Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ১০ শুক্রবার, মে ২০২৪ | ২৬ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

পাক-ভারত যুদ্ধে যেভাবে মোদিকে হারালেন ইমরান

আন্তর্জাতিক ডেস্ক-
প্রকাশিত: ০৪ মার্চ ২০১৯, ০৬:২৮ PM
আপডেট: ০৪ মার্চ ২০১৯, ০৬:২৮ PM

bdmorning Image Preview
সংগৃহীত ছবি


সম্প্রতি সময়ে পাক-ভারত সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। পাকিস্তান তাদের হাতে আটক ভারতীয় পাইলটকে ছেড়ে দেবার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা কমবে বলে এখন ধারণা করা হয়। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে গত কয়েকদিনের এই সঙ্কটে মানুষ যা দেখল বা বুঝল তাতে জিতল কোন পক্ষ? নরেন্দ্র মোদি আর ইমরান খানের কৌশলের লড়াইয়েই বা কে বিজয়ী হলেন?

গত বৃহস্পতিবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান পার্লামেন্টে শান্তির বার্তা দিতে আটক ভারতীয় পাইলটকে মুক্তি দেয়ার ঘোষণা দেন।

ইমরান খানের এই ঘোষণার সময় দিল্লিতে বিজ্ঞানীদের একটি সম্মেলনে ভাষণ দিচ্ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ইমরানের ওই ঘোষণার কয়েক মুহূর্ত পরেই মোদি পাকিস্তানকে বিদ্রূপ করে বলেন, ‘পাইলট প্রজেক্ট শেষ এখন আমাদের আসল খেলায় নামতে হবে।’ পাইলট প্রজেক্ট বলতে তিনি পাইলট আটকের ঘটনাকে এক ধরনের পরীক্ষা বলে ইঙ্গিত করে থাকবেন।

তার সমর্থকরা তার এই বক্তব্যে উল্লাস প্রকাশ করলেও বিচক্ষণ অনেকেই কিন্তু তার এই মন্তব্যকে রুচিহীন ও উদ্ধত বলে মনে করেছেন।

গত মঙ্গলবার ভোররাতে ভারতীয় জঙ্গী বিমান যখন পাকিস্তানের আকাশসীমায় ঢোকে এবং কথিত সন্ত্রাসী প্রশিক্ষণ শিবিরে হামলা চালায়, তখন মোদি বিশাল এক নির্বাচনী জনসভা শুরু করেন এই বলে - ‘আমি আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই যোগ্য নেতৃত্বের হাতে এই দেশ নিরাপদ।’

মোদির এই বিবৃতি প্রদানের ২৪ ঘন্টা যেতে না যেতেই ভারতীয় যুদ্ধবিমানকে গুলি করে ভূপাতিত করে পাকিস্তান। এসময় আজাদ কাশ্মীর থেকে ওই বিমানের পাইলট আভিনন্দন বর্তমানকেও বন্দি করা হয়।

এই পরিস্থিতিতে দুই পক্ষের ওপর উত্তেজনা প্রশমনের জন্য প্রচুর চাপ ছিল। এসময় ইমরান খান এগিয়ে আসেন পাইলটকে মুক্ত করার প্রস্তাব নিয়ে।

এ প্রসঙ্গে ভারতের সাবেক কূটনীতিক এবং কৌশলগত বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কে সি সিং বলেন মোদির বিজেপি দল এবং ভারতীয় প্রশাসনের ‘ইমরান খানের কূটনৈতিক রিভার্স সুইং-এর জবাব দেয়া কঠিন হবে।’

২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে মোদি নিজের একটা ‘আপোষহীন’ ভাবমূর্তি বজায় রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আর তার জাতীয়তাবাদী ভাবমূর্তিকে আনুগত্যের সঙ্গে উজ্জীবিত রেখেছে স্থানীয় গণমাধ্যমে তার সমর্থক বড় একটা অংশ। এই পটভূমিতে অনেকের মনেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, যখন তার দেশ একটা ক্রান্তিকালে এসে দাঁড়িয়েছে এবং পরমাণু শক্তিধর প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে যুদ্ধে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখনও মোদি তার ‘আপোষহীন’ ব্যক্তিত্ব বজায় রাখেন। তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘর্ষ নিয়ে জাতির উদ্দেশ্যে বক্তব্য না রেখে সরকারের আমলা ও সেনাবাহিনীকে দিয়ে কথা বলান।

এ নিয়ে ভারতের বড় বিরোধী দলগুলোর মধ্যে অন্তত ২১টি দল মোদির কড়া সমালোচনা করেছে। তাদের ভাষ্য, ভারতে চলমান সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা সঙ্কটের মধ্যেও মোদি তার নির্বাচনী জনসভা, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এমনকী মোবাইল অ্যাপস উদ্বোধন অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার কর্মসূচি চালিয়ে গেছেন।

অনেকেই বলছেন পাকিস্তান দ্রুত পাল্টা হামলা চালিয়ে ভারতের জঙ্গী বিমান ভূপাতিত করে এবং বিমানের পাইলটকে আটক করে মোদিকে কোণঠাসা করে দিয়েছে।

পাইলটকে বন্দি করার মাত্র একদিন পরেই ইমরান খান বৈরীতা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন, শান্তির কথা বলেছেন এবং পাইলটকে মুক্তি দেবার ঘোষণা দিয়েছেন।

