Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৮ রবিবার, এপ্রিল ২০২৪ | ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

ছাতকে সিমেন্ট কারখানার মাটি সংগ্রহে ধ্বংস ফসলী জমি, পরিবেশ হুমকির মুখে 

হাসান আহমদ, ছাতক প্রতিনিধিঃ
প্রকাশিত: ১৭ জানুয়ারী ২০১৯, ১০:৪৩ AM
আপডেট: ১৭ জানুয়ারী ২০১৯, ১০:৪৩ AM

bdmorning Image Preview


ছাতকে লাফার্জ হোলসিম সিমেন্ট কারখানার শুষ্ক ডাষ্টের কারণে কারখানা এলাকার সবুজ পরিবেশ মারাত্মকভাবে বিনষ্ট হচ্ছে। পাশাপাশি এলাকার মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অসহনীয় হয়ে উঠেছে। কারখানায় ডাষ্ট ডিবাইডার না থাকার কারণে কারখানার আশেপাশের এলাকার বসত-বাড়ির সবুজ সতেজতা হারিয়ে যাচ্ছে। তবুও কারখানা কর্তৃপক্ষ দীর্ঘদিন ধরে বিষয়টি আমলে নিচ্ছে না।

এদিকে কারখানার অন্যতম কাঁচামাল মাটি সংগ্রহের কারণে এলাকার ফসলী জমি ধ্বংস করে দিচ্ছে লাফার্জ হোলসিম সিমেন্ট কারখানা। কারখানার মাটি সংগ্রহের ভারী যানচলাচলে রাস্তাঘাট ভেঙ্গে যাচ্ছে। ধুলো উড়ে পরিবেশ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। কারখানার ডাষ্ট, ধুলো ও কনভেয়ার বেল্টের শব্দসহ বিভিন্নভাবে পরিবেশ ধ্বংসের কারণে লাফার্জ হোলসিমের বিরুদ্ধে এলাকার মানুষের রয়েছে চাপা ক্ষোভ ও উত্তেজনা। তবে অর্থলোভী স্থানীয় প্রভাবশালী মাটি ব্যবসায়ীদের কারণে এ ব্যাপারে তারা প্রকাশ্যে প্রতিবাদী হয়ে উঠতে পারছেনা।

২০০৬ সালে ছাতকে সুরমা নদীর উত্তরপাড় টেংগারগাঁও ও নোয়ারাই গ্রামের মধ্যবর্তী স্থানে প্রতিষ্ঠিত লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট কারখানা নামে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করে। পরবর্তিকালে এ কারখানাটির নামকরণ করা হয় লাফার্জ হোলসিম নামে। প্রতিষ্ঠাকালে ভূমি অধিগ্রহণ করার সময় ক্ষতিগ্রস্থ ভূমি মালিকদের পুনর্বাসনসহ এলাকার উন্নয়নে সামাজিক দায়বদ্ধতার নামে বহু লোভনীয় সুযোগ-সুবিধার কথা বলা হয়েছিল। উৎপাদনের প্রায় ১২ বছর পার হলেও স্থানীয়দের দেয়া কারখানা কর্তৃপক্ষ ওয়াদা পালন করা হয়নি। এসব নিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ ভূমি মালিকদের বড় বেশি ক্ষোভ না থাকলেও এলাকার পরিবেশ মারাত্মক হুমকির মুখে ধাবিত হওয়ার কারণে কারখানার বিরুদ্ধে তাদের রয়েছে বিস্তর অভিযোগ।

কারখানায় অবিরাম কিংকার ও সিমেন্ট উৎপাদনের সময় এবং কারগো ও ট্রাকে সিমেন্ট সরবরাহে উড়ন্ত ডাষ্ট, রাসায়নিক দ্রব্য, মাটি ও বালু কণা কারখানা সংলগ্ন নোয়ারাই, টেংগারগাঁও, বাতিরকান্দি, বাশটিলা, জয়নগর, মাড়–য়া টিলা, মফিজ নগর, পাটিভাগ, টিলাগাঁও, বারকাহন, জোড়াপানিসহ কয়েকটি গ্রামের সবুজ পরিবেশ ধ্বংস করে দিচ্ছে। এসব গ্রামের ঘর-বাড়িও ডাষ্টের কারণে ধূসর রং ধারণ করেছে। ডাষ্টের কারণে দীর্ঘ কয়েক কিলোমিটার জুড়ে বাতাস ও প্রকৃতির স্বাভাবিক পরিবেশ হুমকির মুখে পড়েছে। শিল্প কারখানায় ডাষ্ট ডিবাইডার থাকা জরুরী হলেও লাফার্জ হোলসিম চটের বস্তা ঝুলিয়ে ডাষ্ট নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেও তা সম্ভব হচ্ছে না।

