Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৬ শুক্রবার, এপ্রিল ২০২৪ | ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

সাতছড়ি বনে বাড়ছে মায়া হরিণ

হৃদয় দেবনাথ, মৌলভীবাজার প্রতিনিধিঃ
প্রকাশিত: ১০ জানুয়ারী ২০১৯, ১০:০৩ AM
আপডেট: ১০ জানুয়ারী ২০১৯, ১০:০৩ AM

bdmorning Image Preview


মায়া হরিণ দেখতে চান? চলে আসুন হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলায় অবস্থিত দেশের প্রাচীন ও বৃহত্তম বন রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ও সাতছড়ি বন্যপ্রাণী রেঞ্জে। বনের মধ্যে একটু উঁকি মারলেই দেখতে পাবেন এ হরিণের বিচরণ। দিন দিন এ বনে হরিণের সংখ্যা বাড়ছে। যদিও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) তালিকায় বিপদগ্রস্ত প্রাণী মায়া হরিণ। আমাদের দেশে এটি অতি বিপন্ন প্রজাতির। এ বনে এর সংখ্যা বাড়ায় খুশি সংশ্লিষ্টরা। খুশি এলাকার লোকজনও। 

বন গবেষক আহমদ আলী জানান, মায়া হরিণ সঙ্গী ছাড়াও একলা চলাফেরা করে। সাধারণত জলের আশেপাশে বসবাস করে এরা। পুরুষ মায়া হরিণ তার নিজস্ব এলাকায় বসবাস করে। একাধিক স্ত্রী মায়া হরিণের এলাকায়ও প্রবেশ করে এরা। এমন পরিবেশ পেলেই মায়া হরিণের বংশ বৃদ্ধি পায়। 

সহকারী অধ্যাপক ড. সুভাষ চন্দ্র দে বলেন, মায়া হরিণ খর্বকায় এবং লাজুক প্রকৃতির। চোখ দুইটি উজ্জ্বল ও ভীষণ মায়াবী। আমাদের দেশে হরিণের প্রজাতির মধ্যে এটি আকারে অপেক্ষাকৃত ছোট। লেজ ছোট ও কালচে। কপাল থেকে শিং পর্যন্ত ইংরেজি ‘ভি’ আকৃতির কালচে রেখা রয়েছে। ছোট লালচে বাদামি লোমে দেহ আবৃত। পুরুষ হরিণের শাখান্বিত এক জোড়া শিং থাকে। পূর্ণবয়স্ক একটি মায়া হরিণের গড় ওজন ১৭ কেজি, উচ্চতা ২ ফুটের মতো। এরা অনেকটা নিভৃতচারী। একা চলতে পছন্দ করে। খাদ্যাভ্যাসের দিক থেকে সর্বভুক বলা যায়। ঘাস, লতাপাতা থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র প্রাণী ও পাখির ডিম খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে থাকে এরা।

ড. সুভাষ বলেন, দক্ষিণ এশিয়া এবং চীন, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও এর দ্বীপগুলোয় মায়া হরিণের বিচরণ রয়েছে। পুরুষ মায়া হরিণ সাধারণত তার নির্দিষ্ট এলাকায় বাস করলেও একাধিক স্ত্রী মায়া হরিণের এলাকায় প্রজননের প্রয়োজনে বিচরণ করে। বাংলাদেশে সিলেট ও চট্টগ্রামের বনাঞ্চলে মায়া হরিণ সর্বাধিক বাস করে। সুন্দরবনেও রয়েছে প্রচুর সংখ্যায়। তবে রেমা-কালেঙ্গায় ও সাতছড়িতেও মায়া হরিণ রয়েছে। সন্ধ্যা ও রাতে এরা শব্দ করে ডাকে। পাহাড়-বনাঞ্চল নষ্ট করে বসতি স্থাপনের কারণে এদের স্বাভাবিক বিচরণস্থল ও আবাস নষ্ট হচ্ছে। এজন্য ওরা অনেক সময় বনের বাইরে চলে আসে। তখন শিকারি কিংবা লোকালয়ের মানুষের হাতে প্রাণ হারায়।

ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) তালিকায় বিপদগ্রস্ত প্রাণী হলেও মায়া হরিণ আমাদের দেশে অতি বিপন্ন একটি প্রজাতি। এ হরিণ রক্ষায় এখনই পদক্ষেপ প্রয়োজন। নইলে দিনে দিনে হারিয়ে যাবে নান্দনিক প্রাণীটি।

রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্য সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট আকবর হোসেইন জিতু জানান, একসময় রেমা-কালেঙ্গায় নির্বিচারে মায়া হরিণ শিকার হয়েছে। এতে বন থেকে এটি বিলুপ্তির পথে ছিল। বর্তমানে বনের পাশের এলাকার মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হওয়ায় এ বনে মায়া হরিণ শিকার বন্ধ হয়েছে। সে সুবাদে হরিণের সংখ্যাও বাড়ছে। বন থেকে কোনো হরিণ লোকালয়ে চলে এলেও লোকজন বন বিভাগকে জানিয়ে তাদের কাছে সেটি ফেরত দেন। পরে সেটিকে বনে ছেড়ে দেওয়া হয়।

