Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ১৮ শনিবার, মে ২০২৪ | ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

দুবাইয়ের দেহব্যবসার জন্য গ্রামের তরুণীরাই মূল টার্গেট, পাচার হয় ওমান-সৌদি আরবেও

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৫ ফেব্রুয়ারী ২০২২, ০২:৫৬ PM
আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারী ২০২২, ০২:৫৬ PM

bdmorning Image Preview
ছবি সংগৃহীত


দুবাইয়ে বসে চট্টগ্রামের বাসিন্দা দুই নারী পাচারকারী বিভিন্ন মাধ্যমে দেশের কমবয়সী কিশোরী ও তরুণীদের টার্গেট করছে। এরপর সুযোগ বুঝে তাদের মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাচার করে দেহব্যবসা করানো হয়। দুবাইভিত্তিক এই নারী পাচারকারী চক্রের মূল হোতাদের একজন নিজেও নারী। চক্রটি এরই মধ্যে অন্তত ৮০ জন নারীকে ভালো বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে দুবাই, সৌদি আরব, ওমানসহ বিভিন্ন দেশে পাচার করেছে। সেখানে দালালদের কাছে এই নারীদের বিক্রি করে দেওয়া হয়। পরে জোরপূর্বক ডিজে পার্টিসহ যৌনব্যবসায় করতে বাধ্য করা হয় তাদের।

দুবাইয়ে থাকা এই দুই নারী পাচারকারী হলেন— মহিউদ্দিন (৩৭) ও শিল্পী (৩৫)। দুজনেই চট্টগ্রামের বাসিন্দা। দুবাইতে বসে এই দুজন বাংলাদেশে অবস্থান করা আজিজুল নামের একজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে তরুণীর চাহিদা জানাতেন। ওই চাহিদা অনুযায়ী মাঠপর্যায় থেকে রফিক ও কাউছার উচ্চ বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে গ্রাম থেকে সুশ্রী কিশোরী ও তরুণীদের ঢাকায় নিয়ে আসতেন। দেশে থাকা কোনো নারী বিদেশে চাকরির টোপ গিললে দুবাই থেকে মহিউদ্দিন তার বিদেশে যাওয়ার খরচের টাকা পাঠিয়ে দেন। ইতিমধ্যে পাচার করা মেয়েদের বেশিরভাগকেই পাচার করা হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতে।

রোববার (১৩ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর বিমানবন্দর থানা এলাকা থেকে আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী এই চক্রের তিন সক্রিয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব-১। পাচারকালে তাদের হেফাজত থেকে ভুক্তভোগী তিন তরুণীকে উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতারকৃত তিনজন হলেন— আজিজুল হক (৫৬), মোছলেম উদ্দিন ওরফে রফিক (৫০) ও কাউছার (৪৫)। এ সময় তাদের কাছ থেকে তিনটি পাসপোর্ট, তিনটি মোবাইল ফোন ও নগদ ২৭ হাজার টাকা জব্দ করা হয়।

র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক (সিও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুল্লাহ আল মোমেন বলেন, ‘মানব পাচারকারী চক্রের টার্গেট ছিল দরিদ্র মানুষ। পাচারকারীরা ভালো বেতনে বিদেশে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে সহজ-সরল মানুষদের ফাঁদে ফেলে নিয়ে যাচ্ছে অন্ধকার জগতে। তাদের পাতা জালে জড়িয়ে অবৈধ পথে বিদেশ পাড়ি দিতে গিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছে এসব মানুষেরা। যার অধিকাংশই নারী। পাচারের পর এসব নারীদের বিক্রি করে দিতো চক্রটি। জোরপূর্বক সম্পৃক্ত করা হয় ডিজে পার্টিসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডে।’

মানবপাচার চক্রের মূল হোতা মহিউদ্দিন ও শিল্পী বর্তমানে দুবাইয়ে অবস্থান করছে উল্লেখ করে লে. কর্নেল আব্দুল্লাহ আল মোমেন বলেন, ‘দুবাইয়ে অবস্থান করে তারা নারী পাচারের পরিকল্পনা করেছে বলে গ্রেপ্তার আসামিদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে। এছাড়া চক্রের পলাতক সদস্য নোয়াখালীর নূর নবী ওরফে রানা (৩৫) ও ঢাকার মনজুর হোসেন (৩৩) মানব পাচারকারী চক্রের দেশীয় মূল হোতা বলে চিহ্নিত করা গেছে।’

