থাইল্যান্ডে রাজনৈতিক কূটচাল, জনগণের বিক্ষোভ-প্রতিবাদ আর সামরিক অভ্যুত্থান স্বাভাবিক ঘটনা। তবে ৮ ফেব্রুয়ারি ছিল থাই রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে নাটকীয় দিনগুলোর একটি।
এর শুরু ওই দিন সকাল ৯টা ১৫ মিনিটে। দেশটিতে আগামী ২৪ মার্চে সাধারণ নির্বাচন। নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দেন থাই রাজকন্যা উবলরত্না সিরিবর্ধনা বর্ণভেদী।
প্রভাবশালী রাজা মাহা বাজিরালংকর্নের বড় বোন তিনি। থাই রক্ষা চার্ট পার্টি থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে জানান। সেনা অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রায় এক যুগ ধরে স্বেচ্ছা নির্বাসিত ধনকুবের থাকসিন সিনাওয়াত্রা ও ইংলাক সিনাওয়াত্রা পরিবারের প্রতি অনুগত দলটি।
তার এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে সেনাশাসিত থাইল্যান্ডের রাজনীতিতে হইচই পড়ে যায়। থাইল্যান্ডে রাজ পরিবারের কোনো সদস্যের রাজনীতিতে আসা নজিরবিহীন। শত শত বছরের সেই ঐতিহ্য ভেঙে ৬৭ বছরের উবলরত্না লড়বেন সেনাশাসক জেনারেল প্রায়ুথ চান ওচার বিরুদ্ধে।
এটাকেই থাকসিন পরিবারের ‘ভুল চাল’ হিসেবে দেখছেন বর্তমান সেনা সরকারের প্রধান প্রয়ুথ চান ওচা। আর এই ভুল চাল থেকেই কীভাবে ফায়দা হাসিল করা যায় তার বিভিন্ন তরিকা অবলম্বন করছেন তিনি। মার্কিন সংবাদ মাধ্যম ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
রাজকুমারী উবলরত্নার প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হওয়াটা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী প্রায়ুথ চানের জন্য আসলেই বড় একটা চ্যালেঞ্জ। কেননা, থাই সমাজে রাজপরিবারের শীর্ষ সদস্যদের ঈশ্বরতুল্য গণ্য করা হয়। আর তাই সমাজে তাদের কোনো সমালোচনাও নিষিদ্ধ।
কোনো রূপ সমালোচনা করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়। আর সর্বগুণে গুণান্বিতা উবলরত্নার জনপ্রিয়তা সমাজের উঁচুতলা থেকে নিচুতলা পর্যন্ত আকাশছোঁয়া। কারণ, তিনি একাধারে পরমাণু পদার্থবিজ্ঞানী, সুন্দরী অভিনেত্রী, মডেল, সমাজসেবক, সমাজ সংস্কারক প্রভৃতি। কিন্তু বোনের নজিরবিহীন এ পদক্ষেপের বিরুদ্ধে পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছেন বড় ভাই থাই রাজা ভাজিরালংকর্ন।
শুক্রবার সকালে যে নাটকীয় ঘটনার শুরু হয় মাত্র ১৩ ঘণ্টা পরই তার নতুন মোড় নেয়। ওই দিন রাতেই ‘রাজকীয় ফরমান’ বলে পরিচিত এক বিবৃতি দেন থাই রাজা ভাজিরালংকর্ন। বিবৃতিতে তিনি যা বলেন তার অর্থ করলে দাঁড়ায়- ‘বোন উবলরত্না প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হোক তা তিনি চান না’। বোনের প্রধানমন্ত্রিত্বে লড়াইয়ে নামার চেষ্টাকে ‘অনুচিত’ এবং ‘সংবিধানের সম্পূর্ণ লঙ্ঘন’।
তিনি আরও বলেন, ‘থাই রাজতন্ত্র হচ্ছে থাই সমাজের কেন্দ্র যা থাই জনগণকে রসুনের কোয়ার মতো এক জায়গায় আটকে রেখেছে। রাজতন্ত্র ও এর সদস্যরা রাজনীতির ঊর্ধ্বে।’
রাজার এই বক্তব্যের পর থেকে থাই রাজনীতির ঘটনাগুলো দ্রুত ঘটে চলেছে। আগামী ২৪ মার্চের নির্বাচন দেশটিতে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি ও একটি স্থিতিশীর সরকার প্রতিষ্ঠা করার একটা চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
নিজেকে প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী ঘোষণা করে সেই চ্যালেঞ্জটাই নিতে চাচ্ছেন রাজকুমারী উবলরত্না। কিন্তু বড় ভাই তাকে বাধা দিয়ে মূলত জান্তা সরকারের প্রধান প্রায়ুথের পথই পরিষ্কার করছেন।
থাই রাজার এই বিরোধিতা থাইল্যান্ডে থাকসিন পরিবার ও তার মিত্রদের ভবিষ্যৎকেও হুমকির মুখে ফেলছে। থাকসিন পরিবার স্বেচ্ছা নির্বাসিত হলেও নিজ দেশে এখনও সমান জনপ্রিয়। ২০০১ সাল তারা প্রত্যেকটা নির্বাচনেই বিজয়ী হয়েছে তাদের দল। কিন্তু একবারও তাদের ক্ষমতার মেয়াদ পূর্ণ করতে দেয়া হয়নি। এবারও থাই রাজার ঘাড়ে বন্দুক রেখে শিকার ধরার কৌশল ফেঁদেছেন জেনারেল প্রায়ুথ।