Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ০৩ শুক্রবার, মে ২০২৪ | ২০ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল বাঁচাতে 'টিআরএম পদ্ধতির বিকল্প নেই'

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৫ অক্টোবর ২০১৮, ০৮:১১ PM
আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০১৮, ০৮:১১ PM

bdmorning Image Preview
প্রতীকী


এসএম বাচ্চু, তালা (সাতক্ষীরা) প্রতিনিধি:

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের জলাবদ্ধতা একটি প্রধান সমস্যা। সাতক্ষীরা-খুলনা-যশোর অঞ্চলের প্রায় ৬০ লক্ষ মানুষ এ সমস্যা দ্বারা আক্রান্ত। বিগত ৩০-৩৫ বছর যাবৎ এ সমস্যাটি অব্যাহত আছে। এ সমস্যার কারণে অনেক এলাকা বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে এবং প্রতি বছর এলাকা থেকে ভিটেমাটি ত্যাগ করে আশ্রয়ের সন্ধানে মানুষ অন্যত্র চলে যাচ্ছে।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশেষজ্ঞরা এ আশঙ্কা ব্যক্ত করছেন যে, কোন কার্যকরী পদক্ষেপ গৃহীত না হলে ২০৩০ সালের মধ্যে এলাকার ১৭ ভাগ এবং ২০৮০ সালের মধ্যে ৮০ ভাগ এলাকায় স্থায়ীভাবে জলাবদ্ধতার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল বড় ধরণের বিপর্যয় ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে।

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ভূ-প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য অনন্য। দক্ষিণে রয়েছে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ বনাঞ্চল সুন্দরবন। নদী হচ্ছে এ অঞ্চলের মানুষ, প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের প্রাণ। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের নদী থেকে এ অঞ্চলের নদীগুলো সম্পূর্ণ আলাদা। এ নদীগুলো মূলত জোয়ার বাহিত নদী।

এ অঞ্চলের নদ-নদীগুলোর নাব্যতা সংকট জলাবদ্ধতার প্রধান কারণ। নদী বক্ষে উপর্যুপরি পলি জমে প্রতি বছর নদীগুলোর উপরের দিক থেকে মরতে মরতে নিচের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। নদী হারিয়ে ফেলেছে তার নিষ্কাশন ক্ষমতা। জলাবদ্ধতার সাথে যে সব বিষয়গুলো যুক্ত তা হচ্ছে পোল্ডার ব্যবস্থা, পদ্মাপ্রবাহের সাথে এলাকার বিচ্ছিন্নতা, একতরফা ভূমির নিম্নগমণ, অপরিকল্পিত চিংড়ী চাষ, অপরিকল্পিত ব্রিজ কালভার্ট নির্মাণ, নদী ও খাল দখল, জলবায়ু পরিবর্তন জনিত সমস্যা তথা অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি প্রভৃতি সমস্যা একসাথে যুক্ত হয়ে জলাবদ্ধতা সমস্যার তীব্রতা যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমনি এলাকায় দেখা দিয়েছে পরিবেশ বিপর্যয়। এ অবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য প্রয়োজন এলাকার ভূ-প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষার উপযোগী কর্মসূচি। এলাকার উন্নয়ন কর্মকান্ডে দীর্ঘমেয়াদী, সমন্বিত এবং টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার বলে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

কিন্তু বিগত শতকে বিভিন্ন সরকার দ্বারা এ অঞ্চলের জন্য গৃহীত সিংহভাগ উন্নয়ন প্রকল্পই এ এলাকার অনন্য বৈশিষ্ট্য ও এলাকার মানুষের জোয়ার ভাটা নদী ব্যবস্থাপনার বিশেষ জ্ঞানকে আমলে নেয়নি। উপকূলীয় বাঁধ প্রকল্প বা পোল্ডার ব্যবস্থা এর উদাহরণ। এ সবের কারণে ইতিমধ্যে এলাকার অসংখ্য নদীর মৃত্যু হয়েছে এবং এ অনন্য ভূ-প্রকৃতি মানুষের জীবন জীবিকা ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মধ্যে পড়েছে। নদীগুলো হচ্ছে- কপোতাক্ষ, বেতনা, মরিচ্চাপ, সাপমারা, লাবণ্যবতী, হাওড়া, গলঘেষিয়া, শালিখা, পশ্চিম শালতা, হাড়িয়া, লোয়ার শালতা, শোলমারী, ঝপঝপিয়া, জয়খালী, মধ্যভদ্রা, হামকুড়া, হরি, আপার ভদ্রা প্রভৃতি।

নাব্যতা সংকটের কারণে বিগত ২০০৮ সালে দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকাজুড়ে জলাবদ্ধতাজনিত ভয়াবহ বন্যা সংঘটিত হয়। সিইজিআইএস এর এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী কেবলমাত্র ২০০৮ সালে যশোর, সাতক্ষীরা, খুলনা ও ঝিনাইদহ জেলার ৮টি উপজেলায় ৬০টি ইউনিয়নের ৪৭০ টি গ্রামে ৩৮০২০ হেঃ এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যার জনসংখ্যা ৯,৪৭,৩৪৯ জন।

এ ছাড়া ২০০৯, ২০১১, ২০১৩ ও ২০১৫ সালের বন্যায় এ অঞ্চলের প্রায় সবকটি উপজেলায় প্রায় অর্ধকোটি মানুষ জলাবদ্ধতা ও বন্যার কবলে পড়ে। প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকার জানমাল ও সম্পদের ক্ষতি হয়।

