আউট সোর্সিং, গ্রাফিক্স ডিজাইন, এসইও, ওয়েব ডিজাইন এবং ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের নামে প্রতারণার অভিযোগে রেক্স আইটি ইনস্টিটিউট নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক আবদুস সালাম পলাশকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তিনি দীর্ঘদিন ধরে বিনিয়োগের ফাঁদ পেতে প্রতারণার মাধ্যমে বিভিন্নজনের ২০০ কোটি টাকার মতো হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ওই প্রতিষ্ঠানটি আউট সোর্সিং, গ্রাফিক্স ডিজাইন, এসইও, ওয়েব ডিজাইন, ডিজিটাল মার্কেটিংসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে।তবে এসবের আড়ালে চলে বড় ধরনের ডিজিটাল প্রতারণা। যার মধ্যমে ২০০ কোটি টাকার বেশি পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন গ্রেপ্তার হওয়া পলাশ।
সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার শারমিন জাহান এসব তথ্য জানিয়েছেন।
প্রতারণার কৌশল সম্পর্কে সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার শারমিন জাহান জানান, সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টার (সিপিসি) গোপন সূত্রে জানতে পারে যে, রেক্স আইটি ইনস্টিটিউটের স্বত্বাধিকারী আব্দুস সালাম পলাশ, তার প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে দীর্ঘদিন যাবত প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছে। রেক্স আইটি ইনস্টিটিউট আউট সোর্সিং, গ্রাফিক্স ডিজাইন, এসইও, ওয়েব ডিজাইন, ডিজিটাল মার্কেটিংসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। এ সব প্রশিক্ষণের আড়ালে চলে বড় ধরনের প্রতারণা।
ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা এ প্রতিষ্ঠানের বিং পেইড মার্কেটিংয়ের প্রচারণা চালাত। যেকোনো প্রতিষ্ঠানের তুলনায় এ প্রতিষ্ঠানে পেইড মার্কেটিং এ বিনিয়োগ করলে ৫০% হতে ১০০% পর্যন্ত রিটার্নের অবিশ্বাস্য অফার দেওয়া হতো যা বাস্তবে অসম্ভব। তার এ প্রতিষ্ঠানের পাঁচ সহস্রাধিক প্রশিক্ষণার্থীদের ট্রেনিংয়ের পাশাপাশি এ ধারণা ঢুকিয়ে দেওয়া হতো। প্রশিক্ষণার্থীরাও মনে করত যেকোনো আউট সোর্সিংয়ের চেয়ে এ কাজে ১৫ থেকে ২০ গুণ বেশি লাভ পাওয়া যাবে। তাই তাদের একটি বিশাল অংশ এ লাভের আশায় বিভিন্নভাবে টাকা সংগ্রহ করে এখানে বিনিয়োগ করে। এছাড়াও ক্যাম্পেইনের কথা ছড়িয়ে দেওয়া হলে বিভিন্ন ব্যক্তি ও ব্যবসায়ী বেশি লাভের আশায় এ প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে।
এভাবে রেক্স আইটি ইনস্টিটিউটের সত্ত্বাধিকারী আব্দুস সালাম পলাশ প্রতারণার মাধ্যমে প্রশিক্ষণার্থী ও বিভিন্ন ব্যক্তি এবং ব্যবসায়ীদের কাছে থেকে আনুমানিক ২০০ কোটি টাকার বেশি অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে বলে প্রাথমিভাবে জানা গেছে।
সিআইডি সূত্রে জানা যায়, রেক্স আইটি ইনস্টিটিউটের ডিজিটাল প্রতারণার শিকার কয়েকজন ভুক্তভোগীর কাছে থেকে অভিযোগ পেয়ে সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টার (সিপিসি) তথ্যের সত্যতা পায়। আসামি আব্দুস সালাম পলাশ বিভিন্ন ভুক্তভোগীদের বিনিয়োগকৃত টাকা ফেরত দেওয়ার চাপের কারণে প্রায় দেড় মাস আগেই গা ঢাকা দেয়। সে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য তার ঠিকানা সে গোপন করে যায় ও খুব দ্রুত সে তার ফোন নম্বর পরিবর্তন করে ফেলত। কিন্তু সে প্রায়ই ফেসবুকে লাইভে এসে নতুন নতুন প্রজেক্ট ও সব বিনিয়োগকারীদের জন্য আকর্ষনীয় অফার ও দেশের বাইরে বেড়াতে যাবার প্রচারণা চালাত।
এমনকি আইন-শৃংঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং গ্রাহকদের নজর এড়ানোর জন্য কয়েকদিন আগে গভীর রাতে সে তার বাসাও পরিবর্তন করে ফেলে।
