Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৬ শুক্রবার, এপ্রিল ২০২৪ | ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

‘ভূমি উদ্ধারে প্রশাসনের সহায়তা না পেয়ে’ স্বাধীনতার মাসেই মুক্তিযোদ্ধার আত্মহত্যা

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১৮ মার্চ ২০১৯, ০৯:৫৭ PM
আপডেট: ১৮ মার্চ ২০১৯, ১০:২০ PM

bdmorning Image Preview


অভাবের তাড়না সইতে না পেরে ও সরকারিভাবে বন্দোবস্ত প্রাপ্ত ভূমি উদ্ধারে প্রশাসনের সহায়তা না পাওয়ার অবশেষে স্বাধীনতার মাসেই বয়োবৃদ্ধ বিষপানে আত্মহত্যা করলেন জলফে আলী (৭৮) নামের এক বীর মুক্তিযোদ্ধা।

সোমবার (১৭ মার্চ) বেলা সাড়ে ১১টায় সুনামগঞ্জে প্রয়াত বয়োবৃদ্ধ এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে শেষবারের মতো রাষ্ট্রীয় সম্মাননায় নিজ গ্রামেই দাফন করা হয়।

এর আগে রবিবার (১৬ মার্চ) বিকালে সুনামগঞ্জ জেলা শহরে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের শৌচাগারে গিয়ে তিনি কীটনাশক (বিষ) পান করেন। জলফে আলী সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নের গুদিগাঁও গ্রামের আমির আলীর ছেলে। তিনি ১৯৭১ সালে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বীরত্বের স্বাক্ষর রাখেন।

প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধার পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, রবিবার সকালে সিলেটে যাওয়ার কথা বলে জলফে আলী সদর উপজেলার গুদিগাঁও'র নিজ বাড়ি থেকে বের হয়ে আসেন। জেলা শহর সুনামগঞ্জে পৌঁছানোর পর ওইদিন সকাল ১০টায় জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৯তম জন্মবার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবসে ৭১’র সহযোদ্ধা, সরকারি-বেসরকারি দফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারী, রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃদ্ধের সাথে জেলা শহরে শিশু সমাবেশ ও বর্ণাঢ্য আনন্দ র‌্যালিতে অংশগ্রহণ করেন।

এরপর দুপুরের দিকে তিনি ফিরে যান জেলা শহরে থাকা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে। মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের তৃতীয় তলায় শৌচাগারে গিয়ে ঘণ্টা তিনেক পেরিয়ে গেলে তিনি নীচ তলায় ফিরে না আসায় তার সন্ধানে তৃতীয় তলায় যান নৈশ প্রহরী।

বিকেল সাড়ে চারটার দিকে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে নৈশ প্রহরী আতিকুর রহমান সোহাগ শৌচাগারে সামনে গেলে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ পান। এরপর দরজা ভেতর থেকে বন্ধ পাওয়া ভেতরে কোন ব্যাক্তির অবস্থান অনুমান করতে পারলেও ভেতর থেকে কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে আশপাশের লোকজনকে ও ব্যবসায়ীদের ডেকে তিনি জড়ো করেন।

এক পর্যায়ে শৌচাগারের দরজা ফুটো করে দেখেন একজন মানুষের নিথর দেহ পড়ে আছে। পরবর্তীতে সদর মডেল থানা পুলিশকে খবর দিলে পুলিশ এসে দরজা ভেঙে শৌচাগারের ভেতর পড়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধা জলফে আলীর লাশ উদ্ধার করে। লাশের পাশেই পড়ে ছিল কীটনাশকে বিষের বোতল।

সুনামগঞ্জ সদর মডেল থানার এসআই প্রদীপ কুমার চক্রবর্তী বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে বিষপান করেই বীর মুক্তিযোদ্ধা আত্মহত্যা করে থাকতে পারেন। সুরতহাল রিপোর্ট তৈরীর পর রবিবার রাতে লাশ মর্গে পাঠানোর পর ময়নাতদন্ত শেষে ওই রাতেই প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধার লাশ পরিবারের নিকট হস্তান্তর করা হয়।

এ ব্যাপারে প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী মরিয়ম বিবি রবিবার রাতে সদর মডেল থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা ডায়রীভুক্ত করেন। ওই মামলায় তিনি তার স্বামীর মৃত্যুর কারণ উল্লেখ করেছেন।

জানা গেছে, জলফে আলী একজন রাষ্ট্রীয় ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। প্রথম স্ত্রী মৃত্যুর পর তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন। প্রথম পক্ষের স্ত্রীর চার ছেলে মেয়ে ঢাকায় বসবাস করছে এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন।

