Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ০৩ শুক্রবার, মে ২০২৪ | ২০ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

মহিলা কলেজ অধ্যক্ষের পেটে ৮ কোটি টাকা!

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৯ ফেব্রুয়ারী ২০১৯, ১১:২৯ AM
আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারী ২০১৯, ১১:২৯ AM

bdmorning Image Preview
সংগৃহীত


রাজধানী ঢাকার মির্জা আব্বাস মহিলা ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ লুৎফুন নেছার বিরুদ্ধে প্রায় ৮ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিরীক্ষা বিভাগ ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ভিসি বরাবর এমন অভিযোগ জমা দিয়েছেন কলেজটির শিক্ষক-কর্মচারীরা।

অভিযোগে বলা হয়, লুৎফুন নেছা কোনো নিয়োগ ছাড়াই ১১ বছর কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদে আছেন। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বেতন, ভর্তি ও ফরম পূরণ খাতে আসা অর্থের ৬৮ লাখ ৮১ হাজার ৩৬৩ টাকা নিজের পকেটে নেন তিনি।

এর বাইরেও কলেজে শিক্ষক নিয়োগ, ইনকোর্স বাণিজ্য, প্রশাসনিক খাত এবং সরকারের সচিব, বোর্ডের অফিসার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাদের উপহার দেয়ার নামে ভুয়া ভাউচার করে লুৎফুন নেছা বছরে অর্ধ লক্ষাধিক টাকা আত্মসাৎ করেন।

অনিয়ম সংক্রান্ত কাজপত্র ঘেটে দেখা গেছে, লুৎফুন নেছা নয়-ছয় করে বছরে ১ কোটি ২১ লাখ ৮৩ হাজার ৮৩৫ টাকা পকেটে পুরেছেন। এভাবে ১১ বছরে তিনি ৭ কোটি ৭৬ লাখ ৪৩ হাজার ৪২২ টাকারও বেশি আত্মসাৎ করেছেন।

বিধিবহির্ভূতভাবে দায়িত্বে লুৎফুন নেছা

দীর্ঘ ১১ বছর মির্জা আব্বাস মহিলা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ লুৎফুন নেছা। অথচ তার দায়িত্ব পালনই ‘বিধিসম্মত নয়’ বলে জানিয়েছে জাতীয় বিশ্বিবিদ্যালয়।

২০১৮ সালের ২৯ নভেম্বর মির্জা আব্বাস মহিলা কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি ও লুৎফুন নেছাকে দেয়া এক চিঠিতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় উল্লেখ করে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের চাকরির শর্তাবলী রেগুলেশন (সংশোধিত) ২০১৫-এর ধারা ৪(৩) (i) অনুযায়ী অত্র কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ না থাকা সত্ত্বেও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেব লুৎফুন নেছার দায়িত্ব পালন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তাই উল্লেখিত ধারা অনুযায়ী তার স্বাক্ষরিত কাগজপত্র বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক গ্রহণের সুযোগ নেই।

ওই সময়েই বিধিসম্মত এবং সুষ্ঠুভাবে কালেজ পরিচালনার জন্য ৭ কার্য দিবসের মধ্যে কলেজের জ্যেষ্ঠ ৫ শিক্ষকের মধ্যে কাউকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দিতে বলা হয়। অন্যথায় আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ারও হুঁশিয়ারি দিয়েছিল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।

জানা গেছে, লুৎফুন্নেছা নিজেই নিজের নিয়োগের রেজ্যুলেশন করে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব নেন। তার যোগদানপত্রেও গভর্নিং বডি বা কর্তৃপক্ষের কোনো অনুমোদন নেই।

আর লুৎফুন নেছা এসবই করতে পেরেছেন মহিলা দলের সভাপতি ও কলেজটির দাতা সদস্য আফরোজা আব্বাসের সঙ্গে সখ্যতার মাধ্যমে। বিভিন্ন সময়ে তাকে আফরোজা আব্বাসের বিভিন্ন কর্মসূচিতেও সক্রিয় দেখা গেছে।

এমনকি কর্মসূচিতে অংশ নেয়ার পর লুৎফুন নেছার মনে হয়েছিল তার বিপক্ষে শিক্ষকদের একটি অংশ অবস্থান নিয়েছেন। পরে ওই শিক্ষকদের বিরুদ্ধে তিনি আফরোজা আব্বাসের কাছে চিঠি লেখেন, ‘বিএনপির মিছিলে অংশগ্রহণ ও আপনার সঙ্গে দলীয় কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ এবং আমি জেল খেটেছি এই মর্মে তারা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে।’

কলেজটির শিক্ষকেরা জানান, ভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শের কোনো শিক্ষককে লুৎফুন নেছা ভাল চোখে দেখতেন না। বিভিন্ন সময়ে ঠুনকো কারণেও আফরোজা আব্বাসের কাছে তাদের বিরুদ্ধে তিনি লিখিত অভিযোগ করেছেন। বেতন আটকে দেয়া, বিনা কারণে শোকজ ছাড়াও মিটিংয়ে তাদের সঙ্গে বাজে ব্যবহার করেন।

উপহারের ভুয়া ভাউচার

শিক্ষা সচিব, শিক্ষাবোর্ড, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা এমনকি তাদের স্ত্রীদের নামে বিভিন্ন উৎসবে উপহার সামগ্রী পাঠানোর জন্য লুৎফুন নেছা ভুয়া ভাউচার করে তার বিপরীতে সমস্ত অর্থ আত্মসাৎ করেন।

