Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৯ সোমবার, এপ্রিল ২০২৪ | ১৫ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

মান্দায় নিজ উদ্যোগে কৃষি জাদুঘর গড়ে তুলেছেন জাহাঙ্গীর আলম শাহ্

সুলতান আহমেদ, মান্দা (নওগাঁ) প্রতিনিধিঃ
প্রকাশিত: ০২ মার্চ ২০১৯, ১২:৪৫ PM
আপডেট: ০২ মার্চ ২০১৯, ১২:৪৫ PM

bdmorning Image Preview


জাহাঙ্গীর আলম শাহ পেশায় যিনি একজন শিক্ষক। গত কয়েক বছর আগে নিজ উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন কৃষি জাদুঘর। ছোটবেলা থেকেই কৃষি কাজ নিয়ে সব সময়ই ভাবতেন। বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ, তাই গ্রামাঞ্চলে জন্ম বলেই স্বপ্ন ছিল কৃষিকাজের প্রতি। তিনি সব সময় ভেবেছেন গ্রামের কৃষক কৃৃষানিদের জন্যে কিছু করা যায় কিনা। মনের এ ভাবনায় এক সময় গড়ে তোলেন কৃষি পাঠাগার।

তিনি গ্রামাঞ্চলে তেমন কৃষি তথ্যভান্ডার আছে কিনা তা তখন লক্ষ করেননি। কোন পরামর্শ প্রদানের কেন্দ্র আছে কিনা তাও জানতেন না। সুতরাং সেই বিষয়েই পড়ালেখা করবার পরিকল্পনা নিয়েই সংগ্রহ করতে লাগলেন অজস্র বই। তাই তো তিনি পরিণত বয়সে এসে কৃষি তথ্য পাঠাগারের মতো একটি মহৎ কাজে সফলতা অর্জন করেছেন। এমন এ পাঠাগারের সুনাম বৃদ্ধি পেলে তিনি শাহ্ কৃষি জাদুঘর হিসেবেই পরিচয় তোলে ধরেন। গ্রামের মাটির ঘরেই এমন এই 'শাহ্ কৃষি জাদুঘর'।

২০০০ সালের ১৮ এপ্রিল এই কৃষি তথ্য জাদুঘরটির যাত্রা শুরু। এমন এই কৃষি তথ্য জাদুঘরের পাশাপাশি তিনি রাজশাহী শহরের পদ্মা নদীর তীর ঘেঁষে অবস্থিত রাজশাহী কলিজিয়েট স্কুলের শিক্ষক। পরিশ্রমী এবং মেধাবী এই শিক্ষক অনেক কষ্ট করেই শহর থেকে গ্রামে গিয়ে কৃষি তথ্য জাদুঘরটির উন্নয়নের লক্ষে নিরলসভাবেই কাজ করছেন।

বলা যায় যে, গ্রামের পুরো বাড়ি-ঘরে এবং সম্পূর্ণ বাড়ির ভিটায় এই কৃষি তথ্য জাদুঘর। কৃষি কর্মের উপর প্রায় ৭,৭০০টি বিভিন্ন ধরনের বই, পত্রিকা ও জার্নাল সংগ্রহের তালিকায় এনে অনেক নান্দনিকতার পসরা সাজিয়েছেন। এমন এই 'শাহ্ তথ্য কৃষি জাদুঘর' চত্বর সত্যিই এখন দৃষ্টি নন্দনে পরিপূর্ণতা পেয়েছে। সেখানে রয়েছে ২৬০ প্রজাতির ঔষধি গাছ।

স্থানীয় কৃষক কৃষানিরা অবসরে এসেই আধুনিক কৃষি সম্পর্কে ধারণা লাভ করেন। এমন এ জাদুঘরের সাথে আরও রয়েছে ১,১১৮ টি বিভিন্ন ধরনের কৃষির উপকরণ। একটি সুবৃহৎ সংগ্রহশালা। এদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সংগ্রহ করা বিলুপ্তপ্রায় দড়ি পাকানোর ঢ্যারা, আম পাড়ার জালি বা ঠুসি, খেতের ইঁদুর মারার বিভিন্ন রকমের ফাঁদ, গরুর গলায় বেঁধে দেওয়া ঘুকরা, মুখে দেওয়া টুনা, যাঁতা, পালকির মডেল, নানান অঞ্চলের মাছ ধরার ছোট বড় বিভিন্ন ধরনের চাঁই, বিভিন্ন গ্রামের পরিচিত, অপরিচিত নানান ধরনের নিড়ানি, কাস্তে, হাতুড়ি, গাঁইতি ও শিকপাই থেকে শুরু করে হরেক রকমের জিনিসও রয়েছে এই কৃষি তথ্য জাদুঘরে।

