বিএনপির চেয়ারপারসন কারাবন্দি খালেদা জিয়ার জীবনী নিয়ে লেখা বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছে। বইটি লিখেছেন সিনিয়র সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ। ইংরেজি ভাষায় রচিত বইটির নাম ‘বেগম খালেদা জিয়া: হার লাইফ, হার স্টোরি’।
রবিবার (১৮ নভেম্বর) বিকালে রাজধানীর গুলশানে লেকশোর হোটেলে এক অনুষ্ঠানে এ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। ইংরেজিতে লেখা ৭৭১ পৃষ্ঠার এ বইটির মূল্য দুই হাজার টাকা।
অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আসিফ নজরুল বলেন, ‘‘সহানুভূতি দিয়ে বেগম জিয়ার উত্থান, তবে রাজনীতিতে অধিকার প্রতিষ্ঠায় এরশাদবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে ‘আনপ্যারালাল’ ভাবমূর্তি গড়ে তুলে ছিলেন, যা শত প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও এখনও তিনি ধরে রেখেছেন। শুধু তাই নয়, খালেদা জিয়া একমাত্র নেত্রী, যিনি দেশবিরোধী কোনও কাজে কখনও আপস করেননি। সবর্দাই দেশের প্রয়োজনে, জনগণের প্রয়োজনে নিজেকে আত্ম-নিয়োজিত করেছেন। এখনও অব্যাহত রেখেছেন।’
ড. আসিফ নজরুল বলেন, ‘বাংলাদেশের মত দেশে বায়োগ্রাফি লেখা কষ্টসাধ্য। তারপরও তিনি (মাহফুজ উল্লাহ ) যে ঝুঁকি নিয়েছেন, সেজন্য শুধু বিএনপি নয় নিরপেক্ষ সবাইকে তার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতে হবে, শ্রদ্ধা করা উচিত।’
তিনি আরও বলেন, ‘আজ যারা কথায় কথায় গ্রেনেড হামলার কথা বলেন, তাদেরসহ সবাইকে ভুলে গেলে চলবে না যে, বাংলাদেশে প্রথম খালেদা জিয়ার জনসভায় গ্রেনেড হামলা করা হয়েছে।’
ডেইলি নিউজ এজ পত্রিকার সম্পাদক নুরুল কবির বলেন, ‘খালেদা জিয়া যখন দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসেন, তখন তার পাশাপাশি একটি প্যারালাল সরকার গড়ে উঠেছিল, সেই ব্যাপারে আসলে তার (খালেদা জিয়া) মনোভঙ্গি কী ছিল? এই বইয়ে তার উত্তর নাই, যা আমাদের জানা দরকার।’
তিনি আরও বলেন, ‘খালেদা জিয়া কি আসলে মনে মনে এটা পুরোটা সমর্থন করেছিলেন? তিনি কি নিজে কখনও এটাকে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলেন? তিনি কি এরমধ্যে বাড়াবাড়ি দেখেছিলেন? তার কি প্রশ্রয় ছিল? সেসব কারণে আজকে দল ও তাকে যেসব বেদনাদায়ক পরিস্থিতিতে যেতে হয়েছে, সেখানে কি তার দায় আছে? নাকি সঠিক ছিল, যা আমরা ভুল হিসেবে দেখছি। এর একটা আলোচনা বইটিতে থাকা উচিত ছিল।’
নুরুল কবির বলেন, ‘খালেদা জিয়ার দুটো প্রশংসার দাবি দেখি। উনাকে ভারত অপছন্দ করেন। তারপরও তার দলের বহুলোক গোপনে ও প্রকাশ্যে ভারতের নীতি-নির্ধারকদের সঙ্গে কোনও একটা মীমাংসার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আমি মনে করি, সেটা জাতীয়তাবাদী শক্তির ভুল রাজনীতি। প্রশ্ন হচ্ছে, এত কিছুর পরও ওই ভদ্রমহিলাকে ভারত যে বিশ্বাস করে না, এটাই খালেদা জিয়ার শক্তি। তার দেশপ্রেমিকের পরিচয়।’
