Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৭ শনিবার, এপ্রিল ২০২৪ | ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

‘কাটা-ছেঁড়া’ ছাড়াই ৪২৮ শিশু ভূমিষ্ঠ করিয়েছেন শ্রীমঙ্গলের নার্স শিরীন

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ২৯ মে ২০১৯, ০৫:৩৮ PM
আপডেট: ২৯ মে ২০১৯, ০৫:৩৮ PM

bdmorning Image Preview
সংগৃহীত


মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের ঈটা চা বাগানের সীতা গোয়ালা ৩দিন ধরে গর্ভকালীন ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন। সোমবার (২৭ মে) দুপুর ২টায় সীতাকে নিয়ে কমলগঞ্জের ক্যামেলিয়া ডানকান ফাউন্ডেশন হাসপাতালে আসেন তার স্বামী বাবুশংকর দোসাদ।

হাসপাতালের সিনিয়র নার্স সানজান শিরীন এসে দেখেন বাচ্চা পেটের অনেক উপরে রয়ে গেছে। অস্ত্রোপচার ছাড়া শিশু জন্মদান অনেকটা অসম্ভব। তবু চেষ্টা চালিয়ে যান শিরীন। প্রায় একঘণ্টার চেষ্টায় ‘অস্ত্রোপচার ছাড়াই সন্তান জন্ম দেন সীতা গোয়ালা। ৩.৮কেজি ওজনের একটি ছেলে শিশুর জন্ম দেন তিনি।

আর এ নিয়ে সোমবার (২৭ মে) পর্যন্ত এরকম ৪২৮টি ‘নরমাল ডেলিভারি’ করিয়েছেন নার্স সানজান শিরীন। প্রতিটি গর্ভবতী নারীকে নিরাপদ মাতৃত্ব দিতে সব সময় প্রস্তুত থাকেন শিরীন। অস্ত্রোপচার ছাড়াই শিশু ভূমিষ্ঠ করানোই তাঁর নেশা।

পেশায় নার্স হলেও শখের তাড়নায় নরমাল ডেলিভারি করানো তাঁর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। একটি ডেলিভারি শেষ করেই নবজাতককে নিয়ে সেলফি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দেন শিরীন।

২৮ মে পালিত হলো বিশ্ব নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস। ‘মর্যাদা ও অধিকার স্বাস্থ্য কেন্দ্রে প্রসূতি সেবার অঙ্গীকার’ এই প্রতিপাদ্য নিয়ে সারা দেশের ন্যায় সিলেটেও পালিত হয় দিবসটি।

অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান জন্মদানের হার বাংলাদেশে ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। এতে ঝুঁকিতে পড়ছে মা ও শিশুর জীবন। অথচ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করতে অস্ত্রোপচার ছাড়াই সন্তান জন্মে কাজ করে যাচ্ছেন সানজান শিরীন।

সিলেটর হবিগঞ্জ জেলার বাসিন্দা সানজান শিরীন। বর্তমানে চাকুরী করছেন মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ থানায় ৫০ শয্যা বিশিষ্ট ক্যামেলিয়া ডানকান ফাউন্ডেশন হাসপাতালে। এখানে ১৭টা চা বাগানের শুধুমাত্র চা শ্রমিকের চিকিৎসার দেওয়া হয়।

শিরীন বলেন, একজন মা ডেলিভারি আগে ৪৫ ভোল্ট ব্যথায় কাতরান। অনেক অনেক ব্যথা, এই ব্যথায় গালাগালি, লাত্তি দিয়ে ফেলেও দেন। কিন্তু আমি যখন তার এই ব্যথা থেকে রিলিফ দিতে সাহায্য করি তখন তিনি শান্তি পান। সেই শান্তির হাসি আর নবজাতকের কান্না আমার মনে প্রশান্তি দেয়। তাই গর্ভবতী মায়েদের নরমাল ডেলিভারি করানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করি আমি।

