বেসরকারি ব্যাংকগুলো শিল্পঋণে সুদের হার এখনও সিঙ্গেল ডিজিটে নামানোর কথা থাকলেও এখনো তা কার্যকর হয়নি। জানুয়ারিতে ১১টি ব্যাংক ৯ শতাংশ সুদে শিল্পঋণ দেয়ার দাবি করলেও ব্যবসায়ীরা তা প্রত্যাখ্যান করেছেন।
তারা বলছেন, বাস্তবে সাড়ে ১১ থেকে ১৩ শতাংশ সুদ আদায় করা হচ্ছে। তাদের মতে, শুধু ১১টি নয়, বেসরকারি খাতের কোনো ব্যাংকই ৯ শতাংশ সুদে শিল্পঋণ দিচ্ছে না। সুদের হিসাবে শুভংকরের ফাঁকি রয়েছে বলে তারা মনে করেন।
বিকেএমইএ নেতা মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ৯ শতাংশ সুদে কেউ শিল্পঋণ পাচ্ছে না। প্রিমিয়ার ব্যাংক আমার কাছ থেকে শিল্পঋণে সুদ কাটছে সাড়ে ১১ থেকে সাড়ে ১৩ শতাংশ পর্যন্ত। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনেই উল্লেখ করা হয়েছে, গত জানুয়ারিতে প্রিমিয়ার ব্যাংক ৯ থেকে ১২ শতাংশ সুদে শিল্পঋণ বিতরণ করেছে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের জানুয়ারির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ১১টি বেসরকারি ব্যাংক ৯ শতাংশ সুদে শিল্পঋণ দিচ্ছে। ব্যাংকগুলো হল- ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক।
ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করছেন, ব্যাংকগুলো প্রকৃত সুদহার গোপন রেখে বাংলাদেশ ব্যাংকে তথ্য পাঠাচ্ছে। ফলে এসব ব্যাংক যে হারে সুদ নিচ্ছে, তার প্রকৃত চিত্র প্রকাশ হচ্ছে না।
অথচ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একই মাসের (জানুয়ারি) প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২৯টি ব্যাংক ঘোষিত সিঙ্গেল ডিজিটের চেয়ে বেশি সুদে ঋণ দিয়েছে। এর মধ্যে ১৫টি ব্যাংক শিল্পঋণে ৯ থেকে ১২ শতাংশ সুদ নিয়েছে।
এছাড়া বাকি ব্যাংকগুলো নিয়েছে ৯ থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ১৬ শতাংশ পর্যন্ত সুদ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনেই দেখা যাচ্ছে শিল্পঋণের ক্ষেত্রে সুদের হার এখন সিঙ্গেল ডিজিটে নামায়নি সব বেসরকারি ব্যাংক।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, সুদহারের বিষয়ে একবার তদন্ত করেছি। প্রয়োজনে আরও একবার তদন্ত করব। হয় তো ব্যাংক তার পছন্দের গ্রাহককে ৯ শতাংশে ঋণ দিচ্ছে। তবুও তথ্যগুলো যাচাই করে দেখব।
শিল্প উদ্যোক্তা এবং ব্যাংক বিশ্লেষকদের মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনোভাবেই বলতে পারে না যে পছন্দের গ্রাহককে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দিচ্ছে। শিল্পঋণে সিঙ্গেল ডিজিট সুদ সবার জন্য তাদেরই নিশ্চিত করতে হবে।
কাউকে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দেবে, কাউকে ১২-১৩ শতাংশ হারে দেবে, তা হতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী নিজেই শিল্পঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছেন।
এ নির্দেশ বাস্তবায়নে ব্যাংকগুলো অঙ্গীকারও করেছে। এ অঙ্গীকার করে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বিভিন্ন ধরনের সুবিধা নিয়েছে। কিন্তু এরপর তারা বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির স্বার্থে সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামায়নি।
এর মাধ্যমে তারা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ উপেক্ষা করেছেন। তারা মনে করেন, যারা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ পালনের ক্ষেত্রে অন্তরায়, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া উচিত। অন্যথায় বেসরকারি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে, শিল্পায়নে গতি আসবে না। বাধাগ্রস্ত হবে নতুন কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন।
তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, শিল্প খাতে ৯ শতাংশ সুদে কেউ ঋণ পেয়েছেন, এটি আমার জানা নেই। আমি নিজেও পাইনি।
তাহলে কি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বিনিয়োগই নেই; বাধাগ্রস্ত হবে কোত্থেকে? তিনি আক্ষেপ করে বলেন, এসব কথা কে শুনবে, শোনার কে আছে?
একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের এমডি বলেন, আসলে উচ্চসুদে বিনিয়োগ দেশে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া গ্যাস-বিদ্যুতের অপ্রতুলতা তো আছেই। একজন উদ্যোক্তা শিল্প কারখানা চালু করতে ব্যাংক থেকে বড় অংকের ঋণ নেন।
পর্যাপ্ত গ্যাস-বিদ্যুৎ না থাকায় কারখানাটি সময়মতো উৎপাদনে যেতে পারে না। কিন্তু ব্যাংক বসে থাকে না। ঋণের বিপরীতে সুদ কাটা শুরু করে। আর তা যদি হয় উচ্চসুদ তাহলে তো আর কোনো কথাই নেই।
শিল্প মালিক উৎপাদনে যাওয়ার আগেই বড় অংকের সুদের চাপে পড়ে যান। এরপর উৎপাদনে গিয়ে কয়েক বছরেও লাভের মুখ দেখেন না। একদিকে বছরের পর বছর লোকসান, অন্যদিকে বেড়েই চলে উচ্চসুদ।
এভাবে অনেক ভালো উদ্যোক্তা, যারা ব্যাংকের টাকা মেরে খাওয়ার অভ্যাস বা রেকর্ড কোনোটাই নেই- তারাও শিল্পঋণে খেলাপি হচ্ছেন। ওই ব্যাংকের এমডি বলেন, এসব ঘটনার ভেতরে কেউ যে খারাপ নেই তা বলব না, খারাপও আছে। খারাপ গ্রাহকের জন্য প্রয়োজনে উচ্চসুদ আরোপ করা হোক।
তার মতে, সব গ্রাহক বা শিল্পোদ্যোক্তাকে এক পাল্লায় মাপা ঠিক নয়। যারা ভালো তাদের সিঙ্গেল ডিজিট সুদে ঋণ দিয়ে পুরস্কৃত করা যেতে পারে। আর যারা দাগি অপরাধী, দীর্ঘদিন থেকে এক টাকাও পরিশোধ করে না, টাকা পরিশোধের অভ্যাসই নেই, শুধু বিপদে পড়লে কিছু টাকা পরিশোধ দেখিয়ে পুরো টাকাই নিয়মিত করে নেয়- তাদের জন্য উচ্চসুদের তিরস্কার বহাল রাখা উচিত। তা না হলে দেশীয় শিল্প কোনো দিন ঘুরে দাঁড়াবে না।
দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন যুগান্তরকে বলেন, উচ্চ সুদের কারণে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
বেশিরভাগ বেসরকারি ব্যাংকে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ পাওয়া যাচ্ছে না। অবশ্য এখানে দ্বিমুখী নীতির কারণে এমনটি হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি। তার মতে, সঞ্চয়পত্রে ১২ শতাংশ সুদ পেলে কেউ ব্যাংকে ৬ শতাংশে এফডিআর করতে যাবে না। এছাড়া সরকারি আমানতও ৬ শতাংশে পাওয়া যাচ্ছে না। এসব কারণে বেসরকারি ব্যাংকে নগদ অর্থ সংকট। এতে ঋণের সুদও কমছে না।
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সহসভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, আমার জানা মতে ৯ শতাংশ সুদে কোনো ব্যাংক শিল্পঋণ দিচ্ছে না। আমার কাছ থেকেও ১২ শতাংশ সুদ নিচ্ছে একটি বেসরকারি ব্যাংক।
গত বছরের বাজেট ঘোষণার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতির সাবেক সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ।
পরে তিনি সুদহার কমানোর বিষয়ে উদ্যোগ নেন। এ লক্ষ্যে ২০ জুন এক বৈঠক থেকে ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার ঘোষণা দেয় বেসরকারি ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি)।
সংগঠনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ১ জুলাই থেকে ঋণের সুদ হবে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ এবং ৬ মাস মেয়াদি আমানতের সুদ হবে সর্বোচ্চ ছয় শতাংশ। একই ঘোষণা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোও দিয়েছে।
এটি পুরোপুরি কার্যকর না হওয়ায় গত বছরের ২ আগস্ট আবার তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বৈঠক ডাকেন। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষের ওই বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, অর্থসচিব, সব ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং এমডির উপস্থিতিতে সাবেক অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন,‘আজ প্রধানমন্ত্রী আমানতের সুদহার ৬ শতাংশ এবং ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ কার্যকরের নির্দেশ দিয়েছেন।
তবে এটা ৯ আগস্ট থেকে সব ব্যাংকে কার্যকর করতে হবে।’ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অনুযায়ী সরকারি ব্যাংকগুলো সুদহার কমালেও বেসরকারি অনেক ব্যাংক তা কমায়নি।