Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৭ শনিবার, এপ্রিল ২০২৪ | ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

কলাবাগানে মাস্টারমাইন্ডের সেই ছাত্রীর মৃত্যু যৌন সম্পর্কের পর ‘রক্তক্ষরণে’

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৮ এপ্রিল ২০২১, ১১:১১ AM
আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০২১, ১১:১১ AM

bdmorning Image Preview


কলাবাগানে ফারদিন ইফতেখার দিহানের বাসায় ‘ও’ লেভেলপড়ুয়া মাস্টারমাইন্ড ছাত্রীর মৃত্যুর কারণ ছিল ‘অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ’। ভিসেরা পরীক্ষাতেও বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার দাবি করেছে পুলিশসহ তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি দুপুরে নিজ বাসায় ডেকে নিয়ে ওই ছাত্রীকে ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগ রয়েছে দিহানের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় ৭ জানুয়ারি রাতেই ছাত্রীর বাবা দিহানকে একমাত্র আসামি করে কলাবাগান থানায় মামলা করেন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে করা এ মামলায় ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগ আনা হয়।

ঘটনার দিনই দিহানকে আটকের পর গ্রেপ্তার দেখায় কলাবাগান থানা-পুলিশ। আদালতে তিনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে দাবি করেন, যৌন সম্পর্কের একপর্যায়ে রক্তক্ষরণে ওই ছাত্রীর মৃত্যু হয়।

তবে এই দাবিকে নাকচ করছে ছাত্রীর পরিবার। এ ছাড়া, ওই ছাত্রীর স্কুলের শিক্ষার্থীরাও ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগ তুলে আন্দোলনে নামেন। দিহান ছাড়া তার আরও তিন বন্ধু এ ঘটনায় জড়িত বলেও তাদের অভিযোগ।

এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ওই ছাত্রীর ময়নাতদন্তের পর ভিসেরার নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। অভিযুক্ত দিহানের ডোপ টেস্ট ও ডিএনএর নমুনা পরীক্ষার প্রতিবেদনও চূড়ান্ত হয়েছে।

সিআইডির ফরেনসিক বিভাগ, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগ ও কলাবাগান থানার একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, কোনো পরীক্ষাতেই ধর্ষণ বা নেশাদ্রব্য খাইয়ে শারীরিক সম্পর্কের প্রমাণ মেলেনি। ঘটনার সময় ওই বাড়িতে দিহান ও মেয়েটি ছাড়া তাদের কোনো বন্ধুর উপস্থিতি ডিএনএ পরীক্ষায় পাওয়া যায়নি। ফলে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগেরও প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

ভিসেরাসহ বেশ কিছু পরীক্ষার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অপ্রস্তুত শারীরিক মিলনের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণেই ওই স্কুলছাত্রী মারা যান।

ভিসেরা পরীক্ষার রিপোর্ট প্রস্তুত

দিহানের বাসায় ছাত্রীর মৃত্যুর পর ময়নাতদন্ত করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগ। এই বিভাগের তখনকার প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ প্রাথমিকভাবে তখন দুজনের যৌন সম্পর্কের তথ্য সংবাদ মাধ্যমকে জানান।

ময়নাতদন্তের সময় মৃত্যুর সঠিক কারণ নিশ্চিত হতে ভিসেরা পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় নমুনা পাঠানো হয় মালিবাগে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফরেনসিক ল্যাবে। প্রায় তিন মাস পর সেই নমুনা পরীক্ষার প্রতিবেদন তৈরি করেছে সিআইডির ফরেনসিক বিভাগ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, ওই ছাত্রীর পাকস্থলিতে কোনো ধরনের বিষাক্ত উপদানের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি, এর অর্থ হলো তাকে কোনো ধরনের নেশাজাতীয় দ্রব্য বা যৌন উত্তেজক ওষুধ খাওয়ানো হয়নি।

ময়নাতদন্তের পর ডা. সোহেল মাহমুদ প্রাথমিকভাবে ‘বিকৃত যৌনাচারের’ সম্ভাবনা সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছিলেন। সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যৌনাঙ্গের নমুনার প্যাথলজি পরীক্ষাও করা হয়েছে। তাতে যৌনাঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার প্রমাণ মিললেও ‘বিকৃত যৌনাচারের’ বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এই রিপোর্ট অনুযায়ী, যৌনাঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের মুখে পড়েন ওই ছাত্রী।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে গত মার্চে বদলি হয়ে এখন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধানের দায়িত্বে আছেন ডা. সোহেল মাহমুদ। তবে নিয়ম অনুযায়ী, তিনিই ওই ছাত্রীর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করবেন।

ফরেনসিক প্রতিবেদন সম্পর্কে জানতে চাইলে ডা. মাহমুদ বলেন, ‘ভিসেরা নমুনার কেমিক্যাল অ্যানালাইসিসের রিপোর্ট সিআইডির ফরেনসিক ল্যাব থেকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এসেছে, তবে ডিএনএ রিপোর্টটি এখনও পৌঁছায়নি। ডিএনএ টেস্টের রিপোর্টটি মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে চাওয়া হয়েছে, সেটা পেলে চূড়ান্ত ময়নাতদন্ত রিপোর্ট দেয়া হবে।’

