Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৬ শুক্রবার, এপ্রিল ২০২৪ | ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

পিঠে পুলিশের লাঠিচার্জ, মুখে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ২১ ফেব্রুয়ারী ২০১৯, ১২:০৫ AM
আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারী ২০১৯, ১২:০৫ AM

bdmorning Image Preview
ভাষাসৈনিক রওশন আরা বাচ্চু। ফাইল ছবি।


ভাষা আন্দোলনের সময় রওশন আরা বাচ্চু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ছাত্রী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হয়েও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের ভাষা আন্দোলনের পক্ষে সংগঠিত করার জন্য নিরন্তর কাজ করে গেছেন। ফেব্রুয়ারির উত্তাল আন্দোলনে তিনি ছিলেন সক্রিয় ভাষাসৈনিক। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হলে তিনি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে অংশ নিয়েছেন, বক্তব্য রেখেছেন।

সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারি হরতাল আহ্বান করায় সরকার বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে এবং পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে।

এ সময় যেসব ছাত্রছাত্রী ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে আন্দোলন করেছেন, রওশন আরা বাচ্চু তাদের মধ্যে একজন। ২১ ফেব্রুয়ারিতে তিনি ইডেন কলেজ ও বাংলাবাজার বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের একত্র করে আমতলার সমাবেশস্থলে নিয়ে আসেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবেশস্থলটির বাইরে পুলিশ লাঠি দিয়ে ব্যারিকেড দিয়েছিল। শাফিয়া খাতুন নামে এক ছাত্রী লাঠির ওপরে দিয়ে লাফিয়ে এবং হালিমা খাতুন নামের একজন নিচ দিয়ে বের হয়ে গেলেও রওশন আরা বাচ্চু তা করেননি। তিনি স্থির করলেন, মাথা নত করে যাব না এবং লাঠির ওপর দিয়েও যাব না, যেতে হলে ব্যারিকেড ভেঙে তবেই যাব।

সেই সাহসী ও উদ্যমী নারী ভাষাসৈনিক রওশন আরা বাচ্চুর সাথে আলাপকালে উঠে আসে আন্দোলনের নানান স্মৃতি। তার সাথে কথা হয় বিডিমর্নিং- এর হেড অব নিউজ ফারুক আহমেদ আরিফ- এর।

ফারুক আহমেদ আরিফ : আপনি ভাষা আন্দোলনে কিভাবে জড়িত হলেন?

রওশন আরা বাচ্চু : ভাষা আন্দোলনে আমার জড়িত হওয়ার পেছনের কারণ বলতে আমি ছোট্ট একটি ঘটনা বলতে চাই। আমাদের এলাকায় মেয়েদের পড়াশোনার প্রচলন ছিলো না। তাই আমাকে শিলং পাঠানো হলো। সেখানে আমি পড়াশোনা করছিলাম। তখন একসময় শিলং টাউনহলে গান্ধীজি এসেছিলেন, তার বক্তব্য শুনেছি। নেতাজি সুভাষ বোসের বক্তব্য শুনেছি। তাদের যে নীতি, তাদের যে সংগ্রাম সেগুলো আমাকে উদ্ভুদ্ধ করেছিল। দেশ যখন বিভক্ত হলো তখন দেখলাম আমরা আমাদের যে অধিকার রয়েছে তা পাচ্ছি না তখন সেই যে চেতনা সেই যে সংগ্রামী মনোভাব সেখান থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন আমি ভাষা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলাম।

ফারুক আহমেদ আরিফ : আন্দোলনের ছবি দেখলেই পুরুষদের চোখে পড়ে। মেয়েদের তেমন দেখা মেলে না। সেক্ষেত্রে আপনাদের সাথে মেয়ে বন্ধু আর কে কে ছিলেন এই আন্দোলনে?

রওশন আরা বাচ্চু: সুফিয়া, হালিমা খাতুন, শরিফা খাতুনসহ আরো অনেক মেয়েরাই ছিলো তখন।

ফারুক আহমেদ আরিফ : আমার জানা মতে তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেদের সাথে কথা বলতে পর্যন্ত প্রভোস্টের অনুমতি নিতে হতো। সেখানে আপনারা মেয়েরা কিভাবে এই আন্দোলন করলেনব? আর কি কি সমস্যার সম্মুক্ষীন হলেন?

রওশন আরা বাচ্চু : আমাদের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেদের সাথে কথা বললে ১০ টাকা ফাইন করা হতো, হল থেকে বের করে দিতো, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দিত। জরিমানা, হল থেকে বের করে দেয়া, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দেয়া, পরে পরিবারের সম্মুখে সমস্যায় পড়া এই সবকিছুর ভয় মাথায় নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছিলো মেয়েরে।

ফারুক আহমেদ আরিফ : ২১ শে ফেব্রুয়ারির দিন ১৪৪ ধারা ভেঙে এগিয়ে গিয়েছিলেন; সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন।

রওশন আরা বাচ্চু : নাজিমুদ্দীনের ঘোষণা শুনে আমরা ছাত্র-ছাত্রীরা যখন ঠিক করলাম আন্দোলন করার। তার আগে ৪ ফেব্রুয়ারি আমরা যে ধর্মঘট করেছিলাম, সেখানেই ঠিক করেছিলাম সমস্ত বাংলাদেশে এটি ছড়িয়ে দিবো। প্রত্যন্ত গ্রামে শিক্ষার্থীদেরও জড়ো করবো। সেটা দেখেই সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারি করলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা বললো- আমরা যেভাবেই হোক ১৪৪ ধারা ভাঙবো। আর সেটিই ছিলো ২১ শে ফেব্রুয়ারির কর্মসূচি।

ফারুক আহমেদ আরিফ : সেদিন মিছিলের প্রথম দলেই কি আপনি ছিলেন?

রওশন আরা বাচ্চু : আমাদের সময় সাধারণত সিনয়র-জুনিয়র একটি বিষয় ছিল। যে কোনো কাজে আমাদের সিনয়রা আগে থাকতেন, আমরা পেছনে। কিন্তু সেদিন সিনিয়র জুনিয়র মানার সুযোগ ছিল না। এতো লোক সমাগম হয়ে গিয়েছিলো যে আময়া নিজেরাই হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু এক পর্যায়ে হঠাত বিতর্ক লেগে গিয়েছিল যে, ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে নাকি হবে না। কারণ পুলিশ ব্যারিকেড দিয়েছিলো। ব্যারিকেডের সামনে পুলিশ হাটু ভেঙে বন্দুক তাক করে বসে ছিলেন। আমাদের শিক্ষকরা নেমে আসলেন আর ছাত্রদের কাছে অনুরোধ করে বললেন আজকে সরকার একটি কঠিন পদক্ষেপ নিয়েছে, আজকে আন্দোলন বন্ধ করে দাও। তখন সকল ছাত্রছাত্রী বিনয়ের সাথে সেটি উপেক্ষা করলেন। শহীদ খান নামে এক ছেলে মধুর ক্যান্টিন থেকে একটা বেঞ্চ টেনে দাঁড়িয়ে গেলো। তখন তাকে নামিয়ে আব্দুল মতিনকে দাড় করানো হলো। তখন তিনি গণতান্ত্রিক উপায়ে জিজ্ঞেস করলেন আপনারা কি চান? ৪৪ ধারা ভাঙবেন কি ভাঙবেন না? তখন দুই হাত মুষ্ঠী করে উপরের দিকে তুলে সবাই বললো- আমরা ১৪৪ ধারা ভাঙবোই ভাঙবোই। তখন গিয়ে ঠিক হলো আমরা ১০ জন ১০ জন করে বের হবো। প্রতি দলের সাথে আমরা তখন বেরিয়ে গেলাম। আমাদের সবারই মাথায় ছিলো যে কোনো সময় গুলিও চলতে পারে। তবুও থেমে থাকিনি।

আমরা যখন একদম ব্যারিকেডের সামনে চলে আসলাম তখন কেউ কেউ ব্যারিকেডের উপর দিয়ে পার হয়ে গেলো আবার কেউ কেউ নিচ দিয়ে চলে গেলো। সেটা দেখে আমার মনে তখন দৃঢ় প্রত্যয় হলো যে আমি ব্যারিকেডের উপর দিয়েও যাবো না আর নিচ দিয়েও যাবো না। আমি এই ব্যারিকেড ভেঙেই যাবো। তখন আমি গিয়ে ব্যারিকেড নাড়া দিচ্ছি, তখন আমার দেখাদেখি সবাই সেটা নাড়া দিতে থাকলো। তখন লাঠিচার্জ হলো, আমার পিঠেও তখন লাঠিচার্জ হচ্ছিলো। আমাদের মুখে তখন একটাই বাক্য ছিল, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। পরের দিন ২২ শে ফেব্রুয়ারি আমাদের শোক মিছিল হলো।

ফারুক আহমেদ আরিফ : তরুণ প্রজন্ম নিয়ে আপনার কি অভিমত কিংবা কিছু যদি বলতে চান তাদের উদ্দেশ্যে।

রওশন আরা বাচ্চু : তরুণ প্রজন্মকে বলবো ভাষা আন্দোলন থেকে আজকের যে বাংলাদেশ যা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হয়েছে। সেই ইতিহাস জানুক তারা। আর ভাষার লড়াই আমাদের চিরকালের। নতুন প্রজন্ম যেভাবে কথা বলছে সেটাতো আমাদের ভাষা না। তাদের কাছে আমার আবেদন যে তারা সঠিক বাংলা বলুক।

Bootstrap Image Preview