বিনা দোষে তিন বছর কারাভোগের পর উচ্চ আদালতের নির্দেশে মুক্তি পেয়েছেন পাটকল শ্রমিক জাহালম।
রবিবার দিবাগত রাত ১২টা ৫৮ মিনিটে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে তাকে মুক্তি দেয়া হয়।
পাঁচ বছর আগে ২০১৪ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে জাহালমের বাড়ি টাঙ্গাইলের ঠিকানায় একটি চিঠি পাঠানো হয়। ওই চিঠিতে ২০১৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ৯টায় জাহালমকে দুদকে হাজির হতে বলা হয়। জাহালম সেসময় নরসিংদীর ঘোড়াশালের বাংলাদেশ জুট মিলে শ্রমিকের কাজ করছিলেন।
যথা সময়ে দুদকে হাজিরা দিয়ে জাহালম আবার তার নরসিংদীর জুট মিলের কর্মস্থলে চলে যান। এর দুই বছর পর ২০১৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি নরসিংদীর ঘোড়াশালের ওই জুট মিল থেকে জাহালমকে গ্রেফতার করা হয়।
এর আগে সোনালী ব্যাংকের ১৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকা আত্মসাতের ৩৩টি মামলায় জাহালমের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয় দুদক।
এদিকে ওইসময় পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে জাহালম জানিয়েছিলেন, ‘স্যার, আমি জাহালম। আবু সালেক না। আমি নির্দোষ।’ কিন্তু জুট শ্রমিক জাহালমের কোনো কথাই সে সময় পুলিশ কিংবা দুদক শোনেনি। এর ফলশ্রুতিতে আসল আসামি সালেকের পরিবর্তে জাহালমকেই কারাগারে যেতে হয়।
এ নিয়ে চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি একটি জাতীয় দৈনিকে ‘৩৩ মামলায় ‘ভুল’ আসামি জেলে: ‘স্যার, আমি জাহালম, সালেক না…’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির অভিযোগে ২০১৪ সালে আবু সালেক নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ৩৩টি মামলা করে দুদক। এর পর সালেককে তলব করে দুদক চিঠি দিলে সেই চিঠি পৌঁছায় জাহালমের টাঙ্গাইলের বাড়ির ঠিকানায়।
নরসিংদীর ঘোড়াশালের বাংলাদেশ জুট মিলের শ্রমিক জাহালম তখন দুদকে গিয়ে বলেন, তিনি আবু সালেক নন, সোনালী ব্যাংকে তার কোনো অ্যাকাউন্টও নেই। ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য আবু সালেকের যে ছবি ব্যবহার করা হয়েছে সেটিও তার নয়।
কিন্তু দুদকে উপস্থিত বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তারা সেদিন জাহালমকেই ‘আবু সালেক’ হিসেবে শনাক্ত করেন। পরে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঘোড়াশাল থেকে জাহালমকে গ্রেফতার করে দুদক।
পরে আদালতেও জাহালম দুদকের পরিচয় বিভ্রাটের বিষয়টি তুলে ধরে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। কিন্তু কেউ তার কথা কানে তোলেননি।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, কারও কাছে সমাধান না পেয়ে জাহালমের বড় ভাই শাহানূর মিয়া গত বছর জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে যান। তার আবেদনে কাশিমপুর কারাগারে গিয়ে জাহালমের সঙ্গে কথা বলেন কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক। পরে মানবাধিকার কমিশনের তদন্তে বেরিয়ে আসে, আবু সালেক আর জাহালম একই ব্যক্তি নন।
কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, এ মামলার অন্যতম আসামি নজরুল ইসলাম ওরফে সাগরের সঙ্গে কাশিমপুর কারাগারে কমিশনের কথা হয়। তিনি জানান, আবু সালেক মিরপুরের শ্যামল বাংলা আবাসন প্রকল্পের মালিক।