এ দিকে গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জের গুদিগাঁওয়ে দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করতে জলফে আলী। দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন অন্যত্র। মেয়ের জামাইরাও দিনমজুরী করেন।

সোমবার দাফন শেষে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার গুদিগাঁও নিজ বাড়িতে সদ্য প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা জলফে আলীর বিধবা স্ত্রী মরিয়ম বিবি (৫৫) ও তার পরিবারের সদস্যরা এ প্রতিবেদের কাছে জানান, ভূমিহীন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে জলফে আলী সদর উপজেলার নারায়ণতলা মৌজায় প্রায় দুই যুগ পূর্বে ৮০ একর ভূমি সরকারিভাবে বন্দোবস্ত হন। এরপর ওই ভূমিতে নিজের দখলে টিনশেডের একটি ছোট বসতঘর ছাড়া অধিকাংশ ভূমি অন্যরা দখল করে ভোগ করতে থাকে। ওই ভূমি নিজের দখলে পেতে গত প্রায় ৫ থেকে ৬ বছর ধরে উপজেলা নির্বাহী অফিসার, জেলা প্রশাসকসহ প্রশাসনের বিভিন্ন দফতরে আবেদন-অভিযোগ করেও দিনের পর দিন ধর্ণা দিয়েও বন্দোবস্তপ্রাপ্ত ভূমি উদ্ধারে প্রশাসনের তরফ থেকে কোন রকম সহযোগিতাই পায়নি তিনি। এ কারণে তিনি স্থানীয় প্রশাসনের প্রতি ক্ষোভের পাশাপাশি ক্রমশ হতাশায় ভুগছিলেন।

এমন হতাশা থেকে মানসিকভাবে ভেঙে পড়লে বয়োবৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধার নানা রোগ-ব্যাধি ও সংসারে অভাব অনটনও জেকে বসে। প্রথম পক্ষের প্রয়াত স্ত্রীর চার ছেলে মেয়ে ঢাকায় থাকলেও দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে জন্ম নেয়া দুই মেয়েকে গ্রামেই বিয়ে দেয়া হয়। দুই মেয়ের পরিবারও ছিল অস্বচ্ছল। মেয়ের জামাইরা দিনমজুরি করে কোন রকম জীবিকা নির্বাহ করতেন।

সোমবার প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী মরিয়ম বিবি জানান, ভূমিটি পুরোপুরি উদ্ধার হলে জীবনের শেষ সময়ে ঢাকায় ও গ্রামে থাকা ছেলে মেয়েদের বসবাসের জায়গা করে দিয়ে যাবার জন্য তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন। কিন্তু ভূমি উদ্ধারে তিনি প্রশাসনের কোন সহযোগীতা না পেয়ে ভুগতে ভুগতে গত কয়েক মাস ধরেই বাড়িতে বলাবলি করতেন 'জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করলাম, জাতীর জনকের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকল মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবার পরিজনকে নানা সুযোগ সুবিধা দেয়ার পাশাপাশি সম্মান ভালবাসাও দিয়েছেন, কিন্তু স্থানীয় প্রশাসনে কোন প্রয়োজনে গেলে আমাদের তেমনভাবে কোন মূল্যায়ন করা হয় না'।

তিনি আরো বলেন, মৃত্যুর দিন কয়েক আগেও তিনি ভূমি উদ্ধারে সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নিকট আরো একদফা মৌখিকভাবে, এমনকি লিখিত আবেদন করেছিলেন। কিন্তু তাতেও সাড়া পাওয়া যায়নি। তাই হয়ত প্রশাসনের সহায়তা না পাওয়ার ক্ষোভে ও অভাবের তাড়না সইতে না পেরেই তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন।

সোমবার সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইয়াসমিন নাহার রুমার নিকট এ বিষয়ে বিস্তারিত অবহিত করা হয়। তিনি বলেন, বহু বছর পূর্বে মুক্তিযোদ্ধা জলফে আলী ৮০ শতাংশ ভূমি সরকারিভাবে বন্দোবস্ত পেয়েছেন বলে বিষয়টি আমি জানি। মৃত্যুর দিন কয়েক পূর্বে উনি আমার সাথে অফিসে এসে দেখা করে আমাকে মৌখিকভাবে ওই ভূমি অন্যদের দখলের থাকা ও ভূমিটি উদ্ধারের জন্য সরকারি সহায়তা চেয়েছেন। কিন্তু লিখিতভাবে কোন আবেদন তিনি করেননি।

Bootstrap Image Preview