এদিকে ভারত থেকে মাটি ও চুনাপাথর আনার শর্তে কারখানাটি প্রতিষ্ঠিত হলেও পরিবেশ ধ্বংসের কারণ দেখিয়ে ভারতের পরিবেশ অধিদফতর লাফার্জ হোলসিমের মাটি সংগ্রহে  স্থায়ীভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ফলে লাফার্জ হোলসিম স্থানীয়ভাবে মাটির জন্য নতুন করে ভূমি অধিগ্রহনের চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে স্থানীয় কৃষকদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে ফসলী জমির মাটি সংগ্রহ করে যাচ্ছে লাফার্জ হোলসিম। কারখানা কর্তৃপ দ্রুত মাটি সংগ্রহ করে কারখানার অভ্যন্তরে বিশাল মাটির পাহাড় গড়ে তোলায় সংগৃহিত পাহাড়সম মাটির অতিরিক্ত চাপে ২০১১ সালে ছাতক সিমেন্ট কারখানায় সংযোগকৃত জালালাবাদ গ্যাসের হাইপ্রেসার লাইনে বিষ্ফোরণ ঘটে।

এ বিষ্ফোরণের বিষয় নিয়ে ছাতক সিমেন্ট কারখানা ও জালালাবাদ গ্যাস কর্তৃপ সরাসরিভাবে লাফার্জ হোলসিমকে দায়ী করলে কর্তৃপক্ষের ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয়। এদিকে লাফার্জ হোলসিমের মাটি সংগ্রহের কারণে এলাকার সহস্রাধিক একর ফসলী জমি ইতিমধ্যেই জলাশয়ে পরিনত হয়েছে। এসব ফসলী জমি বর্তমানে ফসল উৎপাদন এমনকি মৎস্য চাষের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। মাটি সংগ্রহের কাজ অব্যাহত থাকায় ভবিষ্যতে এলাকার আরো ফসলী জমি ও টিলা ধ্বংস হওয়ার আশংকা রয়েছে। এলাকার সচেতন লোকজন পরিবেশ ও ফসলী  জমি ধ্বংসে স্থানীয়ভাবে একাধিক প্রতিবাদ সমাবেশ করলেও কারখানা কর্তৃপক্ষ এদিকে কোন নজর দিচ্ছে না। পরিবেশ ধ্বংশের কারণে কারখানা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও রয়েছে উচ্চ আদালতে।

পরিবেশবাদী সংগঠন, উপজেলা কৃষি বিভাগ পরিবেশ ও ফসলী জমি নষ্ট করার কারণে লাফার্জ হোলসিমের বিরুদ্ধে পরিবেশ নষ্টের একাধিক রিপোর্ট প্রদান করলেও কর্তৃপক্ষ তা আমলে নিচ্ছে না। ফসলী জমি থেকে মাটি সংগ্রহের বিষয়ে স্থানীয়দের অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত বছর ছাতকের সহকারী কমিশনার (ভূমি) কে আহবায়ক করে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সভা হয়েছে ৮ ফেব্রুয়ারী। ১২ ফেব্রুয়ারী কার্যালয়ের ৩৩৩ স্বারকের প্রতিবেদনে ছাতক সদর ইউনিয়নের মানসি নগর মৌজার ডুবির বিল, তির রাই মৌজার কাজিহাটা বিল ও ইসলামপুর ইউনিয়নের বাহাদুরপুর মৌজার কাজির খাল থেকে লাফার্জ হোলসিমকে মাটি সংগ্রহের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু লাফার্জ হোলসিম এসব এলাকা থেকে এ পর্যন্ত মাটি সংগ্রহ করতে দেখা যায়নি।

লাফার্জের মাটি সংগ্রহ ও পরিবেশ বিনষ্ট সংক্রান্ত বিষয়ে নাগরিক পরিবেশ ও সমাজ কল্যাণ সংস্থার গত বছরের ১৫ মে উচ্চ আদালতে দায়েরকৃত একটি রিটের প্রেক্ষিতে আদালত পরিবেশ অধিদপ্তর ঢাকা ও পরিবেশ অধিদফতর সিলেট এবং সুনামগঞ্জের জেলা প্রসাশক সমন্বয়ে একটি তদন্ত টিম গঠনের মাধ্যমে সরেজমিন তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের আদেশ দেন। তদন্ত টিমের দাখিলীয় রিপোর্টের প্রেক্ষিতে ১৩ ডিসেম্বর আদালত প্রতিবেদনের আলোকে বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য সুনামগঞ্জ জেলা প্রসাশককে নির্দেশ প্রদান করেন। কিন্তু অদ্যাবদি লাফার্জ হোলসিম ফসলী জমি থেকে মাটি সংগ্রহসহ তাদের পরিবেশ দূষণের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।