তিনি বলেন, অস্ত্রোপচারে বাচ্চা প্রসব করাতে গিয়ে মা অনেক ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। অস্ত্রোপচারে বাচ্চা হলে একজন নারী পুনরায় মা হতে গেলে ঝুঁকি থাকে ৯০.৭%। শুধু তাই নয় অনেক সময় ছুরি, কাচি লেগে বাচ্চার বিভিন্ন অঙ্গ ক্ষতি হয়। মায়েরাও অস্ত্রোপচার পরবর্তী ইনফেকশনে ভোগেন। অথচ নরমাল ডেলিভারি করানোর পর একজন মা ডেলিভারির ২ ঘণ্টার মধ্যে স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারেন।

সানজান শিরীনের বাবা মুদি দোকানী। ৬বোন ২ভাইয়ের মধ্যে শিরিন তৃতীয়। এইচএসসি পরীক্ষার সময় ম্যাটস (মেডিকেল এসিসটেন্ট ট্রেনিং স্কুল)এর একটি লিফলেট পান শিরিন। ঘরে সবাইকে দেখানোর পর কেউ রাজি না হলেন না ওই কোর্সে ভর্তি করাতে। কারণ আর বেশি পড়াতে চান না বড় ভাই।

তবু শিরিন গো ধরায় অবশেষে কোর্স করাতে রাজী হন তাঁর বাবা। ভর্তি করিয়ে দেন মৌলভীবাজার ম্যাটসে, সাথে মৌলভীবাজার সরকারি কলেজে ডিগ্রি ভর্তি হন শিরীন। এখান থেকে কোর্স শেষ করে ২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময় মৌলভীবাজারের একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে কাজ শুরু করেন।

একই বছর ডিসেম্বর মাসে মা মনি এনজিও’র এইচএস প্রজেক্টে প্যারামেডিক পোস্টে নিয়োগ পান শিরীন। এরপর এফআইভিডিবিতে প্যারামেডিক পোস্টে সিলেটের জৈন্তাপুরেও কাজ করেন। বর্তমানে শ্রীমঙ্গলে ক্যামেলিয়া ডানকান ফাউন্ডেশন হাসপাতালে সিনিয়র নার্স হিসেবে কর্মরত আছেন।

নরমাল ডেলিভারি করানো উপভোগ করেন শিরীন। তার কাজের ব্যাপারে শিরীন বলেন, বাইরে গিয়ে ডেলিভারি করাতে অনেক টাকা চলে যায় চা বাগানের গরিব মানুষের। তাই ক্যামেলিয়া হাসপাতালে আমি অন্যের ডিউটির সময় যেচে গিয়ে ডেলিভারি করানো চেষ্টা করি। কারণ এখানে ফ্রি ডেলিভারি।

শিরীন বলেন, হাসপাতালের উপরের তলায় আমরা থাকি। একদিন মাঝ রাতে এক কলিগ টেনে নামাল। খুব গরিব রোগী, খারাপ অবস্থা, কিন্তু রেফার যাবে না। কারণ তাদের কাছে টাকা নেই। তখন রাত ৩টা বাজে। নিচে নামার সাথে সাথে রোগীর স্বামী আমার পা ধরে ফেললেন। তার এই অসহায় আচরণে আমি নিজেই অনেক অসহায় বোধ করছিলাম।

ডেলিভারি করলাম, ২টি যমজ বাচ্চা হলো। সেই খুশিতে ওই নারী স্বামী আমাকে ২০টাকা বকশিশ দিতে চাইলেন। আমি বললাম লাগবে না। রুমে গিয়ে ভাত-তরকারি এনে দিয়ে গেলাম তাদের। কারণ এত রাতে তার খাবার কোথাও পাবে না। আর ডেলিভারির পর খুব খিদা লাগে রোগীর।

তিনি বলেন, আমাদের মেয়েদের জীবনটা যুদ্ধের। সব সময় সব জায়গায় যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হয়। আমার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি। এখনো ভালো কাজ করার জন্য যুদ্ধ করছি।

Bootstrap Image Preview