গাজীপুরের কালীগঞ্জ ইউনিয়নেরই একটি গ্রাম বিরতুল। যে গ্রামটি বিষমুক্ত সবজি চাষের জন্য বিখ্যাত। বিশেষ করে খরিফ মৌসুমে এ গ্রামের প্রধান সবজি কাকরোল। তাই গ্রামটি এখন কাকরোলের গ্রামে পরিণত হয়েছে। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে এই কাকরোল বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। আর এই কাকরোল চাষে স্থানীয় চাষীরা ব্যবহার করছে সেক্স ফেরোমন ফাঁদ। যা ব্যবহার করে চাষীরা বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনে আগ্রহী হয়ে উঠছে। দিন যত যাচ্ছে স্থানীয়ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে এই ফাঁদের জনপ্রিয়তাও।
সরেজমিনে ওই গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, কাকরোল চাষে স্থানীয় চাষীরা ব্যাপক হারে সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করছেন।
ওই গ্রামের কাকরোল চাষী নিহার চন্দ্র দাস বলেন, খরিফ মৌসুমে আমাদের প্রধান ফসল কাকরোল। আমাদের এই উৎপাদিত কাকরোলের চাহিদা এলাকায় তো আছেই ঢাকাসহ পাশ^বর্তী জেলাতেও আছে সমান কদর। এমনকি দেশের চৌহদ্দি পেরিয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে কাকরোল রপ্তানিও করা হচ্ছে।
তিনি আরো জানান, গত বছর ৪০ শতাংশ জমিতে কাকরোল চাষ করি। এবছর এক একর জমিতে কাকরোল চাষ করেছি। যেহেতু আমাদের কাকরোল বিদেশে যাচ্ছে তাই কৃষি বিভাগের পরামর্শে কীটনাশক ব্যবহার না করে জৈবসার ও সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করছেন। এতে যেমন উৎপাদন খরচ কমছে সেই সাথে বিষমুক্ত সবজির চাহিদাও বাড়ছে।
বিরতুল গ্রামের আরেক চাষী সালামত সরকার বলেন, কাকরোল, লাউ ও কুমড়ায় মাছি পোকার আক্রমণ বেশি হয়। কীটনাশক ব্যবহারে এ পোকা তেমন একটা দমন হয় না। আবার টাকাও বেশি খরচ হয়।
তিনি আরো জানান, উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মনির মোল্লা'র পরামর্শে সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করছি। এখন খরচ কমেছে এবং পোকাও বেশি মারা যাচ্ছে। পাশাপাশি বিষমুক্ত সবজিও খেতে পারছি।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা ফারজানা তাসলিম জানান, কুমড়া জাতীয় সবজিতে মাছি পোকার আক্রমণ বেশি দেখা যায়। স্ত্রী মাছি পোকা কচি সবজিতে অভিপজিটর ফুটিয়ে ভিতরে ডিম পাড়ে যা থেকে পরবর্তীতে বিষক্রিয়া হয় এবং ফল পচে যায়। তাই এ পোকা দমনে বাইরে থেকে কীটনাশক স্প্রে করে খুব একটা কাজ হয় না। বরং কীটনাশক ব্যবহারের ফলে পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি পরিবেশে বিদ্যমান উপকারী পোকাও মারা যাচ্ছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবু নাদির সিদ্দিকী বলেন, কুমড়া জাতীয় সবজির মাছি পোকা দমনের একটি কার্যকরি পদ্ধতি হচ্ছে সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করা। সেক্স ফেরোমন ফাঁদে স্ত্রী পোকার গন্ধযুক্ত একটি লিউর প্লাস্টিকের বয়ামে ব্যবহার করা হয়। চাষীরা যাকে তাবিজ বলে থাকেন। এ লিউরের গন্ধে পুরুষ পোকা ফাঁদের ভিতর প্রবেশ করে উড়াউড়ি করতে থাকে এবং প্লাস্টিকের বয়ামে বাঁধা পেয়ে পাখায় আঘাত পেয়ে নিচে পড়ে যায়।
বয়ামের নিচে যেহেতু সাবান গুড়া পানি ব্যবহার করা হয় তাই পোকা আর উড়তে পারে না এবং ফাঁদে পড়ে মারা যায়। বয়ামের ভিতরে ব্যবহৃত ফেরোমন লিউরের দাম ৩০-৩৫ টাকা এবং বয়ামের দাম ৩০-৩৫ টাকা, প্লাস্টিক বয়াম বা বোতল কেটেও ব্যবহার করা যায়। সেক্ষেত্রে আলাদা করে বয়াম কেনার দরকার হয় না।
এক বিঘা জমিতে ১২-১৩টি সেক্স ফেরোমন ফাঁদ প্রয়োজন হয়। একটি লিউর এক মৌসুম ব্যবহার করা যায়।
কৃষি কর্মকর্তা আরও জানান, বিরতুলের কাকরোল স্থানীয় চাহিদা মিটিয়েও বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে এবং দিন দিন কাকরোল উৎপাদন বাড়ছে। অতিরিক্ত কীটনাশক পরিবেশের পাশাপাশি মানব স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকের কারণে কাকরোলের চালান যেন বিদেশ থেকে ফেরত না আসে এ ব্যাপারে কৃষি বিভাগ মৌসুম শুরুর প্রথমেই চাষীদের জৈবসার ব্যবহার ও সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহারের বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এবং নিয়মিত মনিটরিং করা হয়।
চাষীদের মাঝে পরিবেশ বান্ধব এ প্রযুক্তিটি আরও জনপ্রিয় করার জন্য রাজস্ব প্রকল্প ও ন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল টেকনোলজি প্রোগ্রাম ফেজ-২ প্রজেক্ট এর মাধ্যমে চাষীদের মাঝে বিনামূল্যে সেক্স ফেরোমন ফাঁদ বিতরণ করা হয়েছে।