Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৬ শুক্রবার, এপ্রিল ২০২৪ | ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

দেশের রাজনৈতিক সংকটে সংলাপ কতটা সফল?

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ৩০ অক্টোবর ২০১৮, ০৭:১১ PM
আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০১৮, ০৭:১৯ PM

bdmorning Image Preview
ছবি: সংগৃহীত


বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংলাপ বিষয়টি আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। যখনই রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে তখনই সরকার, বিরোধীদল, জনগণ ও বিদেশিরা সংলাপের কথা বলেছেন। সে অনুযায়ী সংলাপ হয়েছেও। দেশে এখন সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক আলোচনাও হলো এই সংলাপকে কেন্দ্র করে।

ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে নবগঠিত ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সংলাপে বসবে বলে গতকাল(২৯ অক্টোবর) জানিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।  এর আগে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির পক্ষ থেকে বারবার সংলাপে বসার আহবান জানানো হলেও সরকারি দল আওয়ামী লীগ সবসময় সেটা প্রত্যাখ্যান করেছে। কিন্তু এখন নবগঠিত রাজনৈতিক জোটের আহবানে সাড়া দিল আওয়ামী লীগ। এই জোটের অন্যতম সদস্য বিএনপিও।

তবে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংলাপ নতুন নয়। কোন কোন সংলাপ সফলতার মুখ দেখেছে আবার কোনটা সফল হয়নি।  জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। ক্ষমতায় আসে জিয়াউর রহমান।১৯৭৬ সালের ২২ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির বিশেষ সহকারী বিচারপতি আবদুস সাত্তারের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের বৈঠক হয়েছিল।

১৯৮৪ সালের ৯ এপ্রিল বঙ্গভবনে সাত দলের নেতাদের সঙ্গে সংলাপ করেন প্রেসিডেন্ট এরশাদ। তখন সাত দলের পক্ষ থেকে ৩৩ দফা দাবিনামা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই সংলাপ ফলপ্রসূ হয়নি। পরদিন ১০ এপ্রিল বঙ্গভবনে জামায়াতের সঙ্গে মতবিনিময় করেন এরশাদ। ১১ এপ্রিল ১৫ দলের নেতাদের সঙ্গে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি এরশাদের সংলাপ হয়েছিল। ১২ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি এরশাদের সঙ্গে খালেদা জিয়ার একান্ত বৈঠক হয়। ১৪ এপ্রিল বঙ্গভবনে এরশাদের সঙ্গে ১৫ দলের দ্বিতীয় পর্যায়ের বৈঠক হয়েছিল। ২৮ এপ্রিল বঙ্গভবনে আবারও আরও ১০ দলের সঙ্গে সংলাপ হয় এরশাদের। কিন্তু সেসব সংলাপ শেষ পর্যন্ত ফলপ্রসূ হয়নি।

এরশাদ সরকারের সময়ে ১৯৮৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে সংলাপের আহ্বান জানান রাষ্ট্রপতি এরশাদ। কিন্তু তখন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা সেই সংলাপের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এর কিছুদিন পর ২৮ অক্টোবর তখনকার সরকারের দুই বিরোধী নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মধ্যে একটি বৈঠক হয়েছিল। ওই বছরের ২৮ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি এরশাদ রাজনৈতিক সমস্যা নিরসনে আবারও আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু বিরোধী রাজনীতিকদের কাছ থেকে তেমন সাড়া পাননি।

১৯৯১ সালে ক্ষমতায় আসে বিএনপি। তখন আওয়ামী লীগসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলনের মুখে ১৯৯৪ সালের ৩১ আগস্ট রাজনৈতিক সংকট নিয়ে সংসদে সরকারি ও বিরোধী দলের দুই উপনেতার মধ্যে বৈঠক হয়েছিল।

একই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর রাজনৈতিক সংকট নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের বৈঠক হয়। উদ্যোগ নেওয়া শুরু হয় সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে আলোচনার। তখনকার কমনওয়েলথ মহাসচিব এনিয়াওকুর এমেকা রাজনৈতিক সংকট নিরসনে ওই বছরের ১৩ অক্টোবর ঢাকায় এসে দুই নেত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কমনওয়েলথ মহাসচিবের মধ্যস্থতায় রাজনৈতিক সংকট নিয়ে সংলাপে দুই নেত্রী আনুষ্ঠানিক সম্মতিও দিয়েছিলেন। পরে সেটিও সফল হয়নি। এরপর কমনওয়েলথ মহাসচিবের বিশেষ দূত স্যার নিনিয়ান এসে রাজনৈতিক সংলাপ তত্ত্বাবধান ও পরিচালনা করেছিলেন। সেময় বিশেষ দূত একটি রাজনৈতিক ফর্মুলাও দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই ফর্মুলা শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি।  

