সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগজির হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহভাজন ১৫ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে তুরস্কের গণমাধ্যম। তুর্কি কর্মকর্তাদের দাবি, সৌদি নাগরিকের সমন্বয়ে গঠিত ওই হিট স্কোয়াড মিস্টার খাশোগজির হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন।
সৌদি সরকারের সমালোচনাকারী জামাল খাশোগজি গত ২রা অক্টোবর ইস্তান্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে প্রবেশ করেন, কিন্ত এরপর থেকে তাঁর আর কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না।
খাশোগজি কনস্যুলেটে পৌঁছানোর ঘণ্টাখানেক আগেই সন্দেহভাজনদের বেশিরভাগ দু'টি ব্যক্তিগত উড়োজাহাজে ইতাবুলে আসেন। বিমান দু'টির টেইল নম্বর ছিল এইজিএসকে - ১ এবং এইজিএসকে - ২। ওই একইদিন তাঁরা আবার ওই বিমানগুলোতেই সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে ফিরে যান।
বিবিসি সূত্রে সন্দেহভাজনদের পরিচয়:
ড. সালাহ মুহাম্মদ এ তুবাইজি: সাতচল্লিশ বছর বয়সী এই ব্যক্তি একজন ফরেনসিক প্যাথোলজিস্ট, যিনি স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এ বিষয়ে মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন। ২০১৫ সালে তিনি টানা তিন মাস অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়ান ইন্সটিটিউট অব ফরেনসিক মেডিসিনে কাজ করেন।
নিজস্ব টুইটার অ্যাকাউন্টে তাঁর পরিচয় দেয়া আছে ফরেনসিক মেডিসিনের অধ্যাপক এবং সৌদি সাইন্টিফিক কাউন্সিল অব ফরেনসিকের প্রধান হিসেবে। তাঁর এই টুইটার অ্যাকাউন্টটি সৌদি আরবের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যুক্ত।
২০১৪ সালে লন্ডনের একটি আরবী ভাষার সংবাদপত্র "আশরাক আল-আওসাত"-এর খবরে জানা যায়, ড. তুবাইজি সে সময় সৌদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জেনারেল ডিরেক্টরেট অব পাবলিক সিকিউরিটির ফরেনসিক সায়েন্স বিভাগের লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। তাঁর ছবিযুক্ত একটি সাক্ষাতকারে দেখা যায় যে তিনি সেই পদের উপযুক্ত ইউনিফর্ম পরে আছেন।
সেই সাক্ষাতকারে তিনি নিজের নকশা করা একটি ভ্রাম্যমান পরীক্ষাগার নিয়ে আলোচনা করেন। তাঁর ওই ল্যাবরেটরির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল সেখানে মাত্র সাত মিনিটের মাথায় প্যাথোলজিস্টরা লাশের ময়নাতদন্ত করতে পারেন। হজ পালন করতে এসে যখন হাজীরা মারা যান, তখন যেন দ্রুততম সময়ে মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে জানা যায়, সে লক্ষ্যেই এই পরীক্ষাগারটি নকশা করেছিলেন তিনি।
