Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ১৮ শনিবার, মে ২০২৪ | ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

কাশ্মিরবাসীর উপর সামরিক অত্যাচার নয়, হৃদয় জয়ই সংকট সমাধানের পথ

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ২১ ফেব্রুয়ারী ২০১৯, ০৮:১৮ PM
আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারী ২০১৯, ০৮:১৮ PM

bdmorning Image Preview
সংগৃহীত ছবি


১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় মুসলিম অধ্যুষিত কাশ্মীর রাজ্যটি পাকিস্তানের ভাগে পড়বে বলেই জিন্নাহ প্রত্যাশা করেছিলেন। কিন্তু তা হয়নি। বিষয়টি অমীমাংসিত থাকায় প্রিন্সলি স্টেটটি সে সময় থেকে অদ্যাবধি একটি স্পর্শকাতর স্থান হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।

খুব বেশিদিন আগের কথা নয়; পুলওয়ামা হামলার মূল হোতা আদিল আহমেদ দার পাকিস্তানের সঙ্গে ক্রিকেট খেলায় ভারতকে সমর্থন করতেন। কদিন আগেও তিনি ছিলেন সুফি ধারার অনুসারী। আচমকা সেই মানুষটিই পরিচিত হয়ে উঠলেন জঙ্গি হিসেবে।

গত বছর একইভাবে নিজের চিন্তাধারায় রূপান্তর এনেছিলেন কাশ্মিরি একজন অধ্যাপক। সমাজবিজ্ঞানের সেই মেধাবী শিক্ষার্থী একসময় কার্ল মার্ক্সের বস্তুবাদী তত্ত্বে শনাক্তকৃত ধর্মের অবস্থান নিয়ে আলোচনামুখর থাকলেও সামিল হয়েছিলেন সশস্ত্রপন্থী হিজবুল মুজাহিদীনের পতাকাতলে। গত বছর মে মাসে তিনি ‘শহীদ’ হন।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, ব্যাপক মাত্রায় সামরিকায়ন, নিরাপত্তা তল্লাসির সূত্রে হওয়া নির্বিচার হয়রানি ও স্বশাসনের অধিকার ক্ষুণ্ন করার মতো বিষয়গুলো স্থানীয়দের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবোধ জাগিয়ে তুলছে। তাদেরকে ঠেলে দিচ্ছে পাকিস্তান সমর্থিত জঙ্গি সংগঠনগুলোর দিকে।

কাশ্মীর এখন বিভক্ত লাইন অব কন্ট্রোল (ভারত-পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণ রেখা) বরাবর। এ ছাড়াও আকসাই-চিন এবং সিয়াচেন হিমবাহের উত্তরের আরেকটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করে চীন।

নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বহু রক্তপাতের পর ২০০৩ সালে দু দেশ একটি যু্দ্ধবিরতি চুক্তি করেছিল।

পাকিস্তান পরে কাশ্মীরের বিদ্রোহীদের অর্থায়ন বন্ধ করার অঙ্গীকার করে, আর ভারত প্রস্তাব করে বিদ্রোহীরা জঙ্গী তৎপরতা বন্ধ করলে তাদের ক্ষমাও করে দেয়া হবে।

এরপর ২০১৪ সালে হিন্দু জাতীয়তাবাদী নরেন্দ্র মোদির সরকার ক্ষমতাসীন হবার পর তারা পাকিস্তানের ব্যাপারে কঠোর নীতি নেবার অঙ্গীকার করে, তবে শান্তি আলোচনার ব্যাপারেও আগ্রহ দেখায়।

পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ দিল্লিতে নরেন্দ্র মোদির শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানেও গিয়েছিলেন অতিথি হিসেবে।

কিন্ত এর এক বছর পরই পাঞ্জাবের পাঠানকোটে ভারতীয় বিমান ঘাঁটিতে আক্রমণ হয়, যার জন্য পাকিস্তানভিত্তিক গোষ্ঠীগুলোকে দায়ী করে ভারত। এর জেরে মোদি ইসলামাবাদে তার নির্ধারিত সফর বাতিল করে দেন। এরপর থেকে দু'দেশের মধ্যে আলোচনায় আর কোন অগ্রগতি হয়নি।

কাশ্মিরের আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রশ্নে স্থানীয়দের অসন্তোষ বহু পুরানো। ভারতের এককালের রাজনীতিবিদরা কাশ্মিরের জনগণের রাজনৈতিক ইচ্ছাকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলতেনও। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু তার চিঠি ও ভাষণে বহুবার বলেছেন, কাশ্মিরের মালিক কাশ্মিরের জনগণ। তারাই সিদ্ধান্ত নেবে, তারা কাদের সাথে থাকতে চায়।

১৯৫৫ সালের ৩১ মার্চ লোকসভায় দেওয়া ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘কাশ্মির কোনও বিনিময়ের বস্তু নয়, যা ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হবে। বরং কাশ্মিরের প্রাণ রয়েছে, তার পৃথক সত্তা রয়েছে। কাশ্মিরি জনগণের সদিচ্ছা এবং মতামত ছাড়া কিছুই করা যাবে না।’