১৯৯৫ সালে আবার বিরোধীদল সংলাপের প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু সেটা প্রত্যাখান করা হয়। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একতরফা নির্বাচন করলেও পরে আওয়ামী লীগসহ সরকারবিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে সরকার।

২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপির নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি এবং সরকারি দল আওয়ামী লীগের সেটি প্রত্যাখ্যানের কারণে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়। তখন সেই সংকট নিরসনে বাংলাদেশে এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার। তিনিও দুই পক্ষের সঙ্গে সংলাপ করেছিলেন। কিন্তু তার চেষ্টাও ফলপ্রসূ হয়নি।

২০০৬ সালের অক্টোবরে নির্বাচনকালীন সরকারের ইস্যুতে তখনকার ক্ষমতাসীন দল বিএনপির মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া ও প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলের মধ্যে প্রায় তিন সপ্তাহব্যাপী সংলাপ হয়েছিল। সে সময় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে   আনুষ্ঠানিকভাবে ২৯ দফা তুলে ধরা হলেও সমঝোতা হয়নি।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের শেষ দিকে নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপে বসে বিএনপি। সংকট নিরসনে জাতিসংঘের রাজনীতিবিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো তিনবার ঢাকায় এসেছিলেন। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে তিনি ৬ দিন ঢাকায় অবস্থান করে দু’পক্ষের মধ্যে সমঝোতা করার চেষ্টা করেন। সেময় তারানকোর উপস্থিতিতে  আওয়ামী লীগ বিএনপির মধ্যে দুই দিন সংলাপ হয়। পরে   জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি নিল ওয়াকারের উপস্থিতিতেও বৈঠক হয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে। কিন্তু সেসব বৈঠকও শেষ পর্যন্ত আশার আলো দেখেনি।

আর বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বহুল আলোচিত এই সংলাপের জন্য এখন নিজেদের মধ্যে সংলাপে বসেছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা। মঙ্গলবার বিকেল ৪টায় মতিঝিলে ড. কামালের চেম্বারে প্রতিনিধি দলের তালিকা ঠিক করতে বৈঠকে বসেন ঐক্যফ্রন্ট নেতারা।

গত রবিবার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে লেখা এক চিঠিতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ও গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন সাত দফা দাবি নিয়ে অর্থবহ সংলাপের আহ্বান জানান।

চিঠিতে আগামী সংসদ নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করতে অর্থবহ সংলাপের কার্যকর উদ্যোগ প্রত্যাশা করা হয়েছে।

গতকাল সন্ধ্যা ৭টার কিছু আগে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ধানমণ্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে চিঠি দুটি পৌঁছে দেন গণফোরামের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট জগলুল হায়দার আফ্রিক এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ও ম শফিকউল্লাহ। আওয়ামী লীগের পক্ষে চিঠি গ্রহণ করেন দলের দপ্তর সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ।

একই চিঠি আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকেও দেওয়া হয়। চিঠি দুটিতে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব ও অবদানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে। গণতন্ত্র ও জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর অবদানও স্মরণ করা হয়েছে। চিঠির সঙ্গে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাত দফা দাবি ও ১১ লক্ষ্য সংযুক্ত করে দেওয়া হয়।

ইতিমধ্যে এই সংলাপের দিন তারিখও ঠিক হয়েছে। সংলাপের আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী বৃহস্পতিবার (১ নভেম্বর) সন্ধ্যায় গণভবনে ডেকেছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে ড. কামাল হোসেনকে পাঠানো এক চিঠিতে সংলাপের এই সময় জানানো হয়েছে। আজ মঙ্গলবার সকালে আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক আব্দুস সোবহান গোলাপ প্রধানমন্ত্রীর এই চিঠি নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের বাসায় যান।

সংলাপের আহ্বান জানিয়ে ২৮ অক্টোবর চিঠি দেওয়ার জন্য জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ড. কামাল হোসেনকে ধন্যবাদও জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। আগামী বৃহস্পতিবার আওয়ামী সভানেত্রীর সাথে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া সংলাপের বিষয়াবলীর দিকেই তাকিয়ে দেশের জনগণ।

Bootstrap Image Preview