তিনি বলেন, ‘গ্রেফতার আজিজুল হক এই চক্রের অন্যতম সমন্বয়ক। আজিজুল হকের মাধ্যমে দুবাইয়ে অবস্থানরত মহিউদ্দিন ভুক্তভোগী নারীদের বিদেশে যাওয়ার খরচের টাকা পাঠাতো। চক্রের পলাতক নারী সদস্য তাহমিনা বেগম (৪৮) ও গ্রেফতার রফিক ও কাউছার কমবয়সী ও সুন্দরী মেয়েদের টার্গেট করে প্রলোভন দেখাতো। এরপর বিভিন্ন কোম্পানি ও গার্মেন্টস কারখানায় চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারক চক্র মেয়েদেরকে বিদেশ পাঠাতে প্রলুব্ধ করত। কোনও তরুণী বিদেশ যেতে রাজি না হলে বিভিন্নভাবে হুমকিও দিত তারা। এই চক্রে নারীসহ একাধিক সদস্য পাচারকারীদের সঙ্গে কাজ করছে।’

আরেক বড় হোতা আজম খানও চট্টগ্রামের:  এর আগে ২০২০ সালের ১১ জুলাই সংযুক্ত আরব আমিরাতে নারী পাচারকারী চক্রের বড় হোতা চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির আজম খান দুই সহযোগীসহ গ্রেপ্তার হন দুবাই পুলিশের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে।

চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির বাসিন্দা দুবাইপ্রবাসী আজম খান দুবাইয়ে চাকরির কথা বলে দেশ থেকে আট বছরে সহস্রাধিক কিশোরী-তরুণীকে দুবাই পাচার করেছেন ধরা পড়ার আগ পর্যন্ত। তিনি ও তার সহযোগীরা পাচার হওয়া এসব মেয়েদের অনেককে বাধ্য করেছেন যৌনকর্মী হিসেবে ও ডান্স ফ্লোরে কাজ করতে। ২০২০ সালের জুলাইয়ে এই আজম খানকে দুই সহযোগীসহ রাজধানী থেকে গ্রেপ্তার করার পর তার সঙ্গে পাচার হওয়া বেশ কিছু নারীর কথোপকথনের অডিও-ভিডিও ক্লিপও সিআইডি পেয়েছে, যেগুলোর একটিতে এক তরুণীকে অনুনয়-বিনয় করে তাকে বলতে শোনা যায়, ‘ভাইয়া আমার নাম…। ভাইয়া বাড়িতে আমার মা খুব অসুস্থ। আমি ছাড়া মাকে দেখার আর কেউ নেই। আমার ভিসার মেয়াদ তিন মাস হয়েছে। আমার ভিসার মেয়াদ আর বাড়াবেন না। আমাকে দেশে ফিরতে দেন।’

নারী নিয়ে ব্যবসা করেই আজম খান দুবাইয়ে তিনটি ফোর স্টার ও একটি থ্রি স্টার হোটেলের মালিক হন। নিজের এসব হোটেলে কাজ দেওয়ার নাম করে দেশ থেকে ১৫-২০ বছরের মেয়েদের অর্থের লোভ দেখিয়ে দুবাই পাচার করতেন আজম খান। তাদের প্রথমে কিছুদিন কাজে রাখার পরই শুরু হতো নির্যাতন। নিয়ে যাওয়া হতো ডান্স বারে। পরে জোর করে দেহব্যবসায় নামানো হতো। আজম খানের এই অপকর্মের ইন্ধনদাতা হিসেবে তার ভাইও আছে। এমনকি পাকিস্তানি নাগরিকও রয়েছে তার চক্রে।

জানা গেছে, গ্রেপ্তারকৃত আজম খানের সহযোগী ডায়মন্ডসহ আরো অনেক দালাল ওই সব তরুণীকে সংগ্রহ করে নাচের প্রশিক্ষণ দিত। এরপর তাদের মাসে ৫০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি পাওয়ার কথা বলে দুবাই পাঠানো হতো। এ ক্ষেত্রে লোভে ফেলার জন্য ২০-৩০ হাজার টাকা অগ্রিমও দিত পাচারকারীরা। অগ্রিম টাকা ছাড়াও তাদের দুবাই যাওয়ার খরচও বহন করত পাচারকারীরা। কিন্তু দুবাইয়ের হোটেলে নেওয়ার পরই বদলে যায় দালালদের চেহারা।

Bootstrap Image Preview