Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৬ শুক্রবার, এপ্রিল ২০২৪ | ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

ঢাকায় পাতালরেলের যাত্রীদের মাসিক ভাড়া ২০-২৫ হাজার টাকা !

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ২২ এপ্রিল ২০২২, ১১:৪২ PM
আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০২২, ১১:৪৩ PM

bdmorning Image Preview
ছবি সংগৃহীত


ঢাকায় মেট্রোরেল এখনো চালু হয়নি। কাজ শেষ হয়নি বিআরটি প্রকল্পের। এর মধ্যেই শুরু হয়েছে পাতালরেল নির্মাণের তোড়জোড়। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকায় প্রস্তাবিত পাতালরেল (সাবওয়ে) নির্মাণ করতে প্রতি কিলোমিটারে গড়ে ব্যয় হবে ২ হাজার ৩৬২ কোটি টাকা। নির্মাণের পর পাতালরেলের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় যেতে নিয়মিত যাত্রীদের প্রতি মাসে ভাড়া দিতে হবে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা।

রাজধানীর যানজট নিরসনের লক্ষ্যে যে কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) নেওয়া হয়েছিল, তাতে ফুটপাত, গণপরিবহনব্যবস্থা, ঢাকার আশপাশের রেলপথ ও নদীগুলোকে কাজে লাগানোর কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়ন না করে একের পর এক মেগা প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে ঢাকায়। এরই অংশ হিসেবে পাতালরেল নিয়ে শুরু হয়েছে তোড়জোড়। কিন্তু এখনই এ প্রকল্প নিলে ঋণের বোঝা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এটি গলার কাঁটায় পরিণত হওয়ার আশঙ্কা করছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। 

টেকসই পরিবহন পরিকল্পনার সঙ্গে ঢাকায় পাতালরেল কতটুকু প্রাসঙ্গিক, এই ধরনের অবকাঠামোর উপযোগিতাই-বা কেমন—এসব বিশ্লেষণের জন্য আজ শুক্রবার রাজধানীতে নগর সংলাপের আয়োজন করে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি)। সংলাপে অংশ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা এই মুহূর্তে পাতালরেলের মতো প্রকল্প গ্রহণ না করার পরামর্শ দেন সরকারকে। 

আলোচনার শুরুতেই আইপিডির নির্বাহী পরিচালক পরিকল্পনাবিদ আদিল মাহমুদ খান বলেন, ‘পাতালরেল নির্মাণে চলতি অর্থবছরের মোট বাজেটের অর্ধেকের বেশি ব্যয় হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নগর-পরিকল্পনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পাতালরেল উচ্চ আয়ের দেশগুলোর সীমিতসংখ্যক কিছু শহরে নির্মিত হলেও তা অতি ব্যয়বহুল প্রকল্প। এ কারণে অতি ধনী দেশগুলোও এখন নতুন করে পাতালরেল নির্মাণের মতো উচ্চাভিলাষী প্রকল্প নিচ্ছে না। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় যেখানে প্রায় ২ হাজার ডলার, সেখানে পাতালরেল নির্মাণের মতো অর্থনৈতিক শক্তি আমাদের নেই বললেই চলে।’ 

ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. এস এম সালেহউদ্দিন বলেন, ‘এই শহরে যে অবস্থা, তাতে সাধারণ মানুষ বিরক্ত। আপনি পাতালরেল করলেন কি-না, তাতে মানুষের কিছু আসে যায় না। মানুষ চায় শান্তিতে, সহজে এবং অল্প সময়ের মধ্যে গন্তব্যে যেতে। সুতরাং এখনই এই প্রকল্প না নেওয়াই ভালো। এই প্রকল্প নিলে ২০৫০ সাল পর্যন্ত যানজট পোহাতে হবে। এতে যে পরিমাণ টাকা খরচ হবে তা দিয়ে ১ হাজার নতুন বাস কিনে বাস রুট রেশনালাইজেশন প্রোগ্রামকে আরও গতিশীল করা যেতে পারে। এতে পরিবহনব্যবস্থা উন্নত হবে। আর যেসব প্রকল্প ঢাকায় চলছে, সেগুলো শেষ করে তারপরেই নতুন প্রকল্পের দিকে যাওয়া উচিত।’ 

অনুষ্ঠানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পাতালরেলের মতো প্রকল্প ব্যয়সাশ্রয়ী হবে না। এই প্রকল্পে গলার কাঁটা তৈরি হবে। এতে ঋণের বোঝা বাড়বে। এভাবে মেগা প্রকল্প না নিয়ে পরিকল্পনামাফিক উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। ঢাকা শহরের জন্য এখনই পাতালরেলের দরকার নেই বলেও মনে করেন তিনি। 