কে সি সিং বলছেন বলছেন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিজের ‘একটা সম্মানজনক ইমেজ তৈরি করেছেন এবং তিনি আলোচনার মাধ্যমে দুপক্ষের বিবাদ মীমাংসার জন্য তৈরি’ এমন একটা ভাবমূর্তি তুলে ধরেছেন।

ইমরান খানের ভারতীয় পাইলটকে ফিরিয়ে দেবার দ্রুততম সিদ্ধান্ত নয়াদিল্লি এমনকি আন্তর্জাতিক মহলকেও বিস্মিত করেছে।

ভারতের সঙ্গে চলা সঙ্কটের সময়ও ইমরান খান তার দেশের জনগণের উদ্দেশ্যে কথা বলেছেন, তার প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন এবং গণমাধ্যমকে সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে নিয়মিত অবহিত করেছেন।

ভারতের অনেক বিশ্লেষক বলছেন,পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান নিজেকে একজন ‘গ্রহণযোগ্য নেতা’ হিসাবে প্রমাণ করেছেন, যিনি ভারতকে কোণঠাসা করার চেষ্টা না করে বৈরীতা বন্ধের একটা শান্তির প্রস্তাব করেছেন।

অন্যদিকে মোদিকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি যেন পরিস্থিতির ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছেন। ঐতিহাসিক ও লেখক শ্রীনাথ রাঘাবান বলছেন, ‘আপনি যেভাবেই দেখার চেষ্টা করুন না কেন, পাকিস্তানের পাল্টা হামলায় ভারত হতচকিত হয়ে পড়েছে।’

বিবেচনার বিষয়টা হল- ১৪ ফেব্রুয়ারি পুলওয়ামার হামলায় ৪০ জনের বেশি ভারতীয় আধাসামরিক সেনা নিহত হবার পর ভারত প্রতিশোধমূলক হামলা চালায় রাতের অন্ধকারে। অন্যদিকে পাকিস্তান জবাব দেয় দ্রুত এবং সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে, পরের দিনই একেবারে প্রকাশ্য দিবালোকে।

‘প্রতিশোধ সঠিক কৌশল নয়’

ভারতীয় পাইলট ধরা পড়ার ঘটনা যেহেতু ছিল অপ্রত্যাশিত, তাই এরপর মোদি ও তার সরকারকে দেখা যায় ভিন্ন সুরে কথা বলতে। তখন তাদের কাছে মূল বিষয় হয়ে দাঁড়ায় পাইলটকে ভারতে ফিরিয়ে আনা। পাকিস্তানের পাল্টা হামলার পর সেনাবাহিনী তাদের ব্রিফিং দেয় ৩০ ঘন্টা পর। আসলে মোদি ও তার সরকারের ব্যাখ্যা দেবার জায়গাটা স্পষ্টতই ছিল খুবই সীমিত।

পাকিস্তান ভিত্তিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠিগুলোর উস্কানি থেকে একটা নিরাপত্তা সঙ্কট সৃষ্টি হওয়া ভারতে নতুন কোন ঘটনা নয়। মোদির আগে অটল বিহারী বাজপেয়ী এবং মনমোহন সিংকেও একই ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে। যেখানে আক্রমণ চালানোর সামরিক ক্ষমতা থাকলেও হিসাব করে তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে যাতে উত্তেজনার পারদ না চড়ে যায়। এ সম্পর্কে ভারতীয় ঐতিহাসিক রাঘাবান বলছেন, ‘প্রতিশোধ কখনই কৌশলগত লক্ষ্য হতে পারে না। আবেগতাড়িত হয়ে কৌশল ঠিক করলে তাতে ব্যর্থ হবার বড় সম্ভাবনা থাকে।’

ভারতের গণমাধ্যমগুলোর একটা বড় অংশ ভারতীয় পাইলটকে মুক্তি দেবার ঘটনাকে মোদির বিজয় হিসাবে তুলে ধরেছে। খুব কমজনই প্রশ্ন তুলছেন পুলওয়ামার হামলা গোয়েন্দা তথ্যের ব্যাপক ব্যর্থতার কারণে ঘটেছিল কিনা, কিংবা পাকিস্তান প্রকাশ্য দিবালোকে ভারতের প্রতিরক্ষা দুর্গ ভেদ করল কীভাবে?

এছাড়াও পাকিস্তানের ভেতর সন্ত্রাসীদের কথিত প্রশিক্ষণ শিবিরে ভারতীয় জেট হামলা চালিয়ে কতটা ক্ষয়ক্ষতি করতে পেরেছে সে চিত্রও এখনও স্পষ্ট নয়। ওই আক্রমণে ঠিক কতজন মারা গেছে সে বিষয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এখনও পরিষ্কার করে কিছু জানাতে পারেনি। যদিও গণমাধ্যমের একাংশ খোলাখুলিভাবে প্রায় ৩০০ জঙ্গি নিহত হবার খবর দিয়ে গেছে।

কাজেই এসব কঠিন প্রশ্ন নিয়ে মোদির ভাবার সময় এসেছে এবং তার বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্যতা হারাতে বসেছে কিনা তা নিয়েও তার মাথাব্যথার কারণে তৈরি হয়েছে। যদিও কেউ কেউ বলছেন ইমরান খান হয়ত তার দেশবাসীর কাছে, এমনকি ভারতেও বহু মানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণের লড়াইয়ে জিতে গেছেন।

Bootstrap Image Preview