এগুলো দেখলে যেন গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষের কৃষির প্রতি অনেক আগ্রহ জন্ম নেয়। সহজেই যেন সারা গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র কৃষকরা স্মরণে এনে কর্মে প্রতিফলন ঘটাতে পারেন। মনে পড়বে তাদের এমন সংগ্রহ বস্তু গুলো যা ছিল অতীতের সমৃদ্ধশালী গ্রাম বাংলার কৃষি উপকরণ, বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া অনেক লোকায়ত কৃষি চর্চার কথা। এমনই বহু কৃষি সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রদানের জন্য বহুমুখী সু-ব্যবস্থা রেখেছেন। এই জাদুঘরটির যেখানে বই রয়েছে তার বাহিরে সুন্দর দেয়ালে টাংগানো আছে কৃষকের অভিজ্ঞতা নিয়েই তৈরি করা বহু শস্য বা ফসলের বারোমাসি পঞ্জিকা। তাছাড়াও রয়েছে ভার্মী কম্পোস্ট, জৈববালাই সহ কৃষকদের সব কিছু হাতে কলমে করে দেখানোর বিভিন্ন আয়োজন।

এমন কৃষি জাদুঘর চত্বরটির চারধারে নানা জাতীয় বহু ঔষধি ও বহু বৃক্ষলতায় যেন ভরপুর। এমন শাহ্ কৃষি তথ্য জাদুঘর চত্ত্বরের পরিবেশে ঔষধি গুণাবলী সম্পন্ন ২০৪ ধরনের গাছ গাছালি এবং ৫০টির অধিক ফলজ গাছে মনোরম দৃশ্যপটের সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খোলা থাকে এই জাদুঘর। বই পড়তে সদস্যদের কোনই ফি বা চাঁদা দিতে হয় না। কৃষি বিষয়ক বই-পুস্তক ও ম্যাগাজিন ছাড়াও বাস্তব জীবনে কৃষকদের প্রয়োজনীয় যেমন পশু পালন, মৎস্য চাষ, ভেষজ জাতিও সব বিষয়ের অনেক নামিদামি বই রয়েছে।

কৃষির পাশাপাশিও রয়েছে অনেকগুলো ভ্রমণের বই, ছোট গল্প, প্রবন্ধ, ধাঁধাঁ, চিত্রাংকনের মতো অজস্র বই। তাছাড়া আরও রয়েছে প্রশাসন, চিকিৎসা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার জন্যেও প্রয়োজনীয় বই এবং এদের কাছে যোগাযোগের জন্যে ফোন নম্বর সংগ্রহে রেখেছেন। ব্যবহারিক শিক্ষায়, এই 'শাহ্ কৃষি তথ্য জাদুঘরে' কৃষকদের হাতে কলমেই উপকারী পোকা অপকারী পোকা চেনানো ব্যবস্থা রয়েছে।

কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন প্রকারের তথ্য উপস্থাপনও তিনি করেন। এমন এই পাঠাগারটির পক্ষ থেকে সন্ধ্যায় নিরক্ষর কৃষকদের সাক্ষরতা অভিযান চালান। আবার সকাল বেলায় গ্রামের সকল শিশুদের পাঠাভ্যাসের সুব্যবস্থা করে তাদের পড়া শুনার বই সহ যা যা প্রয়োজন দিয়ে থাকেন। গ্রামের গরিব, মেধাবী শিক্ষার্থীকে তালিকা এনে তাদের খাতা কলম এবং বৃত্তি প্রদানের মতো মহৎ কাজটি তিনি করেন। ফসলের মাঠ নিয়ে শিশু চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন।

এই তথ্য কেন্দ্রে কুল চাষে করণীয়, ফসলের বীজ উৎপাদনের কৌশল, ওল বীজ বিতরণ ও প্রশিক্ষণ, তাছাড়া কলেজ পর্যায়ে পড়ালেখা করা ছাত্রদের জন্য বই বিতরণ, গ্রামাঞ্চলকে মাদক মুক্ত সমাজ গঠনে কৃষকদের ভূমিকা এবং পরিবেশ সচেতনতা, মৎস্য চাষে করণীয়, ভেজাল সার চেনার উপায় ও জৈবসার তৈরি নিয়ে কর্মশালা করে থাকেন। সেই সঙ্গে জাতীয় কৃষি দিবসে কৃষকদের উৎসাহিত করবার জন্য ভালো কৃষক, ভালো শ্রমিক, ভালো হাল চাষি, ভালো বীজ তলা এবং ভালো জৈব সার প্রয়োগকারী গ্রামের কৃষক সহ মোট ১৩ টি বিভাগে উত্তীর্ণদের পুরষ্কৃত করেন।

তিনি আরও বলেছেন, স্থানীয় এলাকার কৃষকরাই শুধু নন অন্য এলাকার কৃষকরাও কৃষি তথ্য পাঠাগারের কারণে উপকৃত হচ্ছেন। এটি একটি তথ্য ভান্ডার ও বীজ ব্যাংক যা নবীন প্রজন্ম অথবা গবেষকদের জন্য শেখার তথ্য ভান্ডারও বলা যেতে পারে।