ঐতিহাসিক বাস্তবতা হলো, নেহরুর রাজনৈতিক অবস্থান পরবর্তীতে কার্যকর হতে দেখা যায়নি ভারতের রাষ্ট্রীয় নীতিতে। কাশ্মিরিদের গণভোটের আশ্বাস দেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। বরং দিনকে দিন কাশ্মির পরিবেষ্টিত হয়েছে লক্ষ লক্ষ সেনা সদস্যদের দ্বারা, হয়ে উঠেছে ভারত-পাকিস্তানের পরোক্ষ যুদ্ধের এক ক্ষেত্রে। তাতে প্রাণ হারিয়েছে লাখ লাখ মানুষ।

মানবাধিকার কর্মীদের দাবি অনুযায়ী, ১৯৪৭ সালের পর থেকে অন্তত পাঁচ লাখ কাশ্মিরি নিহত হয়েছে; বাস্তুচ্যুত হয়েছে দশ লাখের মতো। ভারতের সরকারি তথ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়া জানিয়েছিল, ১৯৯০ সাল থেকে ২০১১ সালের মধ্যে ১১ বছরেই ৪৩ হাজার ৪৬০ জন কাশ্মিরি নিহত হয়েছে। নিহতদের বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডে রাজনৈতিক বিশ্লেষক অমূল্য গাঙ্গুলী লিখেছেন, কাশ্মির সংকট প্রসঙ্গে ২০১০ সালে টাইমস অব ইন্ডিয়ার সম্পাদক ড. দিলীপ পাজোঙ্কারের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছিল ভারত সরকার।

কমিটির সুপারিশের মধ্যে ছিল, ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপস্থিতিকে দৃষ্টিসীমার বাইরে রাখা, মানবাধিকার হরণের অভিযোগগুলোর তদন্ত করা, ‘আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্টের’ (এএফএসপিএ) আওতায় নিরাপত্তা বাহিনীকে দেওয়া ক্ষমতার সীমা পুনর্মূল্যায়ন করা এবং ‘ডিস্টার্বড এরিয়াস অ্যাক্ট’ বাতিল করা। কাশ্মিরের মানুষের হৃদয় জয়ের উদ্যোগ হিসেবে নেওয়া এইসব সুপারিশের বেশিরভাগই বাস্তবায়ন করা হয়নি। আর তা সমাজতত্ত্বের বস্তুবাদী অধ্যাপক থেকে শুরু করে সুফি ধারার অনুসারীকেও সশস্ত্রপন্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

জঙ্গি সংগঠনগুলো যাতে কাশ্মিরি তরুণদের বিভ্রান্ত করতে না পারে তা নিশ্চিতে প্রথম পদক্ষেপই হতে পারত এএফএসপিএ সম্পূর্ণভাবে ভাবে বাতিল করা। তারপর নিশ্চিত করতে হতো আর্টিকেল ৩৭০ ও আর্টিকেল ৩৫এ যেন কোনওভাবে বাধাগ্রস্ত না হয়। ৩৭০ ধারায় কাশ্মিরের ‘স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের মর্যাদা’ নিশ্চিত করা হয়েছে। অন্যদিকে, ধারা ৩৫এ নাগরিকত্ব ও নাগরিক অধিকার নিশ্চিতের সঙ্গে জড়িত।

সংস্কার বাস্তবায়ন করা হলে ভারত সরকার বোঝাতে সমর্থ হতো যে তারা কাশ্মির সংকটকে নিছক নিরাপত্তা ঝুঁকির দৃষ্টিতে দেখে না, বরং অটল বিহারী বাজপেয়ীর মতো ‘মানবিক’ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে। কিন্তু তা যদি সম্ভব না হয় তাহলে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো কাশ্মিরি তরুণদের যেমন নিজেদের পক্ষে টেনে নেওয়ার সুযোগ পাবে, তেমনি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের নিরাপত্তাও হুমকির মধ্যেই থেকে যাবে। ভারত কাশ্মির হামলার সূত্রে পাকিস্তানকে একঘরে করে দেওয়ার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা শুরু করেছে। কিন্তু অমূল্য গাঙ্গুলীর মতে, কাশ্মিরিদের ক্ষোভের আগুন যখন ঠাণ্ডা হবে তখনই পাকিস্তানকে কার্যত বিচ্ছিন করে দেওয়া যাবে।

হৃদয় জয়ের বদলে বলপ্রয়োগের পথে গেলে কাশ্মিরিদের মধ্যে যে আরও বেশি বিচ্ছিন্নতার বোধ জেগে উঠবে তা উল্লেখ করেছেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাবেক লেফটেন্যান্ট জেনারেল সৈয়দ আতা হাসনাইন।

তিনি মনে করেন, আইইডি নামে পরিচিত বিশেষায়িত বোমা ব্যবহার করে কাশ্মিরে সিআরপিএফের গাড়ি বহরে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি যে হামলা চালানো হয়েছে, তার প্রেক্ষিতে বাড়বে নিরাপত্তা বাহিনীর তৎপরতা। বসানো হবে বিপুল সংখ্যক নিরাপত্তা চৌকি। আর হামলাকারীদেরই তা সুবিধা এনে দেবে। যত বেশি কড়াকড়ি করা হবে, তত বেশি মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে থাকবে। হয়রানির কারণে কাশ্মিরিদের সমর্থন সরে যাবে তাদের পক্ষেই, ভারত যাদেরকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে চায়।

Bootstrap Image Preview