ভারতের মেঘালয়ের খাসিয়া অঞ্চল থেকে লাফার্জ কারখানার অভ্যন্তর পর্যন্ত সক্রিয় দীর্ঘ ১৭ কিলোমিটার কনভেয়ার বেল্ট’র উচ্চ শব্দের কারনে ছাতক-দোয়ারার সহস্রাধিক পরিবারের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। শব্দ নিয়ন্ত্রক ব্যবহার না করেই উচ্চ শব্দের কনভেয়ার বেল্ট ব্যবহার করে যাচ্ছে লাফার্জ হোলসিম কর্তৃপক্ষ। ফলে এসব এলাকার স্বাভাবিক মানুষের মধ্যে নানা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।

স্থানীয় টেংগারগাঁও গ্রামের আইনুল ইসলাম ও বারকাহন গ্রামের এনামুল হক তালুকদার জানিয়েছেন, বর্তমানে কারখানা থেকে নির্গত ডাষ্ট এলাকাবাসীর জন্য মারাত্মক বিপদজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারখানার স্বার্থের কারণে এলাকার ফসলী জমির ক্ষতি, স্বাভাবিক পরিবেশ নষ্টসহ মারাত্মক শব্দ দূষণের সৃষ্টি হচ্ছে। স্থানীয় শিশুদের মধ্যে অনেক রোগ বালাইয়েরও সৃষ্টি হয়েছে।

এসব থেকে স্থায়ীভাবে মুক্তির জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আশু-হস্তক্ষেপ কামনা করে তারা আরো জানান, আশেপাশে এলাকার প্রতিটি ঘরে-ঘরেই লাফার্জ হোলসিমের ক্ষতির চিহ্ন রয়েছে। শব্দ দূষণ ও পরিবেশ নষ্টের বিষয়ে পরিবেশ মন্ত্রনালয়সহ সরকারের বিভিন্ন দফতরে এলাকাবাসী এবং নাগরিক পরিবেশ ও যুব সমাজকল্যাণ সংস্থা একাধিক অভিযোগ দিয়েছে।

দীর্ঘদিন ধরে এসবের শুধু তদন্তই চলছে, কার্যকর কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। এ ব্যাপারে লাফার্জ হোলসিম বাংলাদেশ লিমিটেডের এক্সটার্নাল কমিউনিকেশনস ম্যানেজার তৌহিদুল ইসলাম সোমবার কারখানার পক্ষে একটি লিখিত বক্তব্য দিয়েছেন। এতে বলা হয়েছে লাফার্জ হোলসিম প্ল্যান্ট থেকে কোন বর্জ্য বাহিরে ফেলা হয় না। সুতরাং কোম্পানির বর্জ্যের  কারণে ফসলি জমিতে ক্ষতির কোন কারণ নেই। পরিবেশের তিকর এমন বর্জ্য পদার্থ বাংলাদেশের বিভিন্ন কোম্পানির নিকট থেকে সংগ্রহ করে লাফার্জ সুরমা প্ল্যান্টে পরিবেশবান্ধব উপায়ে ধ্বংস করা হয়।

মাটি সংগ্রহের জন্য লাফার্জ হোলসিম যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন এবং প্রদত্ত নির্দেশনা মেনেই মাটি সংগ্রহ করছে। মাটি সংগ্রহের ক্ষেত্রে পতিত জমিগুলোকে বেছে নেয়া হয় এবং জমি মালিক ও কৃষকদের মতামতকে প্রাধান্য দেয়া হয়। প্রাকৃতিক কারণে, এসকল পতিত জমি থেকে কয়েক ফুট মাটি অপসারণ করলে তা বোরো চাষের উপযুক্ত হয়।

এলাকার জমির মালিকরা নিজেদের উদ্যোগেই জমির মাটি কেটে বোরো চাষের উপযোগী করে তোলেন। আবার কোন কোন মালিক পতিত জমিকে মাছচাষের উপযোগী করে তোলেন। লাফার্জ হোলসিম যে জমিগুলো থেকে মাটি সংগ্রহ করে পরবর্তীতে এই জমিগুলোকে চাষযোগ্য করে তোলার বিষয়টিও নিশ্চিত করে। লাফার্জের এ কার্যক্রমের ফলে জমি মালিক এবং কৃষকরা উপকৃত হয়। লাফার্জ হোলসিম আইনের প্রতিশ্রদ্ধাশীল থেকে উৎপাদনকার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। ধূলাবালি নির্গমন, শব্দসহ সকল ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনে অনুমোদিত মাত্রা মেনে চলছে লাফার্জ হোলসিম।

এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জের জেলা প্রসাশক মো. আব্দুল আহাদ জানান, তদন্ত রিপোর্ট ও উচ্চ আদালতের নির্দেশনার আলোকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।  

Bootstrap Image Preview