তুর্কি কর্মকর্তারা এটাও জানান যে রিয়াদ থেকে ইস্তান্বুলের আতাতুর্ক বিমানবন্দরে যাওয়ার সময় ডা. তুবাইজি একটি "বোন স" বা করাত বহন করছিলেন। তিনি বেলা সোয়া তিনটার দিকে রিয়াদ থেকে ইস্তান্বুলে পৌঁছান এবং সৌদি কনস্যুলেটের পাশেই মুভেনপিক হোটেলে অবস্থান করেন।
পরে রাত ১১টার দিকে ব্যক্তিগত বিমানে দুবাই হয়ে রিয়াদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।
তুর্কি কর্মকর্তাদের অভিযোগ, মিস্টার খশোগজির অন্তর্ধানের দিনে কনস্যুলেটের ভেতরের অডিও রেকর্ডিংয়ে সম্ভবত ড. তুবাইজির কণ্ঠ শোনা গিয়েছে। তাদের মতে, সেখানে খাশোগজিকে নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়। এরপর সৌদি কর্মকর্তারা তাঁর লাশ টুকরো টুকরো করে ফেলেন।
এরপর তাদের কয়েকজন ওই দুটি ব্যক্তিগত বিমানে এবং বাকিরা বাণিজ্যিক বিমানে ইস্তান্বুল ছেড়ে যায়। তুর্কি কর্মকর্তারা ওই অডিও রেকর্ড থেকে একজন ডাক্তারকে সনাক্ত করেছেন, যিনি কিনা মিস্টার খাশোগজির মৃতদেহ টুকরো করার সময় অন্যদেরও তার সঙ্গে হেডফোনে গান শোনার কথা বলছিলেন।
মাহের আবদুল আজিজ এম মুতারেব: ৪৭ বছর বয়সী এই ব্যক্তি লন্ডনের সৌদি দূতাবাসে দুই বছর ধরে কাজ করেছেন বলে জানা গেছে। ২০০৭ সালে ব্রিটিশ সরকারের প্রকাশিত এক নথি থেকে জানা যায়, এই নামের একজন ফার্স্ট সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করতেন। সেই সূত্র ২০১১ সালে মিস্টার মুতারেবের সঙ্গে দেখা করেছিলেন এবং তিনি তাকে সৌদি আরবের হয়ে স্পাইওয়্যার প্রযুক্তি ব্যবহারের বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন বলেও জানা যায়।
সেই প্রশিক্ষক মুতারেবকে "অন্ধকার মুখো" বলে ডাকতেন, কেননা তিনি সবসময় বিরস মুখে খুব চুপচাপ থাকতেন। লন্ডনে একটি সৌদি সূত্রের বরাতে সিএনএন জানায়, মুতারেবের পরিচিতরা তাকে সৌদি গোয়েন্দা বিভাগে একজন কর্নেল হিসেবে পরিচয় দিয়েছে।
মার্চ মাসে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি সফরের একটি ছবিতে মাহের মুতারেব নামে এক ব্যক্তিকে দেখা গিয়েছিল। এরপর আরও তিনটি ইভেন্টে তাকে প্রিন্স মোহাম্মদের সঙ্গে দেখা যাওয়ায় ধারণা করা হয় যে তিনি হয়তো কোন নিরাপত্তায় দায়িত্বে ছিলেন।
তুরস্কের সরকার-পন্থী সংবাদপত্র "সাবাহ" সিসিটিভি ফুটেজ থেকে ওই ১৫ জনের ছবি প্রকাশ করে। সেখানে দেখা যায় মিস্টার মুতারেব ২রা অক্টোবর সকাল ১০ টার দিকে ইস্তান্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে প্রবেশ করছেন। অর্থাৎ তাঁরা পৌঁছান মিস্টার খাশোগজি সেখানে পৌঁছানোর তিন ঘণ্টা আগে।
পরে বিকেল ৪টার দিকে তিনি কনসাল জেনারেলের বাড়িতে যান।
তুর্কি গণমাধ্যম জানায় যে মিস্টার মুতারেব, ড. তুবাইজির সঙ্গে একই বিমানে ইস্তান্বুলে এসেছিলেন এবং একই হোটেলে অবস্থান করেন। একই দিন সন্ধ্যা ৬টা ৪০ মিনিটে স্কাই প্রাইম অ্যাভিয়েশনের আরেকটি ব্যক্তিগত বিমানে তিনি ইস্তান্বুল ছাড়েন বলে জানা যায়।
