‘হৈল বাবা কুড়ি খাই, নাচতে-নাচতে বেস্তে যাই’। কুষ্টিয়ার লালন উৎসব-মেলার পর সাধু-সাধক, পীর-ফকিরদের উপস্থিতিতে দেশের অন্যতম বৃহত্তম কুড়িখাই মেলা অভিমুখী কাফেলা থেকে এমন উচ্চারণ শোনা যায়।
অনেকটা তীর্থ জ্ঞান করে ওরস উপলক্ষে আয়োজিত কামেল পীরের মাজারের এ বিশাল আঙিনায় সপ্তাহব্যাপী মেলা বসে। দুপুর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এ সাত দিনই হাজারও নারী-পুরুষের কাফেলায় কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার সব পথ মিশে যায় কুড়ি খাই মেলায়।
এবার এ মেলায় আসা সাধু-সাধক, পীর-ফকিরের সঙ্গে সমাগম ঘটেছে অনেক চারুকলা শিল্পীরও। তারা পছন্দের সাধু-সাধকদের সামনে কাছে বসিয়ে ক্যানভাসে রঙ তুলির আঁচড় কাটছেন। আঁকছেন অবিকল নান্দনিক পোট্রের্ট।
কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার মুমুরদিয়ায় ইউনিয়নে জমে ওঠেছে ঐতিহ্যবাহী এ কুড়িখাই মেলা। লাখো দর্শনার্থী, আগন্তুক, সাধক-ফকির ও বৈষ্ণব-বৈষ্ণবীসহ বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষের প্রাণের স্পন্দনে মুখরিত হয়ে ওঠেছে এ মেলা।
বসেছে মৃৎ শিল্প, বাঁশ বেত শিল্পের ব্যবহার্য সামগ্রীর পাশাপাশি, বিন্নি খৈ, কদমা (তিলুয়া), বাতাসা, জিলাপি, নানান রকমের মিষ্টির দোকান। রয়েছে নাগর দোলা, যাদু, মোটরসাইকেল খেলার মৃত্যুকূপ, সার্কাস,সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদির আয়োজন।
তবে মেলা সংস্কৃতির প্রসার দিনে দিনে সংকুচিত হয়ে আসায় আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন এ মেলায় আসা অনেক ব্যবসায়ীর। তাদের অভিযোগ, করোনা প্রাদুর্ভাব এমনকি ধর্মের দোহাই দিয়ে দেশের অনেক মেলা আয়োজনকে বন্ধ রাখা হয়েছে। অথচ নির্বিবাদে চলছে নানা স্পর্শকাতর বিষয়ের মোড়কে নানা ধরনের অনুষ্ঠান।
জানা গেছে, বছরের প্রতি মাঘ মাসের শেষ সোমবার থেকে শুরু হয়ে পরবর্তী সাত দিন চলে এই মেলা। আধ্যাত্মিক সাধক শাহ সামসুদ্দিন বুখারির (র.) মাজারে ওরস উপলক্ষে বসে এ মেলা।
কুষ্টিয়ায় লালন সাঁইয়ের মাজারের পর দেশের অন্যতম বৃহত্তম এই প্রাণের মেলায় এ জেলার লোকজনের পাশাপাশি দেশের দূর-দূরান্ত থেকে লাখো দর্শনার্থী, আগন্তুক ও আধ্যাত্মিক সাধক-ফকির এমনকি বৈষ্ণব-বৈষ্ণবীদের সমাবেশ ঘটে।
শিশু-কিশোরদের মনোরঞ্জনে বিশাল এ মেলার আয়োজনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখানে সাধক-ফকির এবং বাউলদের গান-বাজনার আসর বসলেও শেষ পর্যন্ত জামাই-বউয়ের মাছের মেলা সব কিছুকে ছাপিয়ে যায়।
এই আনন্দ আয়োজন ও প্রাণের মেলায় অংশ নিতে ব্যাকুল হয়ে ওঠে বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ। আর এ কারণে করোনা প্রাদুর্ভাবজনিত স্বাস্থ্য বিধি উপেক্ষিত হলেও স্থানীয় প্রশাসন নির্বিকার থাকতে বাধ্য হয়।
জনশ্রুতি আছে, ১২ জন আউলিয়ার সঙ্গে প্রায় ৮০০ বছরেরও আগে ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে আসা আধ্যাত্মিক সাধক হযরত শাহ সামসুদ্দিন আওলিয়া সুলতানুল বুখারী (র.) এই এলাকায় আসেন। তার দেহ ত্যাগের পর গড়ে উঠা মাজারের ওরসকে কেন্দ্র করে কালক্রমে এ প্রাণের মেলার গোড়াপত্তন হয়।
আর প্রতি বছরের মতোই সোমবার থেকে বসেছে ওই কুড়িখাই মেলা। এ উপলক্ষে মাজার সংলগ্ন বিশাল প্রাঙ্গণজুড়ে শিশু-কিশোরদের নানা রকম বিনোদনমূলক বাহন, খেলনা, মাটি, বাঁশ-বেত ও কাটের কুটির শিল্পজাত সামগ্রী এবং বাহারি মুখরোচক ঐতিহ্যবাহী খাদ্য সম্ভারের পসরা সাজিয়ে বসেছে ব্যবসায়ীরা।
একই সঙ্গে একপ্রান্তে বসেছে দুর্লভ ও নানা প্রজাতির মাছের বিরাট মেলা। এ মেলায় কোনো কোনো মাছ দেড় থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত মূল্যেও বিক্রি হয়। আর এ মাছের ক্রেতারা হচ্ছেন- বিভিন্ন স্থানে বিয়ে দেয়া কটিয়াদী উপজেলার মেয়েদের স্বামীরা।
অপরদিকে মেলার অন্য প্রান্তজুড়ে বসেছে সাধক-ফকির-বাউদের গান-বাজনা ও গঞ্জিকা সেবনের প্রকাশ্য আসর।
জনশ্রুতি রয়েছে যে, শাহ শামসুদ্দিন আউলিয়ার ভক্ত বোখারার কুড়ি খাঁ নামে এক সুলতান এই এলাকায় আসেন। পরবর্তীতে ওই সুলতানের নামানুসারে এলাকাটির নাম হয়ে ওঠে কুড়ি খাই।
স্থানীয় শিক্ষক এবং ইতিহাস-ঐতিহ্য গবেষক মাহমুদ কামাল মনে করেন, হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির মূল বার্তা হলো অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। আর এসব মেলা ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সব শ্রেণি পেশার মানুষের মেলবন্ধন। সুতরাং এসব মেলা আয়োজনে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা জরুরি।