বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির উদ্যোগে নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ বিষয়ে জাতীয় কমিটির সম্মানিত সদস্যবৃন্দের সাথে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এ বছর“ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়ন মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ” এই শ্লোগানকে সামনে রেখে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ও বিশ্ব মানবাধিকার দিবস (২৫ নভেম্বর- ১০ ডিসেম্বর)’১৮ পালন করছে।
বহুমূখী কর্মসূচির অংশ হিসেবে এই সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির উদ্যোগে জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জ, ঢাকাতে ‘নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ’ বিষয়ে জাতীয় কমিটির সম্মানিত সদস্যবৃন্দের সাথে এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি নারীনেত্রী আয়শা খানম।
সভায় লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. মাসুদা রেহানা বেগম। উপস্থিত জাতীয় কমিটির সম্মানিত সদস্যবৃন্দের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বিচারপতি নিজামুল হক, কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ, নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ, বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব, ডা. সামন্ত লাল সেন, বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক, অ্যাড. জেয়াদ-আল-মালুম, অ্যাড. এস.এম.এ সবুর, অ্যাড. রানা দাশগুপ্ত, সাংবাদিক বাসুদেব ধর, শিশু বিশেষঞ্জ ডা. নাজমুন নাহার, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আনোয়ারা সৈয়দ হক ও ডা. মেখলা সরকার, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ডা. শাহানা আক্তার রহমান, আদিবাসী নেতা সঞ্জীব দ্রং, চঞ্চনা চাকমা, প্রযুক্তিবিদ মাহবুব জামান, শিক্ষক অধ্যাপক ফারহানা হেলাল, নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের নাসিমুন আরা হক প্রমূখ।
সভায় উপস্থাপিত লিখিত বক্তব্যে উল্লেখ করা হয় যে, এদেশে ঘরে-বাইরে শ্রেণী, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল বয়সের নারী ও কন্যা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদে সংরক্ষিত ১৪টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে জানুয়ারি’১৮ থেকে অক্টোবর’১৮ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ধর্ষণের শিকার ৬৪৬ জন, গণধর্ষণের শিকার ১৬৫ জন, ধর্ষণের পর হত্যার শিকার ৫৩ জন, ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ১১৫ জনকে, শ্লীলতাহানির শিকার ৫৫ জন, যৌন নির্যাতনের শিকার ১৪১ জন, উত্ত্যক্তকরণের শিকার ১৪০ জন, উত্ত্যক্তের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ১৪ জন, এছাড়া বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়ে মোট ৩৫০২ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। অথচ দেশের অর্থনৈতিক বিকাশের পাশাপাশি সামাজিক বিকাশ সমভাবে না হওয়ায় নারীর প্রতি প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন সেভাবে হয়নি। নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে সরকার, নারী ও মানবাধিকার সংগঠন, উন্নয়ন সংস্থা পূর্বের তুলনায় আরও সংগঠিতভাবে বহুমাত্রিক পদ্ধতিতে কাজ করলেও বিগত বেশ কয়েক বছর যাবৎ নারী ও কন্যার প্রতি বর্বর, লোমহর্ষক নির্যাতনের ধরন ও মাত্রা উদ্বেগজনক।
বক্তব্যে ধর্ষণ, যৌন হয়রানি তথা সকল প্রকার নারী ও কন্যা নির্যাতনের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা, জোরালো প্রতিরোধ ও প্রতিকার আন্দোলন গড়ে তোলারও আহ্বান জানানো হয়। এছাড়া মানবতার বিরুদ্ধে সংগঠিত সকল প্রকার অনাচার ও সহিংস আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সংস্কৃতি গড়ে তোলা এবং এ লক্ষ্যে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ করে নির্যাতন মুক্ত পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয়।
মতবিনিময় সভায় অংশগ্রহনকারী বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ বলেন, নারী নির্যাতন বন্ধ হতেই হবে। পরিবার হতে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। সহিংসতা, নির্যাতনের ঘটনার দ্রুত বিচার হতে হবে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি হতে বেরিয়ে আসতে হবে। সুপ্রীমকোর্টের ইতিবাচক রায়গুলো প্রচার করতে হবে। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। পাঠ্যসূচিতে নারী অধিকার ও শিশু অধিকারের বিষয় অন্তর্ভূক্ত করতে হবে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আয়শা খানম বলেন, 'নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। আরও কিভাবে কাজ করলে এ্টা বন্ধ হবে সেজন্য এই মতবিনিময় সভার বক্তাদের সুপারিশ নিয়ে ভবিষ্যতে আরও জোরালোভাবে কাজ করতে হবে। নারী ও কন্যা নির্যাতন ও সামাজিক অনাচার বন্ধ হতেই হবে। এজন্য সামাজিক প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।'
তিনি বিচারক, বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সম্পাদক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সংস্কৃতি কর্মী, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের নেতৃবৃন্দসহ নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ বিষয়ে জাতীয় কমিটি ঘোষণা করেন।
মতবিনিময় সভায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের উপদেষ্টা সেলিনা খালেক, কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি. ডা. মাখদুমা নার্গিস ও নাহার আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাখী দাশ পুরকায়স্থ ও সীমা মোসলেম, অর্থ সম্পাদক দিল আফরোজ বেগম, লিগ্যাল এইড সম্পাদক সাহানা কবির, শিক্ষা ও সংস্কৃতি সম্পাদক বুলা ওসমান, রোকেয়া সদন সম্পাদক নাসরিন মনসুর, আইনজীবী, প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটি ও ঢাকা মহানগর শাখার নেতৃবৃন্দসহ মোট উপস্থিত ১২০ জন উপস্থিত ছিলেন।
মতবিনিময় সভা পরিচালনা করেন সংগঠনের লিগ্যাল অ্যাডভোকেসি এন্ড লবি পরিচালক অ্যাড. মাকছুদা আখতার।