তিনি বলেন, ‘মরদেহের যৌনাঙ্গের ক্ষতির মাত্রা দেখে প্রাথমিকভাবে সেক্সটয় ব্যবহারের একটা ধারণা করেছিলাম, কিন্তু রিপোর্ট অনুযায়ী এখনও সে রকম কিছু নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। আমরা এটা নিয়ে আলোচনা করছি, সব রিপোর্ট পেলে একটা সিদ্ধান্তে আসা যাবে।’

দিহান মাদকাসক্ত ছিলেন কিনা এবং ঘটনাস্থলে অন্য কারও উপস্থিতি ছিল কি না, তা নিশ্চিত হতে আদালতের অনুমতি নেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আ ফ ম আসাদুজ্জামান। এরপর ডিএনএর নমুনা পরীক্ষা হয় সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে।

সম্প্রতি ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদনটি পেয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা। এই পরীক্ষায় ওই ছাত্রীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের কোনো প্রমাণ মেলেনি। রিপোর্টে মেয়েটির শরীরে শুধু দিহানের ডিএনএর উপস্থিতি পাওয়া গেছে।

এ ছাড়া, ডোপ টেস্টে দিহানের মাদকাসক্তিরও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। প্রতিবেদন অনুযায়ী, দিহান মাদকাসক্ত ছিলেন না, তবে তিনি ধূমপান করতেন। কলাবাগান থানার দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

পুলিশের তদন্তে আস্থা না পাওয়ার অভিযোগ তুলে মামলার তদন্তের দায়িত্ব পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) দেয়ার আবেদন করেছে ওই ছাত্রীর পরিবার।

এ বিষয়ে আদালতে ৭ এপ্রিল শুনানির কথা থাকলেও করোনা পরিস্থিতির কারণে সেটি পিছিয়ে গেছে। পরবর্তী শুনানির কোনো তারিখ এখনও দেয়া হয়নি।

এই ছাত্রীর বাবা বলেন, ‘আমরা থানা থেকে কোনো সহযোগিতা পাচ্ছি না, তদন্ত কর্মকর্তা মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য দেন না। আমাদের পক্ষ থেকে যারা সাক্ষ্য দিয়েছেন তাদের জবানবন্দিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা। তা ছাড়া দিহানের তিন বন্ধুর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আ ফ ম আসাদুজ্জামান বলেন, ‘এটা যেহেতু একটি আলোচিত মামলা, প্রতিটি বিষয় আমাদের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা অবহিত আছেন। এ মামলা প্রভাবিত করার কোনো সুযোগ নেই। আমরা খুব গুরুত্ব সহকারে সব মোটিভ, তথ্যপ্রমাণ খতিয়ে দেখেছি।’

তিনি বলেন, ‘বাদীপক্ষের দাবি ছিল সেদিন হাসপাতালে উপস্থিত থাকা দিহানের তিন বন্ধুকে মামলায় অন্তর্ভুক্ত করে গ্রেপ্তার করা। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে ঘটনায় জড়িত থাকার কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ ও চাক্ষুষ সাক্ষী পাওয়া যায়নি। এরপরেও বাদীপক্ষের জবানবন্দি রেকর্ড করার সময় তাদের কয়েকজন তিন বন্ধুর সেখানে উপস্থিত থাকা ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের কথা উল্লেখ করতে চেয়েছেন।

‘তবে সাক্ষীদের কেউই ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন না, তাদের কেউ দিহানের তিন বন্ধুকে নিজ চোখে ঘটনাস্থলে দেখেননি। তাই আমি তাদের বলেছিলাম, তাদের তিনজনের কী ভূমিকা ছিল সেটা আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব, আপনারা নিজ চোখে যা যা দেখেছেন জবানবন্দিতে শুধু তাই উল্লেখ করুন।’

আসাদুজ্জামান বলেন, ‘আমরা সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণসহ আসামি, তার বাড়ির দারোয়ানের বক্তব্য অনুযায়ী দিহানের তিন বন্ধুর কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা পাইনি। তারা ঘটনার পর দিহানের ফোন পেয়ে আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে গিয়েছিল। মামলা তদন্ত করতে গিয়ে আমার দায়িত্ব যেমন অপরাধী শনাক্ত করা, তেমনি এটাও খেয়াল রাখতে হয় যেন নিরাপরাধ কেউ শাস্তি না পায়।’

মামলার অভিযোগপত্র জমা দিতে এখন পর্যন্ত দুই দফা আদালত থেকে সময় নেয়া হয়েছে, আর কত সময় প্রয়োজন জানতে চাইলে আসাদুজ্জামান বলেন, ‘আমার তদন্ত শেষ, শুধু ময়নাতদন্ত রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছি, সেটি পেলেই অভিযোগপত্র দিতে পারব।’

Bootstrap Image Preview