ডেঙ্গুজ্বরের প্রধান বাহক স্ত্রী এডিস মশা। তবে এ জ্বরের জন্য দায়ী ডেঙ্গু ভাইরাসের রয়েছে চারটি সিরোটাইপ (ে ডন-১, ডেন-২, ডেন-৩ ও ডেন-৪)। বাংলাদেশে এ জ্বরের ভাইরাস ১৯৬৪ সালে সর্বপ্রথম শনাক্ত হলেও ২০০০ সালে এ রোগ মহামারী আকারে দেখা দেয়। তখন এ ভাইরাসের চারটি সিরোটাইপের মধ্যে টাইপ-৩ ছিল প্রিডোমিনেন্ট বা উদীয়মান।
ভাইরাসের সিরোটাইপ নির্ণয়ের জন্য অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি মলিকুলার পদ্ধতির (মাল্টিপ্লেক্স আরটি-পিসিআর) উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আলিমুল ইসলাম। ওই প্রযুক্তির মাধ্যমে মাত্র দুই ঘণ্টায় ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি সিরোটাইপসহ চিকুনগুনিয়া ভাইরাসেরও সিরোটাইপ সঠিকভাবে নির্ণয় করা যাবে। গতকাল বুধবার সকালে মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে গবেষক নিজেই এ কথা জানান।
অধ্যাপক ড. মো. আলিমুল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমানে দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কিটের (এনএস-১) সাহায্যে ডেঙ্গুজ¦রের ভাইরাসের উপস্থিতি ও অনুপস্থির ওপর নির্ভর করে রিপোর্ট দিয়ে থাকে। তবে সেটি ভাইরাসের কোন সিরোটাইপের মাধ্যমে হয়েছে তা জানা যায় না। তা ছাড়াও বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমের সাহায্যে জানতে পারলাম বেশ কয়েকটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা না করেই ভুল রিপোর্ট দিচ্ছে। কিন্তু ডেঙ্গু ভাইরাসের উপস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে কোন সেরোটাইপে আক্রান্ত সেটা উল্লেখ করলে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো এ ধরনের প্রতারণার আশ্রয় নিতে পারত না।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের এ কিট দিয়ে খুব সহজেই রোগীটি ডেঙ্গু ভাইরাসের কোন সেরোটাইপ দিয়ে আক্রান্ত সঙ্গে সঙ্গে তা বলে দেওয়া যাবে। ডেঙ্গুজ¦রের ভাইরাস সঠিকভাবে নির্ণয়ের জন্য (এনএস-১) কিটের স্পেসিফিটি এবং সেনসিটিভিটি এবং এটি কিভাবে সংরক্ষণ করা যায় তা নিয়েও গবেষকদের মধ্যে প্রশ্ন রয়েছে। ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা বিভিন্ন বয়সের ডেঙ্গুরজ্বরের রোগীর লক্ষণ ভিন্ন ভিন্ন হওয়ায় সিরোটাইপ (ডেন-৩) প্রিডোমিনেন্ট হলেও অন্যান্য সিরোটাইপও থাকার যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে।’
রক্তে ডেঙ্গু ভাইরাস শনাক্তরণ বিষয়ে প্রশ্ন করলে এ গবেষক বলেন, ‘ডেঙ্গুতে প্রথমবার আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে জ্বর অবস্থায় ১ থেকে ৫ দিনের মধ্যে রক্তের নমুনা করলে আইজি-জি ও আইজি-এম উভয় পরীক্ষা নেগেটিভ হবে। তবে জ্বর অবস্থায় ২ থেকে ৫ দিনের রক্তের নমুনা এনএস-১ এন্টিজেন পরীক্ষা করলে অবশ্যই ডেঙ্গুজ্বর নিশ্চিত করা যাবে। আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে ১ থেকে ৬ দিনের রক্ত পরীক্ষা করলে যদি শুধু আইজি-এম পরীক্ষার ফল পজিটিভ হয়, তা হলে ওই রোগী প্রথমবার আক্রান্ত হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া যাবে। একই সময়ের রক্ত পরীক্ষা করে যদি আইজি-জি এবং আইজি-এম পজিটিভ হয় তা হলে অবশ্যই ওই রোগী দ্বিতীয়বার ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত।’
বর্তমানে দেশে যেসব ডেঙ্গু রোগী মারা যাচ্ছে তাদের অধিকাংশই একাধিকবার ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিল বলে এ গবেষক ধারণা প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, ‘কোনো একজন ব্যক্তি ডেঙ্গু ভাইরাসের যে কোনো একটি সিরোটাইপে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হলে ওই সিরোটাইপের বিরুদ্ধে রোগীর শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হলেও অন্য সিরোটাইপে আবারও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এভাবে চারটি সিরোটাইপে ওই ব্যক্তি চারবার ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হতে পারে। তবে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত রোগীরা ডায়াবেটিস, ক্যানসার আক্রান্ত রোগী, উচ্চ রক্তচাপের ব্যক্তি, গর্ভবতী নারী, কম বয়সী (৫ বছরের নিচে) ও বয়স্ক (৭০ বছরের বেশি) ব্যক্তিরা ডেঙ্গুজ¦রে মারাত্মক ঝুঁকিতে।’
অধ্যাপক ড. মো. আলিমুল ইসলাম ২০০২ সালে এদেশের ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর রক্তের নমুনা থেকে ডেঙ্গু ভাইরাস টাইপ-৩ আইসোলেশন ও সর্বপ্রথম ডেঙ্গু ভাইরাসের জীবন রহস্য উন্মোচন করেন। তিনি এ ভাইরাস শনাক্তকরণের কিট তৈরি করে ২০০৬ সালে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) গোল্ড মেডেল এবং ২০১১ সালে মালেশিয়ায় প্রযুক্তি প্রদর্শনীতে প্রথম স্থান অধিকার করে। দেশে-বিদেশে বিভিন্ন জার্নালেও ডেঙ্গু বিষয়ে তার গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।