পলি ভরাটকে জলাবদ্ধতার প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। পলি ভরাট হওয়ার মূল কারণ হলো- বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে নির্মিত উপকূলীয় বাঁধ বা পোল্ডার। পোল্ডার মূলত একটি ডাচ্ প্রযুক্তি। পোল্ডারের মাধ্যমে নদীর দু’পাশে বাঁধ নির্মাণ করা হয় এবং অভ্যন্তরীণ বর্ষার পানি নিষ্কাশন করার জন্য নির্মিত হয় স্লুইজগেট।

ষাটের দশকে নোনা পানির অনুপ্রবেশ, জলোচ্ছ্বাস-বন্যা প্রতিরোধ এবং কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সমগ্র উপকূলীয় অঞ্চলজুড়ে নির্মাণ করা হয় ১৭৯টি পোল্ডার, যারমধ্যে ৩৯টি পোল্ডার নির্মিত হয় দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে। এই পোল্ডারের ফলে প্লাবন ভূমির সাথে নদীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয় এবং ধীরে ধীরে এলাকার নদীগুলোর নাব্যতা সংকট দেখা দেয়। ফলে একদিকে যেমন প্রাকৃতিক পলি ব্যবস্থাপনার পথ বন্ধ হয় অন্যদিকে তেমনি এলাকার মানুষকে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা ও পরিবেশগত বিপর্যয়ের মুখোমুখী হতে হয়।

প্রায় দেড়শ বছর পূর্বে এ এলাকার নদীগুলো উজান তথা পদ্মা প্রবাহের সাথে তার সংযোগ হারিয়ে ফেলে। এ অঞ্চলের নদীগুলোতে উজান স্রোত না থাকায় নদীতে পলি জমার হার যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনি এলাকায় লবণাক্ততার পরিমাণও বেড়ে যাচ্ছে এবং ভূগর্ভের জলাধারে দেখা দিয়েছে পানির স্বল্পতা। পোল্ডার ও উজান বিচ্ছিন্নতা ছাড়াও এ অঞ্চলের বহু নদী ও খাল ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণ হলো অপরিকল্পিত ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণ ও নদী খাল দখল। এর ফলে বিল ও গ্রাম থেকে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন খুব কঠিন হয়ে পড়েছে এবং জলাবদ্ধতার প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বিগত তিন চার দশক যাবৎ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস-বন্যা এবং নদীতে জোয়ারের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ এলাকায় বিদ্যমান দুর্বল পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা এ ধরণের প্রাকৃতিক সমস্যাকে বড় ধরনের দুর্যোগে পরিণত করেছে। তাছাড়া সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে প্রতি বছর বিভিন্ন এলাকায় উপকূলীয় বাঁধ ভেঙে যাওয়া বা উপচে প্লাবিত হওয়ায় জনদুর্ভোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা গেছে, এ এলাকায় স্থান বিশেষ প্রতি বছর ২-৮ মিমি পর্যন্ত ভূমির নিম্নগমন হচ্ছে। এ ছাড়া আশির দশকে এলাকায় ব্যাপকহারে নোনা পানির চিংড়ী ও মাছের চাষ শুরু হয়। অপরিকল্পিত চিংড়ী চাষ পরিবেশ বিধ্বংসী, জলাবদ্ধতা পরিস্থিতি সংকটময় করে তোলে এবং সামাজিক ক্ষেত্রে ঘটায় বিভিন্ন ধরণের বিশৃঙ্খলা। চিংড়ীচাষের প্রভাবে এ অঞ্চলে প্রকট আকারে সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে ধান, সবজিসহ বিভিন্ন ফসল হারিয়ে যাচ্ছে এবং এলাকার গাছপালা ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে। কর্মসংস্থানের অভাবে বহু মানুষ তাদের পেশাগত পরিবর্তনে বাধ্য হচ্ছে এবং এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে।

জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য সরকার এবং বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা নানবিধ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে আসছে। ৯০ দশকে স্থানীয় জনগণ তাদের লোকজ জ্ঞানের ভিত্তিতে জলাবদ্ধতা নিরসনের একটি কার্যকরী পদ্ধতি উদ্ভাবন করে। এ পদ্ধতির মাধ্যমে উপকূলীয় বাঁধ কেটে বিলের মধ্যে জোয়ার ভাটার প্রবেশ ও নির্গমনের সুযোগ করে দেয়া হয়। জোয়ার বাহিত পলি বিলের মধ্যে অবক্ষেপিত হয়ে নিচু বিল উঁচু হয় এবং নদী বক্ষে পলি জমতে না পেরে নদী তার পুনর্জীবন ফিরে পায়। বিল ডাকাতিয়া, বিল বুড়ুলী-পাথরা, বিল ভায়না প্রভৃতি বিলে এ পদ্ধতি প্রয়োগে সফলতা প্রমাণিত হলে সরকার কর্তৃক টিআরএম নাম দিয়ে এ পদ্ধতিকে স্বীকৃতি দিয়ে সরকারীভাবে ভবদহ এলাকায় বিল কেদারিয়া, বিল খুকশিয়া ও কপোতাক্ষ অববাহিকায় পাখিমারা বিলে টিআরএম বাস্তবায়ন করা হয়।

টিআরএম বাস্তবায়নের ফলে দেখা গেছে এলাকায় জলাবদ্ধতার যেমন প্রশমন ঘটেছে তেমনি পরিবেশ প্রতিবেশ সংরক্ষনেও এ পদ্ধতি কার্যকরী। এলাকার বিদ্যমান বর্তমান অবস্থা মোকাবেলার জন্য আপাততঃ টিআরএম পদ্ধতির বিকল্প নেই বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।

Bootstrap Image Preview