Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ০৩ শুক্রবার, মে ২০২৪ | ২০ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

দক্ষিণাঞ্চলের নিম্ন আয়ের মানুষের জীবিকার উৎস 'গোল গাছ'

জাহিদ রিপন, পটুয়াখালী প্রতিনিধিঃ
প্রকাশিত: ২৫ নভেম্বর ২০১৮, ০২:০৫ PM
আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০১৮, ০২:০৫ PM

bdmorning Image Preview


পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন বনাঞ্চলের ছয় হাজার সতের বর্গ কিলোমিটার বিশাল এলাকায় ৩৩৪ প্রজাতির বৃক্ষের মধ্যের একটি হল গোল গাছ। দেখতে গোল না হলেও তবুও নাম তার গোল গাছ। নামের উৎস জানার চেষ্টা করেও গোল গাছের অন্য কোন নাম জানা যায়নি। পাম গোত্রের ম্যানগ্রোভ প্রজাতির উদ্ভিদ গোলগাছ। সারিবদ্ধ ঘন ঝোপের মত বেড়ে ওঠা গোল গাছ দেখতে অনেকটা নারিকেল গাছের মত।

তবে নারিকেল গাছের মত লম্বা কাণ্ড নেই। গোলগাছের ডাল নারিকেল গাছের ডালের মত। পাতাও অনেকটা নারিকেল গাছের পাতার মত। তাই সাধারণভাবে একে অনেকে নারিকেল গাছের প্রজাতিও মনে করে অনেকেই। 

সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় গোলগাছ একটি অর্থকারী সম্পদ। সাগরের পানি চলাচলের এলাকাগুলোতে বিভিন্ন নদী-খালের মোহনায় পলি জমে জেগে ওঠা চর এবং পাড়ে গোল গাছ জন্মাতে দেখা যায়। অবহেলা, অযতœ আর নির্বিচারে পাতা কাটার কারণে গোল গাছের অস্তিত্ব এখন হুমকির সম্মুখীন। অর্থকারী সম্পদ এই গোল গাছ আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে।

বন বিভাগ অফিস সূত্রে জানা যায়, পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, পিরোজপুর, বাগেরহাট, খুলনা, সুন্দরবনে প্রচুর গোল গাছ জন্মে। এসব এলাকার পলিযুক্ত মাটি, মৌসুম ভিত্তিক নোনা পানি এবং অবাধ পানির প্রবাহ গোলগাছ বেড়ে ওঠার জন্য সহায়ক। 

গোলগাছের চাষী সজলের সাথে আলাপ করে জানা যায়, গোল গাছের এক একটা ছড়ায় একশ থেকে দেড়শ বীজ হয়। এই বীজগুলো কাঁদা মাটিতে, নিচু ও অবাধ পানি চলাচলের জায়গায় বীজ পুতে রাখলেই চারা জন্মায়। আর এ কারণেই গোল গাছের চাষাবাদ সহজ ও সুবিধাজনক। ভাইরাসসহ অন্যান্য রোগাক্রমণের সম্ভবনাও কম। চাষাবাদের সময় রাসায়নিক সার বা কীটনাশক ব্যবহারের প্রয়োজনও নেই। ফলে মোটা অংকের অর্থ বিনিয়োগেরও প্রয়োজন হয়না। জমিতে ফসল বা অন্য কোন বনজ কিংবা ফলজ গাছের তুলনায় গোলগাছের আবাদ কম লাভজনক নয়। আর এ কারণেই গোল গাছ আমাদের জাতীয় সম্পদগুলোর অন্যতম। 

গোল পাতার দক্ষিণাঞ্চলে রয়েছে ব্যাপক কদর। গোল গাছের রস, শিকর, ফল এবং পাতার রয়েছে বহুমুখী ব্যবহার। গোল গাছের পাতা দারা ঘরের চাল, নৌকার ছাউনি হিসাবে ব্যবহৃত হয়। কুটির শিল্পের অপরাপর কাজেও গোল গাছের পাতার রয়েছে বহুমুখী ব্যবহার। হাজার হাজার মানুষ গোল পাতা সংগ্রহ করে বিক্রির মাধমে জীবিকা নির্বাহ করে। 

গোল গাছে প্রতি বছর একবার একটি বা দু'টি লম্বা ছড়ায় ফল ধরে। সাধারণত ভাদ্র-আশ্বিন মাসে এই ফল ধরে। খেজুর গাছের মত কাধিতে এই ফল হয়। স্থানীয় ভাষায় এই ফলকে 'গাবনা' বলে। পরিপক্ক হলে এই ফল কেটে খাওয়া যায়। খেতে অনেকটা কাঁচা তালের শাসের মত। তবে নোনতা স্বাদ যুক্ত, রসালো এবং সুমিষ্টি। গোলগাছের ছড়ার সম্মুখ ভাগ কেটে বছরের অগ্রহায়ণ থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত দিনে দু'বার করে রস সংগ্রহ করা হয়। গোলের কাঁচা রস খেতে খুব সুস্বাদু, বৈচিত্রধর্মী এবং ভিন্ন আবেদনের সামান্য লবনাক্ত স্বাদের । এ রসের পিঠা বা পায়েস অতি মুখরোচর হয়। কেউ কেউ এই রস দিয়ে তাড়ি (এলকোহল) তৈরি করে।

গোল গাছের রস সংগ্রহকারীদের স্থানীয় ভাষায় শিয়ালী বলা হয়। ভাল মানের রস অহরনের জন্য শিয়ালীরা কার্তিক মাসের শুরুতেই হৃষ্টপুষ্ট ছড়াটি রেখে ফলসহ বাকি অংশটা কেটে ফেলে। রেখে দেওয়া ছড়াটি বিশেষ পদ্বতিতে রস সংগ্রহের উপযোগী করে তোলা হয়। দিনে দু'বার কেটে রস সংগ্রহ করা হয়। সংগৃহীত রস অধিক তাপে উনুনে ফুটিয়ে গুড় তৈরি করা হয়। অতি মিষ্টি এই গুড় খুবই প্রিয়। 

এক সময় এ গুড়ের পরিচিতি এলাকার তেমন থাকলেও বর্তমানে এটি বেশ বাণিজ্যিক প্রসারতা লাভ করেছে। এখন বিভিন্ন হাটে-বাজারে এ গুড় পাওয়া যাচ্ছে। খেজুর বা আখের গুড় ৫৫-৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি হলেও গোলের গুড় ৮০-৮৫টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। এক কেজি গোল পাটালীর দাম এক থেকে দেড় হাজার টাকা। চাহিদার তুলনায় এই গুড় বাজারে কম পাওয়া যায়। আখের রসে যেখানে শতকরা ১৫-২০ ভাগ শর্করা থাকে সেখানে গোল গাছের গুড়ে শতকরা ১৩-১৮ ভাগ শর্করা থাকে। 

গোলগাছের নানামুখী ব্যবহার, গুন এবং অর্থনৈতিকভাবে বেশ লাভজনক হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র পৃষ্টপোষকতার অভাবে এর বিকাশ ও প্রসার ঘটছে না। দেশের নদী বা খালের মোহনার পতিত জমিতে গোলগাছ চাষ, রক্ষণাবেক্ষণে কৃষকদের আগ্রহী করে এর বাণিজ্যিক প্রসার ঘটাতে পারলে সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতি লাভবান হত।

চাহিদার বিপরীতে বিপুল চিনি ঘাটতি পুরনে এই গাছ থেকে আহরিত রসের মাধ্যমে চিনি উৎপাদন সম্ভব। পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক বেকার জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগানো যেত। প্রাকৃতিক এই সম্পদকে কাজে লাগিয়ে দেশের অর্থনীতিতে আনা যেত বৈপ্লবিক পরিবর্তন। 


 

Bootstrap Image Preview