আইসিইউএনের কর্মকর্তা তারিক কবির বিডিমর্নিংকে জানান, রেমা-কালেঙ্গা ও সাতছড়িতে মোটামুটি ভালো সংখ্যায়  মায়া হরিণ রয়েছে। তবে এর আবাসস্থল, বিচরণ ক্ষেত্র ও খাদ্যের উৎস দিন দিন ধ্বংস হচ্ছে। চোরাগোপ্তা শিকারও হচ্ছে। এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ালে এ বনে মায়া হরিণ আরও বাড়বে।

পরিবেশ প্রেমিক মাহমুদুর রহমান মামুন বলেন, পরিবেশ বন তো বৃক্ষ ও বন্যপ্রাণীর সংসার। সেই সংসারে কত রকমের গাছপালা, লতাপাতা, ফলমূল থাকার কথা। সেই লতাপাতা, ফলমূল বন্যপ্রাণীরা খাবে, গাছপালার নিবিড় আড়ালে শরীর ঢেকে ঘুরে বেড়াবে, বিশ্রাম নেবে। সেই বন কোথায় এখন। গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে, বন উজাড় হচ্ছে। যারা বন বাঁচাবে, যারা বনের প্রাণীর রক্ষাকবচ দেবে, ক্ষমতার সেই শক্তির কেন্দ্রে এখন নগদ বাণিজ্যের জয়জয়কার। মানুষই যেখানে শুধু ক্ষমতার সিঁড়ি, শুধুই হাতিয়ার, সেখানে বন্যপ্রাণী, পশু-পাখির কথা ভাবার মতো সময়, আন্তরিক উদ্যোগ কতটা প্রত্যাশা করার ভিত্তি আছে। তবু আশার ছায়াপথ ধরে এগিয়ে চলেছে মানুষ। 

কিন্তু বনের প্রাণী, তারা তো সেই আঁকাবাঁকা পথ আর বোঝে না। মানুষই পারে তাদের বাঁচার সুযোগ, নিরাপদ আশ্রয়ভূমি ও জল-জংলার বিচরণক্ষেত্র দিতে। এসবের কি সবটাই ঠিক রয়েছে রেমা-কালেঙ্গায় ও সাতছড়িতে।

কালেঙ্গা রেঞ্জ কর্মকর্তা জানান, রেমা-কালেঙ্গার অভয়ারণ্য মূলত তরফ পাহাড় সংরক্ষিত বনভূমির একটি অংশ, যা দেশের প্রাকৃতিক পার্বত্য বনভূমির মধ্যে সর্ববৃহৎ। অভয়ারণ্যটি এ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার গাজীপুর ও রানীগাঁও ইউনিয়নে অবস্থিত। এ বনাঞ্চলটি ঢাকা থেকে আনুমানিক ১৪০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে এবং সিলেট থেকে ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিম দিকে অবস্থিত। বনাঞ্চলটি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত বরাবর বিস্তৃত।

তিনি বলেন, অপেক্ষাকৃত দুর্গম স্থানে অবস্থিত বলে এ সমৃদ্ধ মিশ্র চিরহরিৎ বনটি এখনও টিকে আছে। অভয়ারণ্যটির আশপাশে রয়েছে তিনটি চা-বাগান। এটি বিভিন্ন বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ ও পশুপাখির আবাসস্থল এবং বিশেষ করে পাখি দর্শনে দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থান।

পূর্ববতী জরিপ মতে, এখানে ৩৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১৬৭ প্রজাতির পাখি, সাত প্রজাতির উভচর, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ৬৩৮ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। আদিবাসী সম্প্রদায় ত্রিপুরা, সাঁওতাল ও উড়ং এ বনভূমির আশপাশে এবং অভ্যন্তরে বসবাস করছে। বিরল প্রজাতির বাঘের বিচরণও রয়েছে এ জঙ্গলে। জঙ্গলটি পরিদর্শনে যে কেউ মুগ্ধ হবেন।

জানা যায়, ১৯১২ সালে জেলার চুনারুঘাট উপজেলার পাহাড়ি প্রায় ১০ হাজার একর দুর্গম পাহাড়ি জমি নিয়ে গঠিত হয় রঘুনন্দন হিলস রিজার্ভ। এরপর প্রায় ৩৭৫০ একর জমিতে প্রতিষ্ঠা পায় সাতছড়ি রেঞ্জ। সাতছড়ি ও তেলমাছড়া বিট নিয়ে এ রেঞ্জ পরিচালিত হয়ে আসছিল। এরই মধ্যে ২০০৫ সালে ৬০০ একর জমিতে উদ্যান করা হয়। এটি নানা প্রজাতির বৃক্ষবেষ্টিত বনাঞ্চল। ছিল না ফুলের বাগান। তাই পর্যটক চাহিদা মেটাতে এখানে বাটারফ্লাই বাগানটি গড়ে তোলা হয়েছে। এছাড়া উদ্যানে দর্শনার্থীর জন্য অনেক সুযোগ-সুবিধা নেওয়া হয়।

বিশেষ করে স্টুডেন্ট ডরমিটরি চালু হওয়ায় পর্যটকরা উদ্যানে রাত যাপন করতে পারছেন। এতে করে এখানে পর্যটকরা রাতের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করার সুযোগ পাচ্ছেন। উদ্যানের অরণ্যে বিভিন্ন ধরনের দুর্লভ গাছ পালাসহ মুখপোড়া ও চশমাপরা হনুমান, বানর, মায়া হরিণ, নানান প্রজাতির পাখির বিচরণ চোখে পড়ায় দিন দিন পর্যটক সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
 

Bootstrap Image Preview