সরকারি কর্মচারীদের গ্রেফতারের আগে সরকার তথা ওই কর্মচারীর নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের অনুমতি লাগবে-এমন বিধান রেখে ‘সরকারি চাকরি বিল-২০১৮’ জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেক বিলটি পাসের প্রস্তাব উত্থাপন করলে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়।
এক্ষেত্রে বিরোধী দলের জোরালো আপত্তি সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে নাকচ হয়ে যায়।
আজ বুধবার ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট মো. ফজলে রাব্বী মিয়ার সভাপতিত্বে সংসদ অধিবেশনে বিলটি পাসের আগে জনমত যাচাই ও বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব দেন বিরোধী দল ও স্বতন্ত্র সদস্যরা। আপত্তির বিষয়গুলো নিয়ে সংসদে আলোচনা হলেও তা গৃহীত হয়নি। আলোচনা শেষে এ সংক্রান্ত প্রস্তাব কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়।
গত ২১ অক্টোবর বিলটি সংসদে উত্থাপনের পর অধিকতর পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়। বিলটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে সংসদে প্রতিবেদন জমা দেয় সংসদীয় কমিটি।
পাস হওয়া বিলের একাদশ অধ্যায়ের সরকারি কর্মচারী ফৌজদারি অপরাধ শীর্ষক ৪১ ধারার উপধারা (১)-এ বলা হয়েছে ‘কোনো সরকারি কর্মচারীর দায়িত্ব পালনের সহিত সম্পর্কিত অভিযোগে দায়েরকৃত ফৌজদারি মামলায় আদালত কর্তৃক অভিযোগপত্র গৃহীত হইবার পূর্বে, তাহাকে গ্রেফতার করিতে হইলে সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি গ্রহণ করিতে হইবে।’
তবে ১৯৬৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা অনুযায়ী দুদক অনুসন্ধান ও তদন্ত পর্যায়েও যে কাউকে গ্রেফতার করতে পারে।
বিলের উপর আনা জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনাকালে বিরোধী দল ও স্বতন্ত্র সদস্যরা ওই বিধানের সমালোচনা করেন। তারা বলেন, ফৌজদারি অপরাধের জন্য মন্ত্রী-এমপিদের গ্রেফতারের অনুমতি লাগে না। কিন্তু তাদের অধীনে সরকারী কর্মচারীদের গ্রেফতারের জন্য কর্তৃপক্ষের অনুমতি লাগবে। এটা বৈষম্যমূলক। কোন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা হলেই তিনি বরখাস্ত হবে। এটা কালো বিধান। এধরণের বিধানগুলো পরিবর্তন করার দাবি জানান তারা।
জবাবে শ্রম প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেক বলেন, সিভিল সার্ভিসের উপর একটি সমন্বিত আইনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সকল পর্যায়ের সরকারী কর্মচারীদের একটি আইন কাঠামোর আওতায় আনতে এই আইন প্রণয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই আইনটি পাস হলে তা হবে একটি মাইলফলক। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বিলটি চূড়ান্ত করা হয়েছে। ফলে নতুন করে যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজন নেই।
বিলের একই ধারার ৩ উপধারায় বিচারাধীন কোন ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তি সরকারি কর্মচারী বলে দৃষ্টিগোচর হলে তা সরকার ও নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার বিধান রাখা হয়েছে।
একই ধারায় বলা হয়েছে, কোনো কর্মচারি ফৌজদারি অপরাধের কারণে এক বছরের অধিক মেয়াদে কারাদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হলে রাষ্ট্রপতি যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হন যে, আদালত কর্তৃক কারাদণ্ড প্রাপ্ত ও চাকরি থেকে বরখাস্ত বা অপসারণকৃত ব্যক্তিকে অনুরূপ বরখাস্ত বা অপসারণ থেকে অব্যাহতি প্রদানের বিশেষ কারণ বা পরিস্থিতি রয়েছে- তা হলে তিনি ওই ব্যক্তিকে ওই শাস্তি থেকে অব্যাহতি প্রদান করতে পারবেন। সেই ক্ষেত্রে ওই কর্মচারি পুনরায় চাকরিতে বহাল হবেন।
বিলের চতুর্থ অধ্যায়ে ৭ ধারায় সরকারি চাকরিতে নিয়োগ লাভের একমাত্র মানদণ্ড ও ভিত্তি হিসেবে মেধা ও উম্মুক্ত প্রতিযোগীতা স্থির করা হয়েছে। পদোন্নতির মানদণ্ড ধরা হয়েছে কর্মচারির মেধা, দক্ষতা, জ্যেষ্ঠতা, প্রশিক্ষণ এবং সন্তোষজনক চাকরি। আরো বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নাগরিক নন, এমন কোনো ব্যক্তিকে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ করা যাবে না। সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে বিজ্ঞপ্তিতে অবশ্যিকভাবে পদের বেতন, কর্মপরিধি, নিয়োগ পরীক্ষার ধরণ, বিষয়, নম্বর বিভাজন এবং পরীক্ষায় উত্তীর্ণ নূন্যনতম নম্বর উল্লেখ থাকতে হবে। নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ নহে এমন কোনো ব্যক্তিকে নিয়োগের সুপারিশ করা যাবে না। আর পদোন্নতির জন্য নির্ধারিত শর্ত পূরণ না করলে কিংবা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলে কাউকে পদোন্নতি দেওয়া যাবে না বলেও বিলে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিলে বলা হয়েছে, জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে কর্মচারিদের মধ্যে পারষ্পরিক জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করা হবে। কোনো পদে জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণে সুষ্পষ্ট বিধান না থাকলে বা জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ সম্ভব না হলে কর্তৃপক্ষ যা উপযুক্ত মনে করবে, তার ভিত্তিতেই জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করতে পারবে। আর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া কাউকে আত্মীকরণ করা যাবে না।
বিলে কোন সরকারি কর্মচারি আচরণ, শৃঙ্খলা জনিতকারণে দোষী সাব্যস্ত হলে তার বিরুদ্ধে লঘু ও গুরুদ- আরোপের বিধান রাখা হয়েছে। বিলের দশম অধ্যায়ে ৩২ ধারায় বলা হয়েছে, লঘুদ- হিসেবে তিরস্কার, নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য পদোন্নতি বা বেতন বৃদ্ধি স্থগিত করা, বেতন স্কেল নিম্নধাপে অবনমিতকরণ করা হবে। গুরুদণ্ড হিসেবে নিম্ন পদ বা নিম্নতর বেতন স্কেলে অবনতিমকরণ, বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান, চাকরি থেকে অপসারণ এবং চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হবে। কোন কর্মচারির ইচ্ছাকৃত অবহেলার কারণে সরকারি অর্থ বা সম্পত্তির ক্ষতি সাধিত হলে দায়ী ব্যক্তির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করা হবে। প্রয়োজনে তার বেতন ভাতা থেকে আদায় করা হবে। তাতেও সম্ভব না হলে কর্মচারির বিরুদ্ধে পাবলিক ডিমান্ড রিকোভারি এ্যাক্ট ১৯১৩ এর অধীন আইনী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে অভিযুক্ত কর্মচারি, শাস্তির বিরুদ্ধে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে আপিল করতে পারবেন এবং কর্তৃপক্ষ যে রায় দেবেন তা বহাল থাকবে। সেক্ষেত্রে শাস্তি বহাল থাকা বা বাতিল করার এখতিয়ার কর্তৃপক্ষের।