ১৯% বেশি বেতন পেয়ে থাকেন একই পদে থাকা মহিলাকর্মীদের থেকে।
এমন চাঞ্চল্যকর তথ্যই উঠে এসেছে মনস্টার স্যালারি ইনডেক্স সার্ভের সাম্প্রতিকতম রিপোর্টে। যেখানে দাবি করা হয়েছে, প্রতি ঘণ্টা কাজ করার জন্য যেখানে মহিলারা ১৯৬.৩০ টাকা করে পাচ্ছেন, সেখানে একই কাজ করে পুরুষরা ১৯% বেশি ২৪২.৪৯ টাকা পাচ্ছেন।
নারীর সমানাধিকারের চেষ্টায় গত এক বছরেও যে দেশ বিশেষ এগোতে পারেনি তারও প্রমাণ মিলেছে সমীক্ষায়। যেখানে দেখা যাচ্ছে, আগের বছরে যেখানে নারী-পুরুষের মধ্যে বেতনের ব্যবধান ২০% ছিল, চলতি বছরে তা কমেছে মাত্র ১%।
এ প্রসঙ্গে মনস্টার(ডট)কম-এর চিফ এগজিকিউটিভ অফিসার অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়ের দাবি, 'সরকারি-বেসরকারি, উভয় তরফে চেষ্টার পরেও, এক বছরে যদি লিঙ্গভেদে বেতনের ফারাক মাত্র ১% কমার চিহ্ন দেখা যায়, তাহলে তা সত্যিই চিন্তার বিষয়।
শুধু তাই নয়, সেক্ষেত্রে নিজেদের কাছেই প্রশ্ন উঠে যায়, সত্যিই কি আমরা এই ব্যবধান ঘোঁচাতে আন্তরিক ভাবে উদ্যোগী হয়ে পদক্ষেপ করছি?' তাঁর মতে, সত্যিই এই ফারাক কমাতে চাইলে, শিল্পক্ষেত্র এবং কর্পোরেট ক্ষেত্র, উভয় জায়গাতেই বিশেষ ভাবে নিয়োজিত দলের উপর ভার দিয়ে, তাদের সুপারিশমতো পদক্ষেপ করার প্রয়োজন রয়েছে।
তবে কর্মক্ষেত্রে স্তর নির্বিশেষে যে বেতনের ব্যবধান ২০ শতাংশ এমনটা ভাবলে ভুল হবে বলে জানানো হয়েছে রিপোর্টে। সমীক্ষা চালানোর সময় দেখা গিয়েছে, দেশে অর্ধ-শিক্ষিত (সেমি-স্কিলড) কর্মীদের মধ্যে মহিলা-পুরুষের বেতনে কোনও ফারাক নজরে না এলেও দক্ষ কর্মীদের মধ্যে (স্কিলড) ব্যবধান এক ধাক্কায় বেড়ে ২০ শতাংশে দাঁড়িয়ে গিয়েছে।