Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ৩০ মঙ্গলবার, এপ্রিল ২০২৪ | ১৭ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

‘আমরা কেঁদেছি, আমরা হেসেছি, আমরা ভালবাসায় ভেসেছি’

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৩ ডিসেম্বর ২০১৮, ০৪:১১ PM
আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০১৮, ০৪:১৪ PM

bdmorning Image Preview


কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে প্রায় দশ মাস আমেরিকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০১২ সালের ১৯শে জুলাই নিউইয়র্কের একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ।  সে সময় তার ছায়াসঙ্গী হিসেবে ছিলেন স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন। সেখানেই একসঙ্গে নিজেদের শেষ বিবাহবার্ষিকী পালন করেছিলেন এই দম্পতি। গত বুধবার (১২ ডিসেম্বর) ছিলো তাদের বিবাহবার্ষিকী। দিনটিতে পুরনো দিনের কথা স্মরণ করে নিজের মনের কিছু না বলা কথা জানিয়েছেন শাওন। বিডিমর্নিং পাঠকদের জন্য শাওনের ফেসবুক স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হলো-

‘২০১১ সালের ১২ ডিসেম্বর ছিল হুমায়ূন এর ৫ম কেমোথেরাপির দিন। আমরা তখন নিউইয়র্কের জ্যামাইকায় ১৪৮-০১ নম্বর বাসার দোতলায় থাকি। নিচতলাটা খালি। দোতলার উপরে ছোট্ট একটা অ্যাটিক। অর্ধেক উচ্চতার ঐ অ্যাটিকে হুমায়ূন সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন না। কিন্তু জায়গাটা তাঁর খুব পছন্দের। তার ট্যানটা বাবা নিষাদ হুমায়ূনকে সঙ্গে নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা তিনি সেখানে ছবি আঁকেন। সারা অ্যাটিক রঙে মাখামাখি হয়ে যায়, বাঁধা দেবার কেউ নেই। কোনো ছবির নীল আকাশটায় তুলো তুলো মেঘগুলো সাদা রঙ করতে করতে কোমল গলায় পুত্রকে জিজ্ঞেস করেন “ছবিটা কেমন হয়েছে বাবা?”

ছবিতে গাছের নিচে দাঁড়ানো একাকি এর নারীকে দেখিয়ে ভাঙা ভাঙা গলায় পুত্র নিষাদ বলে “এখানে নিষাদ এঁকে দিলে আরও ভালো হবে বাবা। ছবির ভেতরে মা একা একা দাঁড়িয়ে আছে, ভয় পাবে।”

হুমায়ূন পুত্রের হাতে রংতুলি তুলে দেন। নিষাদ নিজেই একটা ছোট বাচ্চা এঁকে দেয় ছবির মেয়েটির পাশে। এভাবে চলতে থাকে পিতা-পুত্রের রঙের খেলা। কোনো কোনো ছবি দেখে পুত্র হঠাৎ বলে ওঠে “এই ছবিটা একদম পচা হয়েছে বাবা।”

পুত্রের সমালোচনায় কপাল কুচকে মনোযোগী হয়ে কিছুক্ষণ ছবির দিয়ে তাকিয়ে থাকেন হুমায়ূন। তারপর ঘ্যাচাং করে ছিঁড়ে ফেলেন সেই ছবি! গম্ভীর ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে বলেন “আসলেই ছবিটা ভালো হয়নি বাবা। পচা হয়েছে।”

মাঝে মাঝে একা আমি অ্যাটিকে যাই, ছেঁড়া টুকরোগুলো হাতে করে জুড়ে দেখি। আমার বড় ভালো লাগে। ১১ ডিসেম্বর রাতে আমাকে অ্যাটিকে ডাকলেন হুমায়ূন। তার সামনে একটা সাদা কাগজ- পানিতে ভেজানো। তিনি পানি থেকে কাগজটা তুললেন। তারপর একটু একটু করে জলরঙ এর ছোপ পরতে লাগলো ভিজে পাতায়। হুমায়ূন টুকটুক করে আমার সাথে গল্প করছেন। ৭ বছর আগের সেই একই দিনের গল্প। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি তার হাতের কাগজটার দিকে! কি সুন্দর জলছবি তৈরী হয়ে গেছে মুহূর্তের মধ্যে! ছবিখানা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে হুমায়ূন বললেন এই নাও- তোমার বিয়েবার্ষিকীর উপহার।

১২ ডিসেম্বর সকাল ১১ টা। হুমায়ূন আর আমি বসে আছি মেমোরিয়াল স্লোন কেটারিং হাসপাতালের গ্যাস্ট্রো অংকোলজি ডিপার্টমেন্ট এর সাজানো লবিতে। অল্পক্ষণের মধ্যেই ডক্টর স্টিফেন আর ভিচ আমাদের ডেকে নিলেন তার ঘরে। পরিচিত হাসিখানা ছুঁড়ে দিয়ে বললেন “How’re you doin’ Dr. Ahmed? You’re looking happy today! Is there anything that I missed!” হালকা রসিকতায় ভ্রু নাচালেন তিনি।

“হুম তুমি রসিকতা করছো! একটু পরেই তো আমাকে গাদাখানেক সুঁই ফোটাবে! আজ আমার বিয়েবার্ষিকী, কোথায় দু’জন মিলে একটু ঘুরবো ফিরবো! তা না... আমি বসে আছি কেমোথেরাপির অপেক্ষায়!”

সরু চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন ডক্টর ভিচ! হাতের কাগজটায় খসখস করে লিখলেন কি যেন! তারপর বললেন “তোমাদের আজ ছুটি দিয়ে দিলাম। কেমোথেরাপি কাল হবে। যাও সুন্দর করে বাঁচো আজকের দিনটা।”

আমরা সেখান থেকে বেরিয়ে এলাম। ম্যানহাটন এর রাস্তায় রাস্তায় এলোমেলো হেঁটে বেড়ালাম! শুধু আমরা দু’জন! পথচারীদের জিজ্ঞেস করে করে চায়না টাউন খুঁজে বের করে দুপুরের খাবার খেলাম। দৌড়ে গিয়ে বাস ধরলাম, টিকেট ছাড়া সাবওয়েতে ঢুকে পরলাম!!! সে কি পাগলামি আমাদের দু’জনের..! সে কি ছেলেমানুষী..!!! হ্যাঁ... আমার দু’জন... আমরা কেঁদেছি, আমরা হেসেছি,আমরা ভালবাসায় ভেসেছি...আমরা ছোট ছোট চাহনিতে মুহূর্তটা বেঁধেছি। ১২ ডিসেম্বর ২০১১ একসাথে আমাদের শেষ বিয়েবার্ষিকী।’

Bootstrap Image Preview