আইডিপির পরিচালক ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) প্রকল্প পরিচালক পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে যানজট অনেক বেড়েছে। সে ক্ষেত্রে অনেকে যানজটের সমাধানের পথ হিসেবে মনে করছেন পাতাল রেলকে। ঢাকা শহরে মানুষের যে গড় আয় তার কত শতাংশ দৈনন্দিন যাতায়াতের জন্য দিতে পারব। সেটা ভাবতে হবে। পাতার রেলে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা লাগবে। সুতরাং প্রতিদিন যাওয়া আসাতে অন্তত ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা খরচ হতে পারে। সে ক্ষেত্রে ৩০ দিনের মধ্যে কেউ যদি ২৫ দিনই কর্মস্থলে যাওয়া আসা করে তাতে ২০ থেকে ২৫  হাজার টাকা খরচ হবে। তাই খরচের বিষয়ে বিবেচনা করে পাতাল রেল আপাতত না করাই ভালো।

বাংলাদেশে ইউএনডিপির প্রতিনিধি মো. মারুফ হোসেন বলেন, ঢাকা শহরের অভিভাবকের ঝামেলা আছে। কোনো কিছুতে সমন্বয় নেই। যে যার মতো করে প্রকল্প নিচ্ছে, এতে জটিলতা তৈরি হচ্ছে। সিটি করপোরেশন, সড়ক ও সেতু বিভাগ কেউ কারও সঙ্গে সমন্বয় করে না। যে যার মতো করে প্রকল্প নিচ্ছে, ফলে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। 

কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় মেট্রোরেল ও বিআরটি অন্তর্ভুক্ত থাকলেও পাতালরেল অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি বলেও জানান আলোচকেরা। তাঁরা বলেন, ঢাকার পাতালরেল নির্মাণে সরকারের সমীক্ষা প্রকল্প প্রধানত কারিগরি সমীক্ষা। এই ধরনের মেগা প্রকল্পের কোনো দিকনির্দেশনা বর্তমান কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা, ঢাকা শহরের মহাপরিকল্পনা ও বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় নেই। বিচ্ছিন্নভাবে ও পর্যাপ্ত পরিকল্পনাগত বিশ্লেষণ না করেই মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের ধারা চলে আসছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এসটিপি সংশোধন করে পাতালরেলকে এসটিপিতে সংযুক্ত করা হবে। 

প্রসঙ্গত, ২০০৫ সালের কৌশলগত পরিকল্পনা এবং বিভিন্ন গবেষণা ও সমীক্ষায় ঢাকার জনসংখ্যার ঘনত্ব, যাত্রীদের যানবাহন ব্যবহারের প্রবণতা ও যানজট বিবেচনায় নিয়ে বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি বা বিশেষ পদ্ধতিতে বাস পরিচালনার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। এটা করা গেলে এক বাসের সঙ্গে অন্য বাসের প্রতিযোগিতা থাকত না। কিন্তু ১৭ বছরেও বাসের ফ্র্যাঞ্চাইজি ব্যবস্থা চালু হয়েছে শুধু একটি রুটে। ওই পরিকল্পনায় ঢাকার আশপাশের নদী ও রেলপথগুলোকে কাজে লাগানোর কথা বলা হলেও সে অনুযায়ী কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। 

এ পরিকল্পনায় ২০২৫ সালের মধ্যে মেট্রোরেলের পাঁচটি লাইন, দুটি বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট রুট (বিআরটি), তিনটি রিং রোড, আটটি রেডিয়াল রোড, ছয়টি এক্সপ্রেসওয়ে, ২১টি পরিবহন হাব, ঢাকার চারপাশে বৃত্তাকার নৌপথের আধুনিকায়ন, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা, বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি এবং পথচারী অগ্রাধিকার কৌশল ঠিক করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু উড়ালসড়ক ও মেট্রোরেল ছাড়া আর কোনো কিছুই এগোয়নি। এ দুটো নিয়ে কাজ শুরু হলেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলো শেষ হয়নি। ফলে বেড়েছে ব্যয় এবং মানুষের দুর্ভোগ। আইপিডি আয়োজিত শুক্রবার আলোচনা সভায় এ প্রসঙ্গগুলোই ঘুরেফিরে এসেছ।

Bootstrap Image Preview