আব্দুল আজিজ মোহাম্মদ এম আলহাওসাউই: নিউইয়র্ক টাইমসের খবর অনুযায়ী, ৩১ বছর বয়সী এই ব্যক্তি একজন ফরাসি নিরাপত্তা কর্মকর্তা, যিনি সৌদি রাজপরিবারের সঙ্গে কাজ করেছিলেন। বিশেষ করে ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে সফরকারী নিরাপত্তা দলের সদস্য হিসাবেও তাঁর পরিচয় সনাক্ত হয়েছে।
মিস্টার আলহাওসাউই একটি বাণিজ্যিক ফ্লাইটে ইস্তান্বুলে এসেছিলেন। বেলা ২টার আগেই তিনি বিমানবন্দরে পৌঁছে যান। এরপর তিনি সৌদি কনস্যুলেটের এক কিলোমিটার দক্ষিণে ওয়য়াইন্ডহাম গ্র্যান্ড ইস্তান্বুল লেভান্ত হোটেলে অবস্থান করছিলেন। এবং তিনি ডা. তুবাইজির সঙ্গে ইস্তান্বুল ছেড়ে যান।
থার গালেব টি আলহারবি: গত অক্টোবরে জেদ্দায় ক্রাউন প্রিন্সের প্রাসাদের প্রতিরক্ষায় সাহসী ভূমিকা রাখার জন্য রয়্যাল গার্ডে কর্মরত এই নামের এক ব্যক্তিকে লেফটেন্যান্ট পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছিল। ওই ঘটনায় এক বন্দুকধারীর গুলিতে পাঁচজন নিহত হয়।
ঊনচল্লিশ বছর বয়সী মিস্টার আলহারবি ব্যক্তিগত বিমানে ইস্তান্বুল পৌঁছেছিলেন এবং ড. তুবাইজির হোটেলে অর্থাৎ মুভেনপিকে অবস্থান করেন। পরে দুই নম্বর ব্যক্তিগত বিমানে ফিরে যান।
মোহাম্মদ সাদ এইচ আলজাহরানী: ২০০৭ সালের একটি ইভেন্টের ছবি ও ভিডিওতে ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক রক্ষীর গায়ে এই নামের ব্যাজ পরে থাকতে দেখা যায়, এমনটি জানিয়েছেন ইয়াদ আল-বাগদাদি নামে একজন অ্যাকটিভিস্ট।
তুর্কি মিডিয়া জানায়, ৩০ বছর বয়সী মিস্টার আলজাহরানী একটি বাণিজ্যিক ফ্লাইটে ইস্তান্বুল পৌঁছেছিলেন এবং তিনি ওয়াইন্ডহ্যাম গ্র্যান্ড হোটেলে অবস্থান করেছিলেন। তিনিও ব্যক্তিগত বিমানে তুরস্ক ছাড়েন।
খালিদ এধ জি আলোতাইবি: ওয়াশিংটন পোস্টে বলা হয়েছে, সৌদি পাসপোর্টধারী একই নামের এক ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে যেতেন। তাঁর ভ্রমণের সময় সৌদি রাজ পরিবারের ভ্রমণের সময়ের সঙ্গে মিলে যায়।
ত্রিশ বছর বয়সী আলোতাইবি একটি বাণিজ্যিক ফ্লাইটে ইস্তান্বুল যান এবং ওয়াইন্ডহাম গ্র্যান্ড হোটেলে অবস্থান করেন। তিনি রাত ৯টা নাগাদ ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরের পাসপোর্ট নিয়ন্ত্রণ অফিসে ছিলেন।
নাইফ হাসান এস আলারিফি:
এই নামের এক ব্যক্তির ফেসবুক অ্যকাউন্টে সৌদি আরবের বিশেষ বাহিনীর চিহ্ন সম্বলিত ইউনিফর্ম পরা ছবি দেখা গেছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক সৌদি বংশোদ্ভূত সিরীয় উদ্যোক্তা কুতাইবি ইদলবি এই তথ্য জানান। তিনি মিস্টার খাশোগজির পরিচিত ছিলেন।
৩২-বছর বয়সী আলারিফি একটি বাণিজ্যিক ফ্লাইটে ইস্তান্বুল পৌঁছেছিলেন এবং পরে ওয়াইন্ডহ্যাম গ্র্যান্ডে অবস্থান করেন। বিকেল সোয়া ৪টার দিকে তিনি ব্যক্তিগত বিমানে ইস্তান্বুল ছাড়েন।
