নরেন্দ্র মোদি রাজনীতিতে একটি সুন্দর ডেলিভারি দিয়েছিলেন, পিচে বল ফলার পর বলের টার্ন দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিলেন পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। শেষ পর্যন্ত মাথা ঠাণ্ডা করে একটু ব্যাকফুটে গিয়ে সপাটে চালালেন ব্যাট। লেগ সাইডের ওপর দিয়ে সীমানা পার হয়ে, ছক্কা!
হ্যাঁ, বর্তমান মোদির অবস্থা এখন এমনই। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ক্রিকেটের একসময় ছিলেন দাপুটে অলরাউন্ডার। তাই মোদির ‘গুগলি’তে তাই তিনি ভয় পাননি, ব্যাট ঘুরিয়েছেন সজোরে।
পাকিস্তানের বালাকোটে বিমান হামলা চালিয়ে ইমরানকে ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছিলেন মোদি। কিন্তু দক্ষ হাতে পরিস্থিতি সামলেছেন ইমরান। অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পাকিস্তানকে চাপে ফেলে দিয়েছিল, তারাই এখন ইমরানের নীতিকে সমর্থন করছে।
গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পুলওয়ামায় দেশটির আধা সামরিক সিআরপিএফের গাড়িবহরে আত্মঘাতী হামলায় ৪০ জনের বেশি সেনা নিহত হন। পাকিস্তান ভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ‘জইশ-ই-মুহাম্মদ’ এ হামলার দায় স্বীকার করে। এ ঘটনার ১২ দিন পর গত মঙ্গলবার ভোরে পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের বালাকোটে বিমান হামলা চালায় ভারত। পরদিন দুই দেশের সেনাদের মধ্যে কাশ্মীর সীমান্তে গোলা ও গুলিবিনিময় হয়। এরই মধ্যে চলে আসে ভারতীয় উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমানের পাকিস্তানের হাতে বন্দী হওয়ার খবর।
ঠিক এই মুহূর্তটার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। বৃহস্পতিবার দেশের পার্লামেন্টের যৌথ অধিবেশনে জানিয়ে দেন, আমাদের হাতে একজন ভারতীয় পাইলট বন্দী রয়েছেন। আমরা যে শান্তি চাই, সেই নিদর্শন হিসেবে গতকাল শুক্রবার আমরা তাকে মুক্তি দেব। অর্থাৎ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক এই সংকটের মুখে পাকিস্তান অন্তত মুখে জানিয়ে দিল যে তার অবস্থান শান্তির পক্ষেই। সংকটের সমাধানে তারা আলোচনায় বসতে প্রস্তুত। এখন ভারত যদি তা না মানে, তবে স্বভাবতই দায় চাপবে মোদির ঘাড়ে।
প্রতিশ্রুতি মতো শুক্রবারই মুক্তি পেয়েছেন অভিনন্দন। এর ফলে বেকায়দায় পড়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি কি পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ফের হামলা চালাবেন? নাকি শান্তি প্রতিষ্ঠায় আলোচনায় বসবেন? এদিকে ঘনিয়ে আসছে আসন্ন লোকসভা নির্বাচন দিন। আগামী মে মাসে অনুষ্ঠিত হবে। এই বৈতরণি পার হতে জাতীয়তাবাদের ধুয়া তোলা ছাড়া মোদির হাতে আর কোনো ট্রাম্পকার্ড নেই। আর কে না জানে, পাকিস্তানকে জড়িয়ে রাখতে পারলে সেই কাজ কতটা সহজ হয়!
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদে মদদ দেওয়ার অভিযোগ নতুন নয়। আর প্রতিপক্ষ হিসেবে যখন ভারত থাকে। ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলার সঙ্গে জড়িত সন্ত্রাসীদের মদদ দেওয়ার অভিযোগ আছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া উরি হামলাতেও পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসী সংগঠনের জড়িত থাকার অভিযোগ আছে। এর শোধ নিতেই পরে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালিয়েছিল মোদির ভারত। এবার মোদির আমলেই গত কয়েক দশকের মধ্যে নজিরবিহীন বিমান হামলা চালায় ভারত। একেবারে লাইন অব কন্ট্রোল (এলওসি) অতিক্রম করে পাকিস্তানের বালাকোটে কথিত ‘জঙ্গি আস্তানায়’ হামলা চালানো হয়। ভারত বলছে, মারা গেছে তিন শতাধিক জঙ্গি। অন্যদিকে পাকিস্তানের দাবি, কিছু গাছ নষ্ট হওয়া ছাড়া আর কিছুই হয়নি!
