বিকেল ৩টা। রাজধানীর মহাখালী ট্রাফিক পুলিশ বক্স লাগোয়া সড়কের একটি বড় অংশ আটকে সারি সারি মোটরসাইকেল দাঁড় করিয়ে রেখেছে ট্রাফিক পুলিশ। এতে চওড়া এই সড়ক বেশ কিছুটা সরু হয়ে গাড়ি চলাচলে বাধার সৃষ্টি করছিল। মোটরসাইকেলের চালকরা ট্রাফিক পুলিশের কাছে অনুরোধ করে বলছিলেন, নির্বাচন কমিশনের নিষেধাজ্ঞার খবর তাঁদের জানা ছিল না।
আবার কেউ কেউ বলছিলেন, তাঁরা জরুরি কাজে নিরুপায় হয়ে মোটরসাইকেল বের করেছেন। তবে সেখানে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের ইন্সপেক্টর দেলোয়ার হোসেন সাফ জানিয়ে দেন, নির্বাচন কমিশনের বিধিমালা মেনে তাঁরা গাড়ি আটক করেছেন। এখন এসব গাড়ি থানায় পাঠানো হবে। নিষেধাজ্ঞা শেষ হলে তাঁরা গাড়ি ফেরত পাবেন। নির্বাচন কমিশনের নিষেধাজ্ঞা না মেনে মোটরসাইকেল চালিয়ে আইন অমান্য করেছেন বাইকচালকরা। এখন তাঁদের বাইকগুলো থানায় নিতে রেকার বিল দিতে হবে তাঁদেরকেই। তিনি বলেন, ‘গাড়ি ছেড়ে দিতে পারি, তবে এক হাজার ২০০ টাকা রেকার বিল দিতে হবে।’ এরপর বাধ্য হয়ে তাঁরা ‘রেকার বিল’ দিয়ে ছাড়িয়ে নেন যাঁর যাঁর মোটরসাইকেল।
এ সময় খাদেমুল নামের একজন বাইক মালিকের রেকার বিলের কাগজে দেখা যায়, তাঁর রেকার নম্বর ১০৪। তিনি এক হাজার ২০০ টাকা দিয়ে মোটরসাইকেল ফিরে পেয়েছেন। ওই রেকার বিলের একটি কপি সেখানে লেখা রয়েছে, ‘মোটরযান বিধিমালা ১৯৪০-এর ১৮৩ বিধি মোতাবেক গাড়ি আটক করে রেকার বিলের প্রতিবেদন। আদেশক্রমে উপ-পুলিশ কমিশনার ট্রাফিক (উত্তর)। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক (উত্তর) বিভাগের মহাখালী জোনের সহকারী কমিশনার (এসি ট্রাফিক) সুবীর রঞ্জন বলেন, ‘সড়কে গাড়ি অকেজো হয়ে পড়ে থাকাসহ সুনির্দিষ্ট কারণে রেকার বিল নেওয়া হয়।’ কিন্তু রেকার না লাগিয়ে রেকার বিল নেওয়া হচ্ছে কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঠিক বিষয়টি এ রকম নয়। যেসব গাড়ি আটক করা হচ্ছে, সেসব গাড়ি রেকার ছাড়া থানায় নেওয়া সম্ভব নয়। তা ছাড়া গত রাত থেকে মোটরসাইকেল চালানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে নির্বাচন কমিশন। এর পরও যারা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মোটরসাইকেল নিয়ে সড়কে বের হচ্ছে, তাদের গাড়ি আটক করে সংশ্লিষ্ট থানায় পাঠানো হচ্ছে। নিষেধাজ্ঞা শেষ হলে গাড়ি ফেরত দেওয়া হবে। অনেকে এক হাজার ২০০ টাকা রেকার বিল দিয়ে গাড়ি নিজের জিম্মায় নিয়ে নিচ্ছে।’
নির্বাচন কমিশনের নিষেধাজ্ঞার পরও কেন মোটরসাইকেল নিয়ে রাস্তায় বের হয়েছেন জানতে চাইলে মহাখালী পুলিশ বক্সের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা শাহজাদা নামের একজন মোটরসাইকেলের চালক বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা ছিল না। নির্বাচনের আগের রাত ১২টার (অর্থাৎ শুক্রবার দিবাগত রাত) পর থেকে মোটরসাইকেল নিয়ে রাস্তায় বের হওয়া যাবে না বলে জানতাম। যদি ভুল হয়ে থাকে, পুলিশ অন্য ব্যবস্থা নিতে পারত। তাই বলে গাড়ি আটকে এক হাজার ২০০ টাকা রেকার বিল নেবে—এটা কোন ধরনের আইন?’
আব্দুর রাজ্জাক নামের অন্য একজন দাবি করেন, তিনি বাড্ডার নতুন বাজার থেকে রোগী নিয়ে কুর্মিটোলা হাসপাতালে যাচ্ছিলেন। এ সময় পুলিশ গাড়িসহ তাঁকে আটক করে এক হাজার ২০০ টাকা রেকার বিল নেয়। শুধু এ দুজন নয়, সেখানে আটকে রাখা ৩৯টি মোটরসাইকেলের চালকের সঙ্গে কথা বলে একই ধরনের অভিযোগ পাওয়া যায়। তাঁরা সবাই দাবি করেন, প্রতিটি মোটরসাইকেল আটকে রেখে পুলিশ এক হাজার ২০০ টাকা রেকার বিল নিয়ে তাঁদের ছেড়ে দিয়েছে।
তবে সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া যানবাহন রেকারিং না করতে ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের প্রতি কঠোরভাবে নির্দেশনা রয়েছে। অতি সম্প্রতি ট্রাফিক সচেতনতামূলক পক্ষের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ডিএমপির কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম স্পষ্টভাবে ঘোষণা দেন, ‘গাড়ি অচল, গাড়ি রেখে চালক বা মালিক কোথাও চলে গেছেন, দীর্ঘ সময় খোঁজ করেও তাঁকে পাওয়া যাচ্ছে না—শুধুমাত্র সেসব ক্ষেত্রে রেকারিং করা হবে। কোনো গাড়ি এর বাইরে রেকারিং করা হবে না।’ কিন্তু যেনতেন কারণে রেকারিং নিয়ে ডিএমপির কমিশনারের এমন কঠোর মনোভাবের পরও ঢাকায় উপযুক্ত কারণ ছাড়াই যখন-তখন গাড়ি রেকারিং চলছে। রেকারের কথা শুনলেই বাসচালক, কন্ডাক্টর ও হেলপারদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। তাঁরা পুলিশের সঙ্গে ঝামেলায় না গিয়ে রেকার বিল হিসেবে নগদ গছিয়ে দিয়ে ‘ঝামেলা’ মেটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
সুত্রঃ কালের কণ্ঠ