সিআইডি জানায়, প্রতারণার শিকার একজন ভুক্তভোগী গত ১০ মে রেক্স আইটি ইনস্টিটিউটের সত্ত্বাধিকারী আব্দুস সালাম পলাশের বিরুদ্ধে ধানমন্ডি থানায় প্রতারণা, ডিজিটাল প্রতারণা ও মানিলন্ডারিং আইনে একটি মামলা দায়ের করে। পরবর্তীতে আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের (সিপিসি) বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলামের সার্বিক নির্দেশনায় সিআইডির একটি টিম সেই দিন দিবাগত রাত সাড়ে ১০টায় তাকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি ফ্লাট থেকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় তার ফ্লাট ও পরবর্তীতে রেক্স আইটি ইনস্টিটিউটের ধানমন্ডির অফিস হতে একটি টয়োটা সেলুন কার (ঢাকা মেট্রো-গ ২৯-০০১৭), নগদ ছয় লাখ ৭১ হাজার টাকা, প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত পাঁচটি ল্যাপটপ, কম্পিউটারের তিনটি হার্ড ডিস্ক ও বিপুল পরিমানে ব্যাংকিং ও ননব্যাংকিং কাগজপত্র জব্দ করা হয়।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে সিআইডি জানায়, পলাশ প্রথমে ফ্রি মার্কেটিং ক্যাম্পেইনে আগ্রহীদের নিয়োগ করা হতো, পরবর্তিতে তাদের পেইড মার্কেটিং এ ঢুকিয়ে দেওয়া হতো। তাদেরকে বলা হতো পেইড মার্কেটিং করার জন্য তাদের পেপাল অথবা ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়েসহ কার্ড থাকতে হবে। আর বাংলাদেশে যেহেতু পেপালের কার্যক্রম নেই তাই তারা এখনই সরাসরি মার্কেটিং করতে পারবে না। যেহেতু আব্দুস সালাম পলাশ দীর্ঘদিন থেকে এ পেশার সঙ্গে জড়িত তাই তার আমেরিকান একাউন্ট রয়েছে, তার মাধ্যমেই ক্যাম্পেইন চলবে। তাদের সন্দেহ দূর করার জন্য ‘অ্যাডভারটেন গোল্ড’ নামে একটি সাইট তৈরি করে যা দেখতে অরিজিনাল ‘অ্যাডভারটেন’র মতো।
সিআইডি জানায়, ভুক্তভোগীদের বলা হয় ‘অ্যাডভারটেন’ আব্দুস সালাম পলাশের কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য এ সাইট তৈরি করে দিয়েছে যেখানে সব ভিকটিমদের আলাদা সাব একাউন্ট তৈরি করে দেওয়া হয়। এখানে ভুক্তভোগীরা দেখতে পারে যে সে কত টাকা ক্যাম্পেইন বাবদ প্রদান করেছে ও ক্যাম্পেইনের শেষে সে কত পাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে এ সাইটে কোনো ক্যাম্পেইন হতো না। সবাইকে মনগড়া একটি হিসাব দেখানো হতো। প্রথম যারা আসত তাদেরকে বেশি বেশি লাভ দেখানো হতো ও ক্যাশে তাদের পেমেন্ট দিয়ে দেওয়া হতো। ফলে তারা আরও বেশি টাকা নিয়ে এসে এখানে ইনভেস্ট করত। পরবর্তীতে টাকার পরিমাণ বেশি হয়ে গেলে তাদের আংশিক পেমেন্ট দেওয়া হতো আর বলা হতো বাকি টাকা রি-ইনভেস্ট করা হয়েছে। আসলে সে কোনো মার্কেটিং না করে এমএলএম ব্যবসার মতো কেবল মানুষের কাছে থেকে টাকা নিয়ে তা দিয়ে অন্যদের লাভ প্রদান করত। অনেকে তার এ প্রতারণার ব্যাপারটি বুঝতে পারলে সে গা ঢাকা দেয়।
মো. আব্দুস সালাম পলাশের জন্ম লক্ষীপুরে। সে সোনাইমুড়ী হাইস্কুল থেকে ২০০৭ সালে এসএসসি ও ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বসুন্ধরা শাখা থেকে এইচএসসি পাস করে। পরবর্তীতে ধানমন্ডি চার্টার্ড ইউনিভার্সিটি কলেজ ধানমন্ডিতে চাটার্ড একাউন্টে (সিএ) পড়া শুরু করলেও শেষ করতে পারেনি। ২০১০ সালে সে আউটসোর্সিং এর কাজ শুরু করে। ২০১৬ সালে সে আইটি ভিশন এ ট্রেনার হিসেবে নয় মাস কাজ করে। পরবর্তিতে ২০১৭ সালের মে মাসে সে এবং তার কয়েকজন পার্টনার রেক্স আইটি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে। প্রথমে রেক্স আইটি ইনস্টিটিউট ট্রেনিং করালেও পরবর্তিতে পলাশ উক্ত প্রতারণার সঙ্গে জড়িয়ে পরে।