প্রেম করার অপরাধে কলেজ পড়ুয়া মেধাবী এক ছাত্রীকে দীর্ঘ তিন বছর ধরে ঘরে আবদ্ধ করে রাখার অভিযোগ উঠেছে পরিবারের বিরুদ্ধে।
স্থানীয়দের সহযোগিতায় তালাবদ্ধ ঘর থেকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করালেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার। চিকিৎসা খরচ ও সুস্থ হবার পর মেয়েটির পড়ালেখার খরচ চালাবেন বলে জানান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মশিউর রহমান। এমন অমানবিক আচারণের জন্য মায়ের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন স্থানীয়রা।
জানা যায়, দিনাজপুর জেলার দক্ষিণে অবস্থিত নবাবগঞ্জ উপজেলা বিনোদনগর ইউনিয়নে নয়াপাড়া গ্রামের রোস্তম আলীর মেয়ে কলেজ পড়ুয়া মেধাবী ছাত্রী সুরাইয়া আক্তার সুমি। পরিবারের পাচঁ সন্তানের মধ্যে আদরের দ্বিতীয় সন্তান সুমি আক্তার। সে নবাবগঞ্জ মহিলা ডিগ্রি কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলো।
স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে পড়ালেখা চলা অবস্থায় সেলাই প্রশিক্ষক রাকিউল ইসলামের সাথে প্রেমে জড়িয়ে পড়ে সুমি। সর্ম্পকটি মেনে নিতে চায় নি মেয়েটির পরিবার। উচ্চশিক্ষা অর্জন করে মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষিকা হওয়ার স্বপ্ন ছিলো মেয়েটির। প্রেমের কারণে সেই স্বপ্নের সামনে বাধাঁ হয়ে দাড়ায় মেয়েটির পরিবারের সদস্যরা। আর এ কারণে সুমির জীবনে দীর্ঘ তিন বছর কেটে যায় আলো-বাতাসহীন স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার ঘরে।
প্রতিবেশীরা জানান, দীর্ঘ দিন থেকে মেয়েটিকে তার বাবা-মা ঘরের মধ্যে আটকে রাখেন। তার পরিবার কুসংস্কারকে বিশ্বাস করে। ৫ বছর ধরে অন্ধকার ঘরে রাখতে হবে বলে জানান তারা। আর এ কারণে প্রতিবেশীরা মেয়েটিকে দেখতে চাইলে মানুষকে দেখলে সে ভয় করবে এমন অযুহাতে কারো সাথে সাক্ষাত করতে দেয়নি তার পরিবার।
অবশেষে স্থানীয়দের সহযোগিতায় উপজেলা নির্বাহী অফিসার মেয়েটিকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করিয়েছে। এদিকে নিজের সন্তানের সাথে এমন অমানবিক আচরণ করায় পরিবারের বিরুদ্ধে ক্ষুদ্ধ এলাকাবাসী।
স্থানীয়দের সূত্রে জানা যায়, রংপুরের একটি স্কুলের মানবিক বিভাগ থেকে ২০১১ সালে এসএসসি ও নবাবগঞ্জের একটি কলেজ থেকে ২০১৩ সালে এইচএসসি পাস করে। পড়ে মহিলা ডিগ্রি কলেজে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে ছাত্রী ছিলেন সে। ছাত্রী হিসেবে সবার কাছে ছিল প্রিয়। লেখাপড়া শেষ করে তার শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন ছিল।
মেয়েটিকে ঘর থেকে উদ্ধারে সময় বেশ কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, বন্দি থাকতে থাকতে মেয়েটির মুখ ও পা বিবর্ণ হয়ে গেছে। হাতের আঙুল গুলো কুঁকড়ে গেছে। বসতে কিংবা দাঁড়াতে পারছেন না। কথা বলা শক্তিও হারিয়ে ফেলেছে সে। শরীর থেকে বের হচ্ছিলো দুর্গন্ধ।
মেয়ের মায়ের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার মেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে আর যে কারণে তাকে ঘরের মধ্যে রেখেছি। বাবা গাঁয়ের লোক কেউ চায় না মুই সুখে শান্তিতে থাকো। মানুষ যেলা কচ্ছে সব মিথ্যা কথা কছে।
এভাবেই অসুস্থতার অযুহাতে মেয়েটিকে ঘরে আটকে রাখার বিষয়টি সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেলেন মেয়ের মা।
রবিবার (১০ ফেব্রুয়ারি) সরেজমিনে গিয়ে নবাবগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সুমি সাথে কথা বলার চেষ্টা করলে সে কোনভাবেই কথা বলতে পারছে না। সে নিজের নামটি বলেই থমকে যাচ্ছে তার কথা বলার বাকশক্তি। তিন বছর আটক থাকার কষ্টগুলো বাধাঁ দিচ্ছে কথা বলার বাকশক্তিকে। যদিও ডাক্তার বলছে আগের থেকে সে অনেকটাই শঙ্কা মুক্ত।
নবাবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকতা খায়রুল আলম জানান, মেয়েটিকে উদ্ধারের পর থেকে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের তত্ত্বাবাধনে নিবিড় যত্ন সহকারে প্রাথমিক চিকিৎসা চলছে। সে সুস্থ হয়ে উঠলে উন্নত চিকিৎসার জন্য বাহিরে পাঠানো হবে বলে জানান তিনি।
তিনি আরো বলেন, মেয়েটি উদ্ধার হওয়ার সময় দীর্ঘদিন অপচিকিৎসায় ও ঘরবন্দী থাকায় ছাত্রীর রক্তশূন্যতা দেখা দিয়েছে। সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে চর্মরোগ, আর মুখে ফাঙ্গাস। ছাত্রীটি শারীরিক সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। তবে খুব দ্রুত সম্ভব সে অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠবে।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মশিউর রহমান বলেন, আমি বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পারি যে উপজেলার নয়াপাড়া গ্রামে একটি কলেজ পডুয়া মেধাবী ছাত্রীকে তার পরিবার দীর্ঘদিন থেকে আটকে রেখেছে। এমন সংবাদ পেয়ে আমি মেয়ের বাবাকে অফিসে ডাকলে মেয়ের বাবা আমাকে বলে তার মেয়ে অনেক অসুস্থ, যে কারণে ঘরে রাখা হয়েছে তাকে।
পরে বিষয়টি আমি মাথায় নিয়ে পুলিশ দিয়ে মেয়েটিকে উদ্ধার করে এনে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করিয়েছি। এখন চিকিৎসা চলছে।
তিনি বলেন, চিকিৎসার খরচ ও মেধাবী শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবনের গতি সচল রাখতে সার্বিক সহায়তার করবেন। পাশাপাশি মেয়েটি সুস্থ হলে নির্মম এই আচরণ যারা করেছেন তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে ।