Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৭ শনিবার, এপ্রিল ২০২৪ | ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

নোয়াখালীতে বছরের শুরুতেই একের পর এক নৃশংসতা

জামশেদুল রহমান, সেনবাগ প্রতিনিধিঃ
প্রকাশিত: ২১ জানুয়ারী ২০১৯, ১২:১৬ PM
আপডেট: ২১ জানুয়ারী ২০১৯, ০১:০১ PM

bdmorning Image Preview


নোয়াখালীতে নতুন বছরের শুরুতেই ঘটে চলেছে একের পর এক চাঞ্চল্যকর নৃশংসতা। টানা বিশ দিনে এপর্যন্ত ৪ হত্যা, ৩ আত্মহত্যা, ২ গৃহবধূকে গণধর্ষণসহ ৩টি অর্ধগলিত লাশ উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে।

জানা যায়, শনিবার (১৯ জানুয়ারী) নোয়াখালীর কবিরহাট উপজেলার ধানসিঁড়ি ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ড নবগ্রামে ঘরে সিঁধ কেটে এক গৃহবধূকে (২৭) গণধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় জাকির হোসেন জহির (৪০) নামে স্থানীয় এক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ওইদিন দুপুরে গৃহবধূ বাদী হয়ে ৭ জনকে আসামি করে কবিরহাট থানায় ধর্ষণ মামলা করেন। তাদের মধ্যে একজনকে গ্রেফতার করা হয়।

গ্রেফতারকৃত জাকির হোসেন জহির নবগ্রামের এনামুল হকের ছেলে। তিনি ক্ষমতাসীন দলের একটি সহযোগী সংগঠনের নেতা বলে জানা গেছে। এছাড়া তার স্থানীয় জিয়ানগর এলাকায় একটি মুদি দোকান রয়েছে।

ওই গৃহবধূর বরাত দিয়ে তার মামা জানান, শুক্রবার (১৮ জানুয়ারি) রাত দেড়টার দিকে জাকির হোসেন জহিরসহ সাতজন তার ভাগিনার ঘরের সিঁধ কেটে ভেতরে প্রবেশ করে ওই গৃহবধূর কাছে থাকা ৬০ হাজার টাকা দিতে বলে। এ নিয়ে তাদের সঙ্গে ওই গৃহবধূর কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে ঘরের লাইট বন্ধ করে ওই গৃহবধূর মা (৬৫), তার এক ছেলে ও দুই মেয়েকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তাদের মধ্যে তিনজন ভিকটিমকে পালাক্রমে গণধর্ষণ করে।

পরে রাত আনুমানিক ৩টার দিকে জহির ও তার লোকেরা ঘর থেকে বের হয়ে যান। এসময় তারা ঘরে থাকা নগদ টাকা, দুই ভরি স্বর্ণ, মোবাইল ও মালামাল লুট করে নিয়ে যায়।

এদিকে, এ ঘটনার পর কয়েকজন দুর্বৃত্ত পার্শ্ববর্তী নূর নবীর ঘরের দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে ঘরে থাকা লোকজনকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে এক ভরি স্বর্ণ ও নগদ ৩৪ হাজার টাকা নিয়ে যায়।

একইদিন নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার আলাইয়াপুর ইউনিয়নে মায়ের সঙ্গে অভিমান করে শিরিন আক্তার সাথী (১৭) নামে এক স্কুলছাত্রী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।

নিহত সাথী ওই ইউনিয়নের ভববদ্রি গ্রামের আবুল কাশেমের মেয়ে। সে স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণিতে পড়তো।

স্থানীয়রা জানায়, শুক্রবার (১৮ জানুয়ারি) বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় স্থানীয় চন্দ্র্রগঞ্জ বাজারে পাশের একটি দরগা মেলায় যায় সাথী। পরে রাতে খাওয়ার সময় পড়ালেখা ও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তার মা বকাবকি করে। এ ঘটনায় অভিমান করে সবাই ঘুমিয়ে যাওয়ার সুযোগে রাতের কোন এক সময় ঘরের আড়ার সঙ্গে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে সাথী।

