'শিকাগো' শহর গিলে খেয়েছে সর্বগ্রাসী পদ্মা! লেখাটি পড়ে অনেকেই হয়তো হতচকিয়ে গেছেন। প্রশ্ন জাগছে এ কি করে সম্ভব?বাংলাদেশের পদ্মা কিভাবে যুক্তরাষ্ট্রের শহর শিকাগোর ক্ষতি করেছে! ঘটনাটি পুরোপুরি সম্ভব না হলেও অনেকটাই সেরকমই ঘটেছে। যা এক প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসার আর্থ অরজারভেটরি।
চলতি বছরের আগস্টে প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, ১৯৬৭ সাল থেকে গত ৫১ বছরে পদ্মা নদীর ভাঙনে ৬৬ হাজার হেক্টরের (২৫৬ বর্গমাইল) বেশি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে, যা প্রায় যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম শহরগুলোর একটি শিকাগোর সমান। আবার বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ধরতে গেলে যা প্রায় মেহেরপুর জেলার সমান (মেহেরপুরের আয়তন প্রায় ৭১৬ বর্গ কি.মি.)।
গত ৫১ বছরে স্যাটেলাইটে ধারণকৃত ১৪টি ছবি বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, অন্তত গত ৩০ বছর ধরে আয়তন বাড়ছে পদ্মার। নদীটির আকৃতির রূপান্তর হচ্ছে আবার স্থানও বদলাচ্ছে। ফলে হচ্ছে ভূমিক্ষয়।
বিজ্ঞানীরা স্যাটেলাইট ছবিতে পদ্মা নদীর প্রস্থ, গভীরতা, গঠন ও সামগ্রিক আকার পার্থক্য উল্লেখ করে ভাঙন পরিমাপ করেন। নাসার ‘ভাঙনের আকৃতি’ শীর্ষক প্রতিবেদনে প্রাকৃতিক-রঙের স্যাটেলাইট ছবিগুলোর সঙ্গে ১৯৮৮ সাল থেকে পদ্মার আকৃতি ও প্রস্থের পরিবর্তনগুলো তুলনা করা হয়েছে।
এদিকে দীর্ঘদিন থেকেই পদ্মা নদীর প্রশস্ততা, গভীরতা, আকৃতি এবং এর সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে কাজ করছেন বিজ্ঞানীরা। প্রত্যেক ‘টুইস্ট অ্যান্ড জিগজ্যাগ’ স্যাটেলাইট ছবি নদীর একটি ভিন্ন কাহিনি তুলে ধরছে।
নাসার ল্যান্ডস্যাট স্যাটেলাইট থেকে ধারণকৃত ছবিগুলো শুষ্ক মৌসুমে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে তোলা হয়েছে। এ ব্যাপারে প্রতিবেদনে জানানো হয়, স্যাটেলাটের ল্যান্ডস্যাট ৫ ছিল থিমেটিক ম্যাপারের জন্য। ল্যান্ডস্যাট ৭ ছিল বৃদ্ধি পাওয়া থিমেটিক ম্যাপারের জন্য। ল্যান্ডস্যাট ৮ ছিল প্রয়োগগত ভূমির ছবির জন্য।
‘পদ্মা নদীর তীব্র ভাঙনের প্রধান দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, এটি প্রাকৃতিক, মুক্ত প্রবাহিত নদী ও সুরক্ষার তেমন ব্যবস্থা নেই। দ্বিতীয়ত, নদীর তীরে একটি বড় বালুচর রয়েছে, যা দ্রুতই ভেঙে যেতে পারে।‘ বলা হয়েছে প্রতিবেদনে
কিছু গবেষক আশা করছেন, পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে জমি প্রকৃতপক্ষে স্থির হতে পারে এবং এটি শেষ হওয়ার পর নদী ভাঙন কমতে পারে।
প্রতিবেদনটির শেষে বলা হয়, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পদ্মার ভাঙনের হার প্রকৃতপক্ষে কমেছে। নদীটি বক্ররেখার পরিবর্তে জমির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, এলাকাটি ভাঙন থেকে মুক্ত।’
১৯৯৮ সালে ভারতে ফারাক্কা বাঁধ উদ্বোধনের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে বন্যা দেখা দেয়। সে সময় বাংলাদেশে আরও বেশি পানি ঢুকে পড়ে। এর আগে, ‘চর জানাজাতের’ কাছে জায়গা-জমি ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯৯৫-৯৬ সাল থেকে নদীর রেখাচিত্র তীব্রভাবে বেঁকে যায়। বক্ররেখাটি ১৯৯২ সাল থেকে বিকশিত হতে শুরু করে, ২০০২ সালে পতন শুরু হয় এবং এরপর থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়।
প্রসঙ্গত, গত ৩ মাসেই পদ্মার করাল গ্রাসে নিঃস্ব হয়েছে প্রায় ৭ হাজার পরিবার। শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার অনেক বসতি ও বাজার সম্প্রতি পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে। একের পর এক বিলীন হচ্ছে বসতভিটা, রাস্তাঘাট ও সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা, ফসলি জমি আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ধনী-গরীব সবাই এক কাতারে দাঁড়িয়েছে। সর্বস্বান্ত মানুষের কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে আশপাশ।
এ ব্যাপারে নাসার ঐ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, লাখো মানুষ যাতায়াত, সেচ ও চাষাবাদের জন্য পদ্মার ওপর নির্ভরশীল। এ বিপুলসংখ্যক মানুষকে স্বভাবতই নদীটির ১৩০ কিলোমিটার উপকূলের পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে হয়।