ব্রিটিশ ইকোনমিস্টের মাধম্যে জানিয়েছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সব সময়ই নিজেকে একজন সাহসী ও ক্যারিশম্যাটিক নেতা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন, পাকিস্তানের হুমকির মুখে যিনি কখনোই কুঁকড়ে যান না। এমন ভাবমূর্তির জোরেই ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ব্যাপক ব্যবধানে জয়ী হয়েছিল বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট। ২০১৯ সালে এসে ফের ক্যারিশমা দেখানোর সুযোগ খুঁজছেন মোদি। গত মঙ্গলবার ভোররাতে বিমানবাহিনীর চালানো হামলায় কিছুটা এগিয়েও গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বৃহস্পতিবার ইমরানের নতুন ঘোষণায় তা নিষ্প্রভ হতে শুরু করে।
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের ইশতিহারে মোদি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তার আমলে নতুন নতুন চাকরি সৃষ্টি হবে, ভারত সমৃদ্ধির শীর্ষে উঠবে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি এর বিপরীত। সম্প্রতি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকা ভারতের অপ্রকাশিত কর্মসংস্থান জরিপ প্রকাশের দাবি করেছে।
পত্রিকাটিতে প্রকাশিত জরিপে দেখা গেছে, বর্তমানে ভারতে বেকারত্বের হার ৬ দশমিক ১ শতাংশ। গত ৪৭ বছরের মধ্যে ভারতে এখন সবচেয়ে বেশি মানুষ বেকার। গত ডিসেম্বরে দেশটির বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হারও কমেছে। অসন্তোষ আছে ভারতের কৃষক সমাজের মধ্যে, দলিতরাও নিজেদের অধিকারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন। ওদিকে সিবিআইয়ের সাবেক প্রধান অলোক ভার্মাকে জোর করে সরানো, নোট বাতিল নিয়ে ভোগান্তি বা মোদি সরকারের চাপে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের পদত্যাগ—মোদির অস্বস্তির তালিকায় কী নেই।
এই অবস্থায় মোদির হাতে ছিল দুটি অস্ত্র—ধর্ম ও জাতীয়তাবাদ। নিন্দুকদের মতে, মোদির আমলেই ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়েছে। পুলওয়ামায় হামলার পর দ্বিতীয় বিকল্পটি কাজে লাগানোর সুযোগ পান মোদি। তবে পাকিস্তানের সঙ্গে এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা অত্যন্ত ভয়ংকর। তাতে একটু হিসাব-নিকাশ ভুল হলেই পা পড়ে যাবে গর্তে। সেই খেলাটি বেশ দক্ষতার সঙ্গেই শুরু করেছিলেন নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু শেষটায় একটু ওলট-পালট হয়ে গেল। মোদির কোর্টেই বল পাঠিয়ে দিয়েছেন ইমরান খান। জঙ্গি কর্মকাণ্ডে পাকিস্তানের মদদ দেওয়ার অভিযোগকে পাশ কাটিয়ে এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে ভারতীয় বৈমানিককে মুক্তি দেওয়ার বিষয়টি।
সিএনএন জানিয়েছে, বর্তমানে সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। অন্যদিকে ফের ক্ষমতায় আসা নিয়ে বিপাকে আছেন নরেন্দ্র মোদি। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের ফরেন পলিসি অ্যান্ড গ্লোবাল ইকোনমি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের গবেষক মাদিহা আফজাল জানিয়েছেন, এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, ইমরান খানের মাথা তুলনামূলক ঠাণ্ডা। তবে ভারতের প্ররোচিত হওয়ার যথেষ্ট কারণও ছিল।
তিনি বলেন, পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পথে মোদিকে জটিল মারপ্যাঁচের মুখোমুখি হতে হবে। অর্থনীতি দিয়ে পুরো দেশকে এক করা তার জন্য কঠিন। তবে যুদ্ধের আবহ এ ক্ষেত্রে বেশি কাজে দেয়।
এ বিষয় ব্লুমবার্গ জানিয়েছে, ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদ–নির্ভর রাজনীতির অন্যতম ধারক ও বাহক হলো ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। সেই দলের নেতা হিসেবে নরেন্দ্র মোদির অ্যাজেন্ডাও একই। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান স্বাভাবিকভাবেই ভোটবাক্সে প্রভাব ফেলবে। কিন্তু তার জন্য লড়াইয়ে এগিয়ে থাকাটা প্রয়োজন। এখন তাতেই ঘাটতি আছে নরেন্দ্র মোদির।
এরই মধ্যে বিজেপি ও নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনী নিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের অভিযোগ তুলেছে কংগ্রেসসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো। ঝাঁজালো জবাব দিয়ে মোদি বলেছেন, বিরোধীরা পাকিস্তানকে সাহায্য করছে, ক্ষতি করছে ভারতের। এই ঝাঁজ কত দিন ধরে রাখতে পারবেন মোদি, তাই এখন দেখার।