অপরদিকে মঙ্গলবার (১৫ জানুয়ারী) নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার মোহাম্মদপুর ইউনিয়নে ব্রজ লাল শীল (৬২) নামে এক সেলুন ব্যবসায়ীকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিহতের ভাই মানিক লাল শীলের ছেলে রঞ্জিত লাল শীল (৩০) ও এমরান হোসেন (২৭) নামে দুই যুবককে আটক করেছে পুলিশ।

স্থানীয়রা জানায়, প্রতিদিনের মতো সোমবার (১৪ জানুয়ারি) রাত ৯টার দিকে সেলুন বন্ধ করে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হন ব্রজ লাল। অনেক রাত হলেও তিনি বাড়ি না ফেরায় পরিবারের লোকজন তাকে বিভিন্ন স্থানে খুঁজতে থাকেন। একপর্যায়ে বাড়ির পাশের একটি পুকুর পাড়ে নির্জন স্থানে গলায় রশি পেঁচানো অবস্থায় ব্রজ লাল শীলের মরদেহ দেখতে পায় তারা।

এছাড়াও বৃহস্পতিবার (১০ জানুয়ারী) নোয়াখালী সদর উপজেলার ধর্মপুর ইউনিয়নে পারভীন আক্তার (১৯) নামে এক তরুণীকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। সকালে ইউনিয়নের পূর্ব শুল্লকিয়া গ্রামের একটি বাগান থেকে পুলিশ তার মৃতদেহ উদ্ধার করে। এর আগে বুধবার রাতে পারভীনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। নিহত পারভীন আক্তার ওই গ্রামের জহুরুল হকের মেয়ে।

নিহতের বাবা জহুরুল হক বলেন, পারভীন একটি গার্মেন্টসে চাকরি করতো। তিন মাস আগে সে  বাড়ি চলে আসে। এরপর থেকে এলাকার কিছু বখাটে পারভীনকে বিভিন্নভাবে উত্ত্যক্ত করতো। বুধবার রাতে মসজিদে নামাজ পড়ে বাড়ি ফেরার পর পারভীনকে দেখতে না পেয়ে বিভিন্ন স্থানে খুঁজতে শুরু করি। এর একপর্যায়ে বাড়ির পাশের বাগানে তার ক্ষতবিক্ষত মরদেহ দেখতে পাই।

অপরদিকে বুধবার (৯ জানুয়ারী) নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার চরজব্বার ইউনিয়নে জমি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে ভাতিজার হাতে চাচা দুলাল মিয়া (৫০) খুন হয়েছেন। দুলাল ওই গ্রামের মৃত মোজাস্বর আলীর ছেলে।

স্থানীয়রা জানায়, সকালে বড় ভাই মহিন উদ্দিনের সঙ্গে জায়গা-জমির ভাগ নিয়ে দুলালের কথা কাটাকাটি শুরু হয়। এসময় মহিনের ছেলে আরিফ (ভাতিজা) তার চাচা দুলালের মাথায় লাঠি দিয়ে আঘাত করলে গুরুতর আহত হন তিনি। পরে তাকে উদ্ধার করে ওই হাসপাতালে ভর্তি করলে দুপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

এছাড়াও রবিবার (৬ জানুয়ারী) নোয়াখালীর সুবর্ণচরে চার সন্তানের জননীকে (৩২) গণধর্ষণের ঘটনায় মামলার এজাহারভুক্ত ছয় আসামি ও ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে চার জনসহ মোট ১০ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

এছাড়াও শনিবার (৫ জানুয়ারী) নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার জমিদারহাট এলাকা থেকে পেয়ারা বেগম (৫৮) নামে এক নারীর অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। নিহতের লাশ জমিদারহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে একটি পুকুর থেকে মরদেহটি উদ্ধার করা হয়। নিহত পেয়ারা বেগম জেলার  সেনবাগ উপজেলার শায়েস্তা নগর এলাকার নুরুল হকের স্ত্রী।

এছাড়াও নোয়াখালীর সুবর্ণচরে আমান উল্যা ইউপির নৃত্য মাঝির বাড়িতে শুক্রবার দুপুরে কলেজছাত্রীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। মৃত লিমা দাস ওই গ্রামের লিটন চন্দ্র দাসের মেয়ে। সে সৈকত ডিগ্রি কলেজের সম্মান তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী।