প্রতিষ্ঠাতা মোঃ জাহাঙ্গীর শাহ বলেন, আম, জাম কাঁঠাল লিচুসহ বিভিন্ন ফলজ গাছ ও ঔষধি বৃক্ষ চারা এবং বীজ মানুষের মাঝে বিতরণ করেন। কৃষি তথ্য জাদুঘরের বীজ সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ করে রাখেন, প্রয়োজনে অন্যদের মাঝে বিতরণও করেন। যাতে করে এইসব হারিয়ে যাওয়া কৃষি সম্পদগুলো টিকে থাকে।

আলাপ কালে তিনি বলেন, সুযোগ পেলেই কৃষি বিষয়ক বই ও পুরাতন হারিয়ে যাওয়া কৃষিসহ বিভিন্ন উপকরণ জোগাড় করে থাকেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি নানা জায়গা থেকে বিভিন্ন জাতের ফসলের বীজ সংগ্রহ করে, তাকে পরীক্ষা করে ভালো ফসল হলেই তা গ্রামের কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করতেন। সে ধারাটি যেন আজও তাঁর দিনে দিনে আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এ তথ্য জাদুঘরে এক অংশে দেশের প্রাচীন আমল থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ের আধুনিক কৃষির বিভিন্ন উপকরণের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। হাতে কলমে কৃষি শিক্ষার পুস্তক, লিফলেট, ম্যাগাজিন ও গবেষণাপত্র পাঠাগারে বসে অধ্যয়ন করার সুযোগ রয়েছে।

কৃষকের রক্ত গ্রুপ, ডায়াবেটিস ও পেশার মাপার যন্ত্রের সুব্যবস্থা রয়েছে এই জাদুঘরে। দেশ-বিদেশের চিকিৎসক ও কৃষি গবেষকদের বিনামূল্যে এই প্রতিষ্ঠানে থাকার ব্যবস্থাও করেছেন। এলাকাবাসী এখান থেকে কৃষিভিত্তিক প্রশিক্ষণ, চিকিৎসা সেবা, শিক্ষা উপকরণ এবং গাছের চারা বিনামূল্যে পেতে পারেন। এছাড়া তিনি কম্পিউটারে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের মাধ্যমে সবশ্রেণীর কৃষক, কৃষানিদের ২০০ প্রকার চাষাবাদের ভিডিও তথ্যচিত্র দেখিয়ে থাকেন। গ্রামের কৃষকদের জৈব পদ্ধতিতে চাষবাদের কৌশল তিনি শেখান।

এই শাহ কৃষি তথ্য জাদুঘরটির দেখভালের দায়িত্বে রয়েছে তাঁর চাচাতো ভাই লিপটন শাহ্। তিনি চাচার এমন কর্মকাণ্ডের বলেন, দেশ বিদেশের বহু গবেষক এরূপ নান্দনিক কৃষি জাদুঘরে এসে বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করেন। তাই এমন দ্বায়িত্ব পেয়ে খুব ভালো লাগে। তাঁর চাচা মোঃ জাহাঙ্গীর আলম শাহ’র কৃষি তথ্য জাদুঘরটি অনেকাংশেই বৃদ্ধি পেয়েছে। তাঁর এ জাদুঘর খুব জনপ্রিয়তাও পাচ্ছে। স্থানীয় কৃষক সহ বিভিন্ন এলাকার কৃষকরা, কৃষি বিষয়ে বিভিন্ন জ্ঞান, অভিজ্ঞতা অর্জন করে নিজ কর্মে প্রতিফলন ঘটায়।

এই জাদুঘর আরও যেন গণমানুষের কল্যাণে আসে এমন প্রচার প্রচারণাই আশা করেন। বাংলাদেশের প্রতিটি এলাকায় এ ধরনের কৃষি তথ্য জাদুঘর গড়ে উঠুক এই আশাই সদাসর্বদা করেন। তিনি খুব চেষ্টা করছেন জাদুঘরটিকে আরও সমৃদ্ধ করতে এবং যুগপোযোগী করতে। তাই জাদুঘরের জন্য একটি সেমিনার কক্ষ ও অতিথি শালা ব্যবস্থাও করেছেন। কৃষি এবং কৃষকের কল্যাণ বা উন্নয়নে তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকেই অনেকগুলো পুরস্কার পেয়েছেন। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম পুরস্কার যেমন, রোটারী ইন্টারন্যাশনাল, চ্যানেল আই নিবন্ধ প্রতিযোগিতা পুরষ্কার সহ বিভিন্ন পুরস্কারে এবং সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। সর্বশেষে যে পুরষ্কারটি তাঁর হাতে আসে তা বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে 'ব্রি পদক'।
 

Bootstrap Image Preview