এর মধ্যে ২০১৭ সালের ঈদুল আযহায় উপহার বাবদ ৩০ হাজার টাকা, অধ্যক্ষের ঈদ সম্মানী ১০ হাজার টাকা, সভাপতির ঈদ সম্মানী ৫ হাজার টাকা এবং উপঢৌকন খাতে ২৮ হাজার টাকার দলিল পাওয়া গেছে।

পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন

ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ লুৎফুন নেছার বিরুদ্ধে পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন ও ভুল প্রশ্নপত্র বিতরণের অভিযোগ রয়েছে। অনিয়মের কারণে বর্তমান বছরে কলেজটির কেন্দ্র বাতিল করা হয়েছে।

২০১৮ সালের এইচএসসি পরীক্ষা চলাকালে ভুল প্রশ্নপত্র ছাত্রীদের মাঝে বিতরণের দায়ে লুৎফুন নেছাকে ঢাকা বোর্ড কর্তৃপক্ষ পরীক্ষা পরিচালনা কমিটি থেকে অব্যাহতি দিয়ে জ্যেষ্ঠতম এক শিক্ষককে দায়িত্ব দেন। কিন্তু, তিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষককে ডিঙিয়ে পরীক্ষার সকল কাগজপত্র ও বিলসমূহ স্বাক্ষর করে বোর্ডের আদেশ অমান্য করেন।

নিয়োগে বাণিজ্য ও দুর্নীতি

সংশ্লিষ্ট বিষয়ভিত্তিক না হওয়া সত্ত্বেও বিধি বহির্ভূতভাবে নিজস্ব লোককে অনার্সের শিক্ষক হিসেবে দেখিয়ে কলেজের অর্থ আত্মসাৎ করেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ লুৎফুন নেছা।

অনার্সে এক বিষয়ের শিক্ষককে অন্য বিষয়ে নিয়োগ দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। এরপরও নিজের আত্মীয় ফিন্যান্স থেকে পাস করা সত্ত্বেও তাকে মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন। তার নামে কৌশলে গভর্নিং বডির অনুমোদন ছাড়াই বিভিন্ন সময় টাকা তুলে নেন। এখানেও বছরে ১ লাখ ৩২ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ।

শিক্ষকদের প্রাপ্য সম্মানী দেননি

অনার্স-মাস্টার্সের শিক্ষকরা কলেজের অন্যান্য শিক্ষকদের মতো বেতনভাতা পাবেন, এটাই সরকারি বিধি। সরকারি অষ্টম পে-স্কেল অনুযায়ী কলেজ তহবিল সঙ্কুলান সাপেক্ষে কলেজ থেকে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দেয়ার কথা। কিন্তু, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ তার নিজের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য সকলকে সরকারি পে-স্কেল না দিয়ে অনার্সের কোর্স ফি নামে একটি ভাতা শুধু অনার্সের শিক্ষকদের দিয়েছেন। জানা গেছে, এই খাত থেকে এভাবে তিনি বছরে ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা রে নিজের পকেটে নিয়েছেন।

কলেজের বিভিন্ন কাজ শিক্ষকদের মাধ্যমে কমিটি করে করার কথা থাকলেও সেগুলো কোনো কমিটি ছাড়া কেরানি দিয়ে নিজেই করেন লুৎফুন নেছা। আর এসব খাতের অর্থ কেরানির মাধ্যমে নিজেই হস্তগত করেন তিনি।

জানা গেছে, কলেজ তহবিল থেকে সরকারি বেতন স্কেলের পুরাতন স্কেলের হিসাবে ১০% বাড়িভাড়া ও ১০% পিএফ হিসেবে স্ব স্ব পি এফ ফান্ডে জমা হয়। উক্ত হিসাবের বিলে অফিস ক্লার্ক ও সহকারী কৌশলে সকলের অগোচরে বানোয়াট স্কেল দেখিয়ে কলেজের টাকা আত্মসাৎ করেন লুৎফুন নেছা।

এ ছাড়া লুৎফুন নেছা নিয়মবহর্ভূতভাবে ২০১৫ সালে জাপান ও ২০১৮ সালে ফিলিপাইন সফর করেছেন। আর এ সময়ে নিজেকে কাগজকলমে অনডিউটি দেখিয়েছেন।

ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হওয়ারে আগেও ২০০০ সালে অর্থ আত্মসাতের দায়ে দণ্ডিত হন লুৎফুন নেছা। ১৯৯১ সালে যোগদানের কথা বললেও ওই বছরের শিক্ষক হাজিরা খাতায় তার কোনো স্বাক্ষর পাওয়া যায়নি।

এত অনিয়ম করলেও চাকরি ও সম্মান হারানোর ভয়ে কেউ তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস করেন না।

অভিযোগের বিষয়ে মির্জা আব্বাস মহিলা ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ লুৎফুন নেছা মুঠোফোনে পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘এসব আপনার জেনে কি লাভ?’

এক পর্যায়ে অনিয়মের নানা দলিলের কথা জানালে তিনি বলেন, ‘এসব সিক্রেট কাগজ, আপনার কাছে গেল কিভাবে?’ পরে লুৎফুন নেছা ফোন কেটে দেন। এরপর একাধিকবার যোগাযোগ করেও তার কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

Bootstrap Image Preview