লিটন চন্দ্র দাস বলেন, কয়েকদিন আগে এনজিও'র মাঠকর্মীর চাকরি নেয় লিমা। তার পড়ালেখায় চাপ পড়বে বলে চাকরি না করত বলি। এতে রাগ-অভিমান শুরু করে লিমা। আমি কাজের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেলে ঘরের আড়ির সঙ্গে ধুতি পেঁচিয়ে ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে লিমা। পরে ছোট মেয়ে মনিরা তাকে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখে চিৎকার দেয়।

উল্লেখ্য, গত ৩০ ডিসেম্বর রাত ১১টার দিকে নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার চরজুবলী ইউনিয়নের চরবাগ্গা গ্রামে স্বামী-সন্তানকে বেঁধে চার সন্তানের জননীকে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে। বিরোধী একটি দলকে ভোট দেওয়ায় বর্বরোচিত এ ঘটনা ঘটেছে বলে ধর্ষিতার স্বামী অভিযোগ করেছেন। অভিযুক্ত নয় জনকে আসামি করে চর জব্বার থানায় একটি ধর্ষণ মামলা দায়ের হয়েছে। ওই গৃহবধূর স্বামী বাদী হয়ে ৩১ ডিসেম্বর (মঙ্গলবার) মামলাটি দায়ের করেন।

এরপর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন এলাকা থেকে এ ঘটনার মূলহোতা রুহুল আমিন, বেচু, জসিম উদ্দিন ওরফে জইস্যা (৩৫), হাসান আলী ভুলু (৬০), চরবাগ্গা গ্রামের মৃত ইসমাইলের ছেলে সোহেল (৩৫), মৃত আব্দুল মান্নানের ছেলে স্বপন (৩৫) ও একই গ্রামের আহমদ উল্লার ছেলে বাসুকে (৪০) গ্রেফতার করা হয়।

অন্যদিকে শুক্রবার (৪ জানুয়ারী) নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে হা-ডু-ডু খেলার সময় এক কিশোরের মৃত্যু হয়েছে। নিহতের লাশ গাংচিল আবাসন এলাকার নদীরকূল থেকে তার মরদেহটি উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত সাইফুল ইসলাম গাংচিল আবাসন এলাকার ব্র্যাকের নাছিরের ছেলে। সে পেশায় জেলে।

অপরদিকে মঙ্গলবার (১ জানুয়ারি) নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার নবীপুর ইউপির বড়চারিগাঁও গ্রামে কলেজছাত্রের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। ওইদিন সন্ধ্যায় তার বাড়ি থেকে মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত আমজাদ হোসেন হৃদয় একই গ্রামের প্রবাসী আবদুল খালেকের ছেলে। সে কাপ্তাই পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ফাইনাল বর্ষের ছাত্র।

এ বিষয়ে নবীপুর ইউপি চেয়ারম্যান আমিন উল্যা বিএসসি বলেন, হৃদয়ের বাবা ও অপর দুই ভাই প্রবাসে রয়েছে। কি কারণে ঘটনাটি ঘটেছে কোন ক্লো মিলছে না।

এইদিকে গত ২ জানুয়ারী নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে ১১ বছরের শিশুকে শ্লীলতাহানির অভিযোগ পুলিশ এক যুবককে গ্রেফতার করেছে। এই ঘটনায় শিশুর পরিবার কোম্পানীগঞ্জ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। গ্রেফতারকৃত অপু মজুমদার পৌরসভা ৫নং ওয়ার্ডের প্রসন্ন পন্ডিত বাড়ির হরিচানের ছেলে এবং পেশায় একটি বেসরকারি বিদ্যালয়ের পিয়ন।

এ ব্যাপারে নোয়াখালী পুলিশ সুপার ইলিয়াছ শরীফ বলেন, অপরাধী কোন দল করে সেটা আমাদের দেখার বিষয় নয়। আমরা অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত যেই হোক তাকে আইনের আওতায় আনতে চেষ্টা করছি। এ ঘটনায় কাউকে ছাড় দেয়া হবেনা বলেও তিনি হুশিয়ারী উচ্চারণ করেন।

Bootstrap Image Preview