প্রতিবেদনটি সেদিন (৩০ জানুয়ারি) বিচারপতি এফআরএম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কামরুল কাদেরের হাইকোর্ট বেঞ্চের নজরে আনেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী অমিত দাশ গুপ্ত। পরে আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করেন। জাহালমের আটকাদেশ কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, জানতে চাওয়া হয় রুলে।
সেই সঙ্গে ‘ভুল আসামির’ কারাগারে থাকার ব্যাখ্যা জানতে দুদক চেয়ারম্যানের প্রতিনিধি, মামলার বাদী দুদক কর্মকর্তা, স্বরাষ্ট্র সচিবের প্রতিনিধি ও আইন সচিবের প্রতিনিধিকে তলব করেন হাইকোর্ট।
সে অনুযায়ী দুদক চেয়ারম্যানের প্রতিনিধি হিসেবে দুদকের মহাপরিচালক (তদন্ত) মোস্তাফিজুর রহমান, মামলার বাদী আবদুল্লাহ আল জাহিদ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের যুগ্ম সচিব সৈয়দ বেলাল হোসেন এবং আইন সচিবের প্রতিনিধি সৈয়দ মুশফিকুল ইসলাম রোববার সকালে আদালতে হাজির হন।
আদালতে দুদকের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান। আর ছিলেন জাহালমের বিষয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি আদালতের নজরে আনা আইনজীবী অমিত দাশ গুপ্ত।
শুনানির শুরুতে খুরশীদ আলম খান বলেন, সোনালী ও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তথ্য পাওয়ার পর দুদক আবু সালেকের বিরুদ্ধে মামলা করে। দুদক কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল জাহিদ মামলার অনুসন্ধান করেন। তার অভিযোগপত্রে জাহালমের নাম উঠে আসে। টাঙ্গাইলের স্থানীয় চেয়ারম্যানরা জাহালমকে শনাক্ত করেন।
এ পর্যায়ে আদালত উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, ‘এ মামলায় যাকে আসামি করা উচিত ছিল, তাকে আসামি না করে সাক্ষী বানালেন। জজ মিয়া নাটক আরেকটি বানালেন না কি? দুদক একটি স্বাধীন সংস্থা। বাংলাদেশের জন্য দুদকের মতো একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
টিআইবি কী রিপোর্ট দিল, সেটা আমাদের কনসার্ন না। কারণ টিআইবিও ভুল করতে পারে। দুদক যদি প্রোপারলি কাজ না করে, তাহলে আমাদের যে উন্নয়ন হচ্ছে তার স্থায়িত্ব থাকবে না। দেশ পাকিস্তান হতে বেশি সময় লাগবে না, আমাদের ভিক্ষা করতে বসতে হবে।
বিচারক বলেন, আমরা দুদকের কাজে হস্তক্ষেপ করতে চাই না। দুদক স্বাধীনভাবে কাজ করুক, এটা আমরাও চাই। আগেও আপনাদের (দুদক) ব্যাংকের দুর্নীতি মামলায় সাবধান করেছি।
মনে রাখতে হবে, এটি একটি স্বাধীন দেশ। অনেক মামলায় দেখেছি, আপনারা কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামার আগেই তাকে নোটিশ দিয়ে দেন। অথচ পরে অনুসন্ধান করে দেখা যায় তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই নেই।
তাহলে কেন নোটিশ দিচ্ছেন? একজন অপরাধী না হওয়ার পরও জেল খাটতে হল কেন? দুদককে স্বচ্ছ হতে হবে। এরপর আদালত জাহালমকে দুদকের ২৬ মামলা থেকে অব্যাহতির দিয়ে রবিবারেই তাকে মুক্তি দেয়ার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। পরে রাতে কারাগারে কাগজ পৌঁছানোর পর জেল সুপার তাকে মুক্তি দেন।
এদিকে রবিবার এই আদেশের পাশাপাশি আদালত আগামী ৬ মার্চ বিষয়টি পরবর্তী শুনানির জন্য দিন ধার্য করে দেন।