মুস্তাফা মোহাম্মদ এম আলমাদানী: ৫৭ বছর বয়সী আলমাদানী ব্যক্তিগত বিমানে এসে পৌঁছেছিলেন এবং মুভেনপিক হোটেলে অবস্থান করেছিলেন। তিনি রাত সাড়ে ১২টার দিকে একটি বাণিজ্যিক ফ্লাইটে ইস্তান্বুল ছাড়েন।
মেশাল সাদ এম আলবোস্তানি: ৩২-বছর বয়সী এই ব্যক্তির নাম সম্বলিত ফেসবুক পেজে তাঁর পরিচয় দেয়া হয়েছে সৌদি বিমান বাহিনীর লেফটেন্যান্ট হিসেবে। মিস্টার আলবোস্তানি বেলা ২টার দিকে ইস্তান্বুলে আসেন এবং ওয়াইন্ডহ্যাম গ্র্যান্ডে অবস্থান করেন। পরে ব্যক্তিগত বিমানে ফিরে যান।
গত ১৮ই অক্টোবর তুরস্কের সরকার-পন্থী সংবাদপত্র "ইয়েনি সাফাক" জানায় যে মিস্টার আলবোস্তানী রিয়াদে একটি সন্দেহভাজন গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গেছেন বলে দাবি করা হচ্ছে। যদিও এই বিষয়ে আর বিস্তারিত কোন তথ্য জানানো হয়নি।
ওয়ালেদ আব্দুল্লাহ এম আলসেহরি: স্থানীয় গণমাধ্যমের মতে, সৌদি বিমান বাহিনীতে কর্মরত এই নামের এক ব্যক্তিকে ক্রাউন প্রিন্স গত বছর স্কোয়াড্রন লিডার পদে পদোন্নতি দেন।
৩৮-বছর বয়সী এম আলসেহরি ব্যক্তিগত বিমানে ইস্তান্বুল আসেন এবং মুভেনপিক হোটেলে অবস্থান করেন। পরে অপর ব্যক্তিগত বিমানে তিনি ফিরে যান।
মনসুর ওথমান এম আবাহুসেইন: ২০১৪ সালে স্থানীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি খবরে এই নামের এক ব্যক্তিকে জনপ্রতিরক্ষা বিভাগের জেনারেল ডিরেক্টরেটের কর্নেল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
৪৬-বছর বয়সী আবাহুসেইন বাণিজ্যিক ফ্লাইটে ইস্তান্বুল বিমানবন্দরে পৌঁছান এবং ওয়েন্ডহ্যাম গ্র্যান্ডে অবস্থান করে পরে ব্যক্তিগত বিমানে তুরস্ক ছেড়ে যান।
ফাহাদ শাবিব এ আলবালাউই: ৩৩-বছর বয়সী মিস্টার আলাবালাই ব্যক্তিগত বিমানে ইস্তান্বুলে আসেন। তিনি মুভেনপিকে অবস্থান করেন এবং পরে ব্যক্তিগত বিমানে ফিরে যান।
বদর লফি এম আলোতাইবি: ৪৫ বছর বয়সী মিস্টার আলোতাইবি একটি ব্যক্তিগত বিমানে ইস্তাম্বুলে যান। তিনিও মুভেনপিকে অবস্থান করেন এবং একটি ব্যক্তিগত বিমানে ফিরে যান।
সাইফ সাদ কিউ আলকাহতানি: ওয়াশিংটন পোস্টের মতে, তার পরিচয় সনাক্ত হয়েছে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের কর্মচারী হিসেবে। ৪৫ বছর বয়সী আলকাহতানি ব্যক্তিগত বিমানে ইস্তান্বুল পৌঁছান এবং মুভেনপিক হোটেলে অবস্থান করেন।
পরে রাত সাড়ে ১২টার দিকে একটি বাণিজ্যিক ফ্লাইটে উঠতে ইস্তান্বুল বিমানবন্দরের পাসপোর্ট নিয়ন্ত্রণ বুথ অতিক্রম করেন।
তুর্কি মুসেররেফ এম আলসেহরি: ছত্রিশ বছর বয়সী এই ব্যক্তি একটি ব্যক্তিগত বিমানে ইস্তান্বুলে আসেন এবং মুভেনপিক হোটেলে অবস্থান করেন। পরে অপর আরেকটি ব্যক্তিগত বিমানে ইস্তান্বুল ছেড়ে যান।