সাংবাদিক নুরুল কবির বলেন, ‘দ্বিতীয় প্রশ্নটা হচ্ছে, খালেদা জিয়া বাহুবলে রাজা নন, আমি এটা বিশ্বাস করি না। বাহুবলে রাজা হয়েছিলেন এরশাদ। আমার ধারণা, খালেদা জিয়া জনপ্রিয়তায় বলিয়ান। তিনি তার যাত্রা অব্যাহত রেখেছেন।;
প্রকাশনা অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন, প্রফেসর লায়লা এন ইসলাম, সাবেক রাষ্ট্রদূত আনোয়ার হাশিম, অবসরপ্রাপ্ত জজ ও কলামিস্ট ইকতেদার আহমেদ প্রমুখ।
৭০০ পৃষ্ঠার এই বইয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক জীবন ও সংগ্রামের গল্প তুলে ধরা হয়েছে। বইটিতে খালেদা জিয়ার ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বের কথাও বলা হয়েছে। বইয়ে ২০০৭ সালের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষ সময় পর্যন্ত তুলে ধরা হয়েছে। ১৯৪৫ সালের দিনাজপুরে জন্ম নেওয়া খালেদা খানম পুতুল কীভাবে সেনা কর্মকর্তা জিয়াউর রহমানের স্ত্রী হলেন, স্বামীর মৃত্যুর পর গৃহবধূর দায়িত্ব ছেড়ে নেন বিএনপির— এসবের বর্ণনা আছে বইটিতে।
বইটির লেখক সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘বেসিক্যালি এই বইটা করা হয়েছে খালেদা জিয়ার জীবন ও জীবনের গল্প নিয়ে। তার রাজনৈতিক সংগ্রাম তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তার উত্থানের গল্প আছে বইটিতে। এই গ্রন্থে খালেদা জিয়ার ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বের বিষয়ে বলা হয়েছে।’
১৯৮১ সালের ৩০ মে এক ব্যর্থ সামরিক অভুত্থ্যানে জিয়াউর রহমান নিহত হন। এরপর প্রায় ৭ মাস পর দলের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের আহ্বানে ১৯৮২ সালে ৩ জানুয়ারি বিএনপিতে যোগ দেন খালেদা জিয়া। রাজনীতিতে তার আগমন এবং ‘আপসহীন’ নেতৃত্ব, সামরিক এরশাদ সরকার বিরুদ্ধে টানা আট বছরের সংগ্রাম শেষে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার গল্পগুলো তুলে এনেছেন মাহফুজউল্লাহ। তার লেখা এ বইয়ে বিশেষ প্রাধান্য পেয়েছে ওই সময়ের ঘটনা ও ঘটনার আড়ালের গল্প। ১৯৯১-এর আগে রাজনৈতিক সংগ্রাম, আন্দোলন এবং ২০০৬ সাল পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদে খালেদা জিয়ার জেলজীবন বইটির বড় অংশজুড়ে রয়েছে। তবে খালেদা জিয়ার গত কয়েক বছরে দলের নেতৃত্ব, ২০১৫ সালের তিন মাসের অবরোধ, ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যু, গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে তিন মাস অবস্থান, গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে কারাবাস— এসব ঘটনা এ বইয়ে তুলে আনতে পারেননি সাংবাদিক মাহফুজউল্লাহ।
মাহফুজ উল্লাহ বলেন, ‘বেগম খালেদা জিয়া: হার লাইফ, হার স্টোরি’ বইয়ের কাজটি তো অনেক বছর ধরে করছি। ৭০০ পৃষ্ঠার বই, দীর্ঘ সময়। এর মধ্যে সর্বশেষ কেয়ারটেকার সরকারের সময় পর্যন্ত তুলে ধরা হয়েছে।’
প্রসঙ্গত, সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ এর আগে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জীবনীগ্রন্থ রচনা করেছেন। ওই বইটির নাম ‘প্রেসিডেন্ট জিয়া অব বাংলাদেশ: অ্যা পলিটিক্যাল বায়োগ্রাফি’।