Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৭ শনিবার, এপ্রিল ২০২৪ | ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

বাংলাদেশ সীমান্তে বারবার গোলা নিক্ষেপ : সংঘাতের উসকানি দিচ্ছে মিয়ানমারের!

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৭:৫৩ AM
আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৭:৫৩ AM

bdmorning Image Preview


বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে উত্তেজনা প্রতিদিন বেড়েই চলেছে। মাত্র ছয় দিনের ব্যবধানে এবার মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী যুদ্ধবিমান থেকে দুটি গোলা বাংলাদেশের সীমানায় নিক্ষেপ করে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। এক সপ্তাহের মধ্যেই এমন দুটি ঘটনায় বাংলাদেশের বান্দরবান ও কক্সবাজারের সীমান্ত এলাকায় আতঙ্ক ও টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর একের পর এক মর্টারশেল বা গোলা নিক্ষেপের ঘটনায় সীমান্ত পরিস্থিতি নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্লেষকদের। মিয়ানমারের এসব ঘটনা পরিকল্পিত উসকানি নাকি দুর্ঘটনাবশত, তা নিয়ে চলছে বিশ্লেষণ। সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়গুলো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে বলেও জানানো হয়েছে।

কূটনীতিক, নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী পরিকল্পিতভাবে এসব ঘটনার মাধ্যমে সংঘাতে জড়াতে উসকানি দিচ্ছে কি-না তা আগে নিশ্চিত হওয়া জরুরি। এ বিষয়ে কূটনৈতিক চ্যানেলে জোরালো পদক্ষেপসহ সীমান্তে যথাযথ নিরাপত্তামূলক প্রস্তুতিও রাখতে হবে। কূটনৈতিক চ্যানেল অপারগ হলে তখন সামরিক তৎপরতা শুরু করতে হবে। যদিও বলা হচ্ছে- মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে কিছুদিন ধরেই সেখানকার বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘আরাকান আর্মি’র রক্তক্ষয়ী সংঘাত-সংঘর্ষ চলে আসছে। আর সেই হামলা-পাল্টা হামলার প্রভাবেই হয়তো বাংলাদেশের সীমানায় মর্টারশেল বা গোলা পড়তে পারে। কিন্তু এ বিষয়ে নেপিডো তথা মিয়ানমারের কোনো বক্তব্য নেই। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাখ্যা চাইলেও তারা গুরুত্ব দিচ্ছে না। ফলে তাদের এই কর্মকাণ্ডকে খুব স্বাভাবিকভাবেও নিচ্ছেন না সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। 

জানা যায়, গত ২৮ আগস্ট মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ছোড়া দুটি মর্টারশেল বাংলাদেশের নাইক্ষ্যংছড়ির উত্তর ঘুমধুমপাড়ার জনবসতিপূর্ণ এলাকায় এসে পড়েছিল। গোলা দুটি বিস্ফোরিত না হওয়ায় হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। সেই একই সীমান্ত এলাকায় এবার যুদ্ধবিমান থেকে চালানো দুটি গোলা বাংলাদেশ ভূখণ্ডের ১২০ মিটার ভেতরে পড়ে বিস্ফোরিত হয়েছে। এর আগেও ২০১৮ সালের ২ মার্চ বাংলাদেশের তুমবুরু সীমান্ত বরাবর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ‘যুদ্ধংদেহী অবস্থান’ বা সেনা সমাবেশ ঘটায়। এমনকি আকাশ সীমানায়ও মিয়ানমারের প্রবেশের ঘটনা ঘটে। যদিও তখন তারা সেটির ব্যাখ্যা দিয়েছিল। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে কারণে-অকারণে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী ‘উসকানিমূলক’ আচরণ করছে।

শনিবার নতুন করে আবারো গোলা নিক্ষেপের প্রসঙ্গে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, “এখন পর্যন্ত আমরা ভাবছি এটা ‘আনইনটেনশনাল’ (উদ্দেশ্যহীন)। তাদের একটি সংবাদ চলছে যে, মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সেখানকার বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আরাকান আর্মির সংঘর্ষ চলছে। ফলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু গত ২৮ আগস্টের ঘটনায় বাংলাদেশ প্রতিবাদ জানিয়েছে, তবে আমি দেখিনি, এ ব্যাপারে মিয়ানমার কোনো দুঃখ প্রকাশ করেনি। যদি মিয়ানমার অফিসিয়ালি দুঃখ প্রকাশ করত তাহলে এটা দুর্ঘটনাবশত হতে পারত। যেহেতু তারা কিছুই বলেনি তাহলে সন্দেহটা থেকেই যাচ্ছে। এটা ইচ্ছাকৃত কি-না সেটা জানা জরুরি। তারা (মিয়ানমার) কি বাংলাদেশের সঙ্গে সংঘাতে জড়াতে চায়? তাতেই বা তাদের কী লাভ, সেটা আমি বুঝতে পারি না।”

রোহিঙ্গা বিষয়ে আলোচনা থামানোর অপচেষ্টা কি-না এমন প্রশ্নে তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘এটা মনে করি না। যেটা ঘটবে তাতে তারা মনে করতে পারে যে, রোহিঙ্গাদের বিষয়ে দৃষ্টি সরানো বা আলোচনা ঘোরানো। কিন্তু রোহিঙ্গা সঙ্কট তো থেকেই যাবে। এটা নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে আরও ঝামেলায় পড়বে মিয়ানমার।

এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ এবং সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) সদস্য অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, মিয়ানমারের এ ধরনের আচরণ আগেও ছিল। তবে বর্তমানে তারা আরও বিক্ষিপ্ত আচরণ করছে। এ ঘটনাগুলোর পেছনে মিয়ানমারের কোনো উদ্দেশ্য বা কারণ নিশ্চয় আছে। এ বিষয়ে আমাদের (বাংলাদেশ) হয়তো তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ তো নেওয়া যাবে না। কূটনৈতিকভাবে জোরালোভাবে এসব ঘটনার মোকাবিলা করতে হবে। তবে আমার ধারণা, বাংলাদেশের সীমান্ত বলেই মিয়ানমার হয়তো ‘কেয়ার’ (গুরুত্ব) করছে না। এটা যদিও পার্শ্ববর্তী অন্য দেশের সীমান্তে হতো তাহলে মিয়ানমার এটা করতে পারত না। বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমার ‘গায়ে পড়ে ঝগড়ায় লিপ্ত’ হওয়ার মতো আচরণ করে যাচ্ছে। গায়ে পড়ে তারা এক ধরনের সঙ্কট তৈরির চেষ্টা করছে। রোহিঙ্গা ইস্যুকে চাপা দিতেও নানা পরিকল্পনা করতে পারে। ফলে এ বিষয়ে করণীয় হলো- মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠানোর পাশাপাশি তাদের সরকারের উচ্চপর্যায়ে সরাসরি যাতে আমাদের কড়া বার্তা পাঠানো যায় সে ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি আমাদের নিজস্ব প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থাও রাখতে হবে।

এ প্রসঙ্গে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মো. আব্দুর রশীদ বলেন, ‘প্রথমে আমাদের বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, যাতে উত্তেজনা না বাড়ে। এ জন্য আমাদের বিশ্লেষণ করে দাঁড় করতে হবে- তারা কি ইচ্ছে করে এসব বাংলাদেশের দিকে ছুড়ছে? নাকি তাদের অভ্যন্তরীণ কোনো অপারেশনের কারণে অনিচ্ছাকৃতভাবে বাংলাদেশে এগুলো (গোলা) ঢুকে পড়ছে? বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রতিবেদন বিশ্লেষণে আমরা যা বুঝতে পারছি- সেটি হলো আরাকান আর্মি নামের ওদের একটা বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আছে, যারা ওই এলাকা দখল করেছে। যার ফলে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ চলছে। এই সংঘর্ষ থেকে যে গোলা বাংলাদেশে আসছে, তা কি আরাকান আর্মির গোলা না কি মিয়ানমার আর্মির গোলা? তা নির্ণয় করা প্রয়োজন আছে।’ 

তিনি বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ বাংলাদেশের সামরিক সক্ষমতা বাংলাদেশ ধরেই রেখেছে। ইতোমধ্যে দুটি ঘটনা ঘটেছে। এখন যদি তারা এটি বন্ধ না করে, তাহলে কূটনৈতিক চ্যানেলে সতর্ক করা উচিত। এরপর যদি কূটনৈতিক চ্যানেল ব্যর্থ হয়, তাহলে সামরিক প্রতিউত্তরের বিষয়টি আসে।

আব্দুর রশীদ আরও বলেন, প্রথমত কূটনৈতিক চ্যানেল এখন পর্যন্ত যেহেতু কোনো ব্যর্থতার আভাস দেয়নি, সেহেতু সামরিক প্রতিউত্তরের বিষয়ে প্রশ্ন করা এই মুহূর্তে আমাদের প্রয়োজন নেই বলে মনে হচ্ছে। দ্বিতীয়ত হচ্ছে, মিয়ানমারে যুদ্ধ উত্তেজনা তৈরি করার পেছনে তাদের বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে কি-না সেটি আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। তবে এখন পর্যন্ত আমরা তাদের বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যকে চিহ্নিত করতে পারিনি। পরবর্তী সময়ে যেন এমনটি না হয় সে জন্য বিষয়টি কূটনৈতিকভাবে সমাধান হওয়া ভালো।

বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকার নিরাপত্তা প্রস্তুতি প্রসঙ্গে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) পরিচালক (অপারেশন) ও বাহিনীর মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফয়জুর রহমান সময়ের আলোকে বলেন, যেটা জানা যায় মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সেখানকার বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর অনেক দিন ধরেই সংঘর্ষ চলছে। সেটার পরিপ্রেক্ষিতে তো আছেই, তাছাড়াও সীমান্তে বিজিবি সব সময় সতর্কতা অবলম্বন করে থাকে। এই বিষয়ে বিজিবি সতর্ক অবস্থায় আছে। স্থানীয় বাসিন্দাদেরও সতর্কতার সঙ্গে চলাচল সীমিত করতে বলা হয়েছে। যাতে যে কোনো ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো যায়। 

তিনি আরও বলেন, শনিবারের গোলা পড়ার বিষয়েও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আগের ঘটনায়ও মিয়ানমারকে প্রতিবাদলিপি বিজিবি থেকে পাঠানো হয়েছে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও প্রতিবাদ করা হয়। এবারের ঘটনায়ও একই পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

সূত্র: সময